শাহরুখ যেন এই অস্থির সময়ে গোটা দেশকে অমর-আকবর-অ্যান্টনির সুতোয় বেঁধে ফেলা দার্শনিক। মূল ছবি: যশরাজ ফিল্মস।
এই লাইনটা লিখলে এই মুহূর্তে গণধোলাই খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তবুও ঝুঁকি নিয়ে ঝড়াক করে লিখেই ফেলি— অভিনেতা শাহরুখ খানের আমি ভক্ত নই। এবং আমি এখনও ‘পাঠান’ দেখিনি (এই সমাজ বা শাহরুখ খানের ভক্তেরা কি আমায় ক্ষমা করবেন?)।
শাহরুখ খানকে সম্ভবত একবারই চোখের সামনে দেখেছি। মানে, কাছ থেকে দেখেছি। তা-ও সে নয় নয় করে প্রায় তিরিশ বছর আগে। কখনও কথা-টথা বলিনি। বলার অবকাশও হয়নি। গত তিন দশক ধরে তিনি যখন তাঁর বিভিন্ন ছবির ‘প্রমোশন’ উপলক্ষে সংবাদমাধ্যমকে ঢালাও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এবং এক একটি লাফে সাফল্যের সিঁড়ির অন্তত তিনটি করে ধাপ চড়ছেন, তখন সেই লাইনে দাঁড়াইনি। সেই যোগ্যতাও আমার ছিল না অবশ্য। তদুপরি, আমি কোনও দিনই শাহরুখ খানের অভিনয়ের ভক্ত ছিলাম না (তাতে তাঁর ইতরবিশেষ কিছু হয়নি। আমি কোথাকারই বা কোন ‘ইল্লি’ যে, তাঁর কাজ আমার ভাল লাগল কি না-লাগল, তা নিয়ে ভাবিত হবেন)। তবে তাঁর অভিনীত ‘রাজু বন গ্যয়ে জেন্টলম্যান’ এবং ‘চক দে ইন্ডিয়া’ আমার বেজায় ভাল লেগেছিল।
অনেকের মতে শাহরুখ খানের অন্যতম ভাল ছবি ‘স্বদেশ’ দেখিনি। কিন্তু এই লেখার গত অনুচ্ছেদে যে দু’টি ছবির নাম লিখলাম, সে দু’টি একাধিক বার দেখেছি। এখনও চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে এই দু’টির কোনও একটি দেখানো হচ্ছে দেখলে সেখানেই আটকে পড়ি। প্রথম ছবির গল্প সাফল্যে মাথা ঘুরে-যাওয়া এক তরুণকে নিয়ে। যে সামান্য ‘রাজু’ থেকে ‘জেন্টলম্যান’ হয়ে গিয়ে তার শিকড় ভোলে, অতীত ভোলে। সাফল্যের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দৌড়তে শুরু করে। সেই দৌড়ে ক্রমশ বেপথু হয়ে পড়ে। তাকে গিলে নিতে শুরু করে চারপাশের আপাত-বৈভব, চাকচিক্য এবং সাফল্যগৃধ্নুতা। পরে তার বোধোদয় হয়।
দ্বিতীয়, ‘চক্ দে ইন্ডিয়া’। মুক্তির পরবর্তী সময়ে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন খেলার মাঠে দেশের হয়ে গলা ফাটানোর জন্য ভারতকে একটা দুর্ধর্ষ (স্লো)গান উপহার দিয়েছে বলে নয়, ‘চক্ দে ইন্ডিয়া’-র কাহিনি একেবারে অন্য রকম। খানিকটা সত্যি ঘটনার মিশেলে। সেখানে শাহরুখের চরিত্র অতীত গ্লানির ছোবলে জর্জরিত এক হকি খেলোয়াড়। জীবন যার প্রতি অকরুণ থেকেছে। তার প্রতিচ্ছায়া পড়েছে তার সামাজিক অবস্থানে। সেই জীবনই তাকে একটা সুযোগ দেয় ঘুরে দাঁড়ানোর। ভিন্ন ভূমিকায়। কঠোর, একমুখী এবং উইয়ে খাওয়া, পুঁইয়ে পাওয়া মহিলা হকি খেলোয়াড়ের দলকে সামনে রেখে নিজেকে প্রমাণে মরিয়া প্রশিক্ষকের ভূমিকায় সে জয়ী হয়। নেপথ্যচারী লজ্জা আর বদনাম মুছে তার উত্তরণ হয়। পাপস্খালন হয়। যে সমাজ, যে পরিপার্শ্ব তাকে খলনায়ক বলে দেগে দিয়েছিল একদিন, সেই জনতা তার জয়ধ্বনি দেয়। কিন্তু তাকে খানিক বিগতস্পৃহ এবং ঈষৎ নির্মোহ মনে হয়। কারণ সে মনে মনে কোথাও জানে, ওই স্লোগান, ওই বীরপুজোয় তার আর কিছু যায়-আসে না। তার লড়াই ছিল নিজের সঙ্গে। সেই যুদ্ধটা সে জিতে গিয়েছে।
দু’টি ছবির কাহিনিই দিনের শেষে ‘হিউম্যান স্পিরিট’-এর জয়ের কথা বলে। দু’টি কাহিনিই জীবনের পাঠ দেয়। সবচেয়ে বড় কথা— দু’টি কাহিনিই কোথাও না কোথাও দেওয়ালে পিঠ ঠেকে-যাওয়া আন্ডারডগের ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলে। দ্বিতীয়টি অনেক বেশিই বলে। হয়তো সেই কারণেই অত ভাল লাগে।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। অভিনেতা শাহরুখ খানের প্রতি আমার কোনও মুগ্ধতা নেই। ছিল না। সম্ভবত থাকবেও না কোনও দিন। বরং অনেক সময়েই মনে হয়েছে, তাঁর সেলুলয়েডের উপস্থিতি বড় বেশি উচ্চকিত। বড় অতিনাটকীয় (ক-ক-ক-ক-ক-ক-কিরণ)। তবে সেই জন্যই না তিনি ‘বলিউডের বাদশা’! এই খেতাব তো অনেক আদরে পাওয়া। এ পরিচয় তো যার-তার কপালে জোটে না। আর পথেঘাটে কিনতেও পাওয়া যায় না। আমি কোথাকার লম্বকর্ণ যে, তা নিয়ে বিতর্ক তুলব!
কিন্তু একই সঙ্গে এটাও প্রবল নির্ঘোষে বলা থাক যে, পর্দার বাইরের রক্তমাংসের শাহরুখের আমি ভক্ত। আমি ভক্ত তাঁর অকৃত্রিম রসবোধের। ভক্ত তাঁর চটপটে চোখা-চালাক জবাবের। ভক্ত সাফল্যের প্রতি তাঁর তীব্র একমুখিতার। ভক্ত তাঁর আশরীর এনার্জির। এবং ভক্ত তাঁর ঝুঁকে-পড়া বিনয়ের। আমি শিক্ষার্থী তাঁর সেই মহার্ঘ উক্তির— ‘‘যে গাছে যত বেশি ফল ধরে, সেই গাছ তার ফলের ভারেই তত বেশি নুয়ে থাকে।’’ একেবারেই আলগোছে বলা তাঁর যে শিক্ষা অকিঞ্চিৎকর এবং তুলনায় ছোট বৃত্তে বিচরণকারী এক পেশাদারকেও শিখিয়ে দিয়ে যায়, পা যেন সর্বদা মাটিতে থাকে আর মাথা কাঁধের উপর।
পর্দার বাইরের এই শাহরুখ খানকে আমি আকণ্ঠ ভালবাসি। এবং এই প্রথম পর্দার শাহরুখ ‘পাঠান’ খানের বক্স অফিস সাফল্যে আমি অভিভূত। আপ্লুত। রোমাঞ্চিত। ‘পাঠান’ এখনও দেখিনি। খুব ঠেলায় না-পড়লে দেখব, এমন কথাও বলতে পারি না। কিন্তু ঐকান্তিক ভাবে চাই, ইতিমধ্যেই দেশের বক্স অফিসে (এবং বিদেশে) ‘পাঠান’ তার ভিক্ট্রি ল্যাপ জারি রাখুক।
কারণ, শাহরুখ খানের এই ‘প্রত্যাবর্তন’ বুঝিয়ে দিয়েছে, দাঁতে দাঁত কামড়ে আত্মবীক্ষা নিয়ে নীরবে নিজের কাজটা করে গেলে সেই অধ্যবসায় এবং নিষ্ঠা ছাপ ফেলে। কে দীপিকা পাড়ুকোনের ২২ সেকেন্ডের গেরুয়া বিকিনি নিয়ে কী বলল, কে শাহরুখ খানের প্রতীকী অন্ত্যেষ্টি করল, তাতে এই দেশের কিস্যু যায়-আসে না। যাবতীয় নেতিবাচকতা আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে প্রৌঢ়ত্বের কিনারায় পৌঁছনো (এই লাইনটা লিখলেও গণপ্রহারে ঘায়েল হওয়ার প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু সত্য তো সত্যই) সাতান্ন বছরের এক নায়ককে সারা দেশ রোজ গাদা গাদা প্রেমপত্র পাঠাতে থাকে।
হতে পারে এর পিছনে রয়েছে টানা চার বছরের বুভুক্ষা। রয়েছে অনতিঅতীতে পুত্রকে কেন্দ্র করে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের নাটকীয় টানাপড়েন, মাদক পাচারের দায়ে আত্মজের গ্রেফতার হওয়া, সেই কারণে সমাজের চোখে পতিত হয়ে যাওয়া, কালক্রমে আরিয়ান খানের নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া এবং তজ্জনিত সহানুভূতি। হতে পারে এর পিছনে রয়েছে শাহরুখ খানের প্রায় তুলনারহিত ক্যারিশমা। রয়েছে ‘পাঠান’-কে ঘিরে সাম্প্রতিক বিতর্কও, খানিক অপাঙ্গে দেখে যাকে অনেকে বলছেন ‘মার্কেটিং গিমিক’।
কিন্তু দিনের শেষে ভালবাসা কথা বলে। ভালবাসাই কথা বলে। আসমুদ্রহিমাচল যে ভালবাসায় শাহরুখ খানকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ভাসিয়ে দিচ্ছে। যে লোকটা বাথরুমে বসে কান্নাকাটি করত, সেই লোকটাই ব্লকবাস্টার সাফল্যের পর তার বিখ্যাত বাংলোর ছাদে উঠে দেহের সমান্তরালে আড়াআড়ি দু’হাত ছড়িয়ে বৈগ্রহিক ‘পোজ়’ দেয়! এ-ও তো সেই আন্ডারডগেরই সাফল্যের কাহিনি। একে ভাল না বেসে থাকা যায়?
‘পাঠান’ মুক্তির আগে মিডিয়ার মুখোমুখি হননি। বেশ করেছেন! মুক্তির পাঁচ দিন পর যখন বক্স অফিসে ঝড় উঠেছে, তখন সহ-অভিনেতা দীপিকা এবং জন আব্রাহামকে নিয়ে বিস্তারিত এবং দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছেন। বেশ করেছেন! বলেছেন, ‘‘একটা জরুরি কথা বলি। আমরা ছবি বানাই জনতাকে আনন্দ দিতে। আমরা ভালও করি। ভুলও করি। কিন্তু একটা কথা সৎ ভাবে বলি— ছবি তৈরির পিছনে আমাদের একটাই উদ্দেশ্য থাকে। সেটা খুব পরিষ্কার। আমরা সকলকে আনন্দ দিতে চাই। উই ওয়ান্ট টু স্প্রেড হ্যাপিনেস, লভ, কাইন্ডনেস অ্যান্ড ব্রাদারহুড। ইভন ইফ আয়াম প্লেয়িং আ ব্যাড গাই, নান অফ আস আর ব্যাড। উই আর অল প্লেয়িং ক্যারেক্টার্স টু মেক ইউ হ্যাপি।’’ আমরা চাই সকলের মধ্যে আনন্দটা ছড়িয়ে যাক। সকলে যেন সেই আনন্দ, ভালবাসা, দয়ামায়া আর সৌভ্রাতৃত্বটা অনুভব করেন। একটা খলচরিত্রে অভিনয় করেছি মানেই আমি মানুষটা খারাপ হয়ে যাইনি। আমরা সকলেই এক একটা চরিত্রে অভিনয় করি। সেটা সকলকে খুশি করার জন্য, সকলকে আনন্দ দেওয়ার জন্য।
আরও কী বলেছেন? বলেছেন, ‘‘ইফ উই সে থিংস ইন দ্য ফিল্ম, নান অফ ইট ইজ় টু হার্ট এনি সেন্টিমেন্ট অর এনিবডি। ইট ইজ় জাস্ট এনটারটেনমেন্ট। উই লভ ইচ আদার। অ্যান্ড উই জোক উইথ ইচ আদার। ফান অ্যান্ড এন্টারটেনমেন্ট শুড বি লেফ্ট অ্যাট দ্যাট তব কা। নো নিড টু টেক ইট সিরিয়াসলি।’’ অর্থাৎ, আমরা ছবিতে কিছু বললেও সেটা কাউকে আঘাত করা বা কারও ভাবাবেগকে ছোট করার জন্য নয়। ওটা নিকষ্যি বিনোদন দেওয়ার জন্য বলা। আমরা প্রত্যেকে পরস্পরকে ভালবাসি। একে অপরের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করি। সেই রং-তামাশা আর বিনোদন যেখানে শুরু হয়, সেখানেই শেষ হয়ে যায়। ওটা এই মুহূর্তের (তব কা)। ওটাকে অত গুরুত্ব দেবেন না।
কিন্তু এ তো ভাল ভাল কথা। যে কোনও খ্যাতনামী বলবেন। এর জন্য পর্দার বাইরের শাহরুখ খানকে এত ভালবাসিনি। ভালবেসেছি তার পরে তিনি যা বলেছেন, তার জন্য— ‘‘এই যে দীপিকা পাড়ুকোন, এ হল ‘অমর’। আমি শাহরুখ খান। আমি ‘আকবর’। আর এই হল জন (আব্রাহাম)। এ হল ‘অ্যান্টনি’। অ্যান্ড দিস ইজ হোয়াট মেক্স সিনেমা: অমর, আকবর, অ্যান্টনি। দেয়ার আর নো ডিফারেন্সেস দ্যাট এনি অফ আস হ্যাভ উইথ এনিবডি, এনি কালচার অর এনি অ্যাসপেক্ট অফ লাইফ। উই লভ ইউ। দ্যাট্স হোয়াই উই মেক আ ফিল্ম।’’
শুনতে শুনতে মনে হল, সুপারস্টার কোথায়, এ তো একজন দার্শনিক কথা বলছেন! এই অস্থির সময়ে গোটা দেশকে অমর-আকবর-অ্যান্টনির সুতোয় বেঁধে ফেলা দার্শনিক। একই দেশের একই মঞ্চে পাশাপাশি আসনে বসে থাকা একই বৃন্তে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টানরূপী তিনটি কুসুমকে অপলকে দেখতে-থাকা মালাকার।
‘পাঠান’ এখনও দেখিনি। খুব গুঁতো না খেলে দেখবও না। কিন্তু এই শাহরুখ খানকে ভাল না বেসে পারি কী করে! সারা দেশ তাঁকে রোজ রোজ ঢালাও প্রেমপত্র লিখছে। বেশ করছে! আমিও না হয় লিখেই দিলাম একখান।
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy