আগরা শীর্ষবৈঠকে কাছ থেকে দেখেই মনে হয়েছিল, লোকটার মধ্যে একটা ক্যারিশমা আছে। একে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়া মানায়। মূল ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
লাগেজের ট্রলিটা ঠেলতে ঠেলতে সবে লাহোর বিমানবন্দরের টার্মিনাল বিল্ডিং থেকে বাইরে বেরিয়েছি। সুটকেসের উপরে রাখা হার্ড কভারের বইটা সড়াৎ করে পিছলে পড়ে গেল। পড়ল তো পড়ল, শান-বাঁধানো সিঁড়িতে ঠোক্কর খেতে খেতে চলেও গেল খানিকটা।
ট্রলির গড়ায়মান চাকা কোনও মতে আটকে যত ক্ষণে বইটা তুলতে গিয়েছি, তত ক্ষণে হাজির হয়ে গিয়েছেন ‘ইন্ডিয়ান সাহাফি’ (ভারতীয় সাংবাদিক)-কে তুলতে-আসা তরুণ গাড়িচালক। বীরেন্দ্র সহবাগের মতো দেখতে এবং তেমনই চালিয়ে খেলার মেজাজসম্পন্ন সেই যুবকের বক্তব্য পরিষ্কার— যত্ন করে তোলার দরকার নেই। বরং পারভেজ মুশারফের স্মৃতিকথনের পুঁথি মাটিতেই পড়ে থাকুক! কারণ, যিনি দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা এবং আমলাতন্ত্রকে ঝেঁটিয়ে সাফ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাঁর আমলে হু-হু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। বেড়েই চলেছে।
২০০৮ সাল। পাকিস্তানের ভোট কভার করতে গিয়েছি। ভারত থেকেই জেনে গিয়েছি, তাঁর আমলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লেও, বার্ষিক আর্থিক বৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশে (যা তার আগের তিন দশকে সর্বোচ্চ) পৌঁছলেও মুশারফের জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা কমতে শুরু করেছে। ২০০৭ সালের শেষে এক সমীক্ষা বলেছে, পাকিস্তানের ৬৪ শতাংশ নাগরিক চান, মুশারফ প্রেসিডেন্টের গদি ছাড়ুন। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে তখন তাঁর সংঘাত তীব্র। দেশের প্রধান বিচারপতিকে বরখাস্ত করেছেন। অন্য বিচারপতিদেরও যথেচ্ছ ধরপাকড় শুরু হয়েছে। লাল মসজিদে হয়েছে গুলির লড়াই। নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। পাকিস্তানের বাতাসে তখন নিত্য বারুদের গন্ধ। পাকিস্তানের ‘এলিট’ সমাজ এবং বিশিষ্টেরা খোলাখুলি মুশারফের বিরোধিতা শুরু করেছেন। ঘটনাচক্রে, তার দু’বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের প্রায় সাড়ে ৩০০ পাতার স্মৃতিকথা-কেন্দ্রিক আত্মজীবনী ‘ইন দ্য লাইন অফ ফায়ার: আ মেমোয়্যার’। যে বই সম্পর্কে বিলেতের নাকউঁচু কাগজও লিখেছিল, ‘দ্য বুক দ্য হোল ওয়ার্ল্ড ইজ় টকিং অ্যাবাউট’। পাঠক হিসেবে চিরকাল আত্মজীবনীতে আসক্ত। ফলে দ্রুত পড়ে ফেলেছিলাম। পাকিস্তানে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় আরও একবার ‘রিভাইজ়’ দেওয়া। কিন্তু লাহোরে নেমে প্রথম চোটেই মনে হল, বইয়ের জীবন রোমহর্ষক হতে পারে। কিন্তু মুশারফ পাকিস্তানে খলনায়ক হয়ে গিয়েছেন। টিআরপি হু-হু করে পড়ছে তাঁর। ঘটনাচক্রে, সেই ভোটের পর তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দিতে হয়েছিল। পাক পার্লামেন্টের ‘ইমপিচমেন্ট’ এড়াতে দেশ ছেড়ে লন্ডনে গিয়ে নিতে হয়েছিল স্বেচ্ছাবন্দিত্ব।
ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে দুবাইয়ের হাসপাতালে মুশারফের প্রয়াণের পর থেকে অবশ্য মনে হচ্ছিল, বড্ড নিরুচ্চারে চলে গেলেন তিনি। একদা যে দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ছিলেন, সেই দেশ তাঁর মৃত্যুতে কোনও আনুষ্ঠানিক শোকপ্রকাশ করল না। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রইল না। দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন— এই অভিযোগে পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্যরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধাটুকুও জানাতে চাইলেন না। দেশভাগের সময় ভারতের দিল্লি (অধুনা পুরনো দিল্লিতে তাঁদের বসতবাড়ির নাম ছিল ‘নহরওয়ালি হাভেলি’। ‘নহর’ অর্থাৎ, ‘খাল’। সেই খালের পাশের প্রাসাদ। মনে রাখবেন, ‘প্রাসাদ’। ২০০১ সালে ভারত সফরে এসে সেই প্রাসাদে গিয়েওছিলেন সস্ত্রীক মুশারফ) থেকে গিয়ে পাকিস্তানের যে শহরে বসত শুরু করেছিল তাঁর পরিবার, সেই করাচির গুলমোহর পোলো গ্রাউন্ডের মসজিদে পারিবারিক প্রার্থনার পর এক ফৌজি গোরস্থানে দীনহীন ভাবে এবং প্রায় নীরবে সমাধিস্থ করা হল তাঁকে।
যাঁর জীবনের অর্ধেকেরও বেশি কেটেছে থ্রিলারের মতো, শেষযাত্রায় এতটা অপমান, অপবাদ এবং উপেক্ষাও কি তাঁর প্রাপ্য ছিল? কে জানে! কিন্তু যতই নিশ্চুপে তিনি জীবন থেকে বিদায় নিয়ে থাকুন না কেন, এটা বার বার মনে হয় এবং হতেই থাকবে যে, পারভেজ মুশারফের মতো মস্তান সম্ভবত এই উপমহাদেশ আর দেখেনি।
কমান্ডো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফৌজি। দেশের সেনা এবং সমর সর্বাধিনায়ক থেকে একেবারে প্রেসিডেন্টের মসনদে। চার-চার বার জীবনঘাতী হামলা থেকে বেঁচেছেন। আকাশ থেকে নিজের বশংবদ সেনাবাহিনীকে দিয়ে গোটা বিমানবন্দরের দখল নিইয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারের বিরুদ্ধে বিনা রক্তপাতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। পর্যায়ক্রমে গোটা দেশের ক্ষমতা দখল করে বসেছেন। এ তো হিরো!
ভাগ্যদেবী বার বার এসে মাথায় ছাতা ধরেছেন তাঁর। নিজেও বলতেন, ‘‘বেড়ালের মতো আমারও ন’টা জীবন।’’ ছোটবেলায় ডানপিটেমো করতে গিয়ে আমগাছ থেকে হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে ঝুলছিলেন। ডাল ভেঙে সটান কঠিন জমিতে। সকলে ভেবেছিল, পতনের সেই অভিঘাতে মাথা-টাথা গুঁড়িয়ে মারাই গিয়েছেন। ভাগ্যদেবী ভাবেননি। তাঁর অন্য ‘এজেন্ডা’ ছিল। এ ছেলেকে ভবিষ্যতে দেশের ডাকাবুকো প্রেসিডেন্ট বানাতে হবে!
প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন রাওয়ালপিন্ডির সেনাছাউনিতে তাঁর বাসস্থানের অদূরে এক সেতুর উপর গাড়িসুদ্ধ তাঁকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য আরডিএক্স বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। একচুলের জন্য বেঁচে গিয়েছেন। ভাগ্যদেবী দাঁড়িয়ে থেকেছেন অদৃশ্য অবতারে। মেশিনগানের গুলি, গ্রেনেড এবং মিসাইল থেকে রক্ষাকারী মোটা ধাতব চাদরে মোড়া তাঁর তিন টন ওজনের মার্সিডিজ যখন কয়েকশো ফুট দূরত্বে বিস্ফোরণের চোপাটে মাটি ছেড়ে কয়েক ফুট হাওয়ায় উঠে গিয়েছে, তখনও তিনি অবিচল। ৪০০ মিটার দূরত্বে নিজের বাড়িতে পৌঁছে আগে খোঁজ নিয়েছেন, বৃদ্ধা মা জানেন কি না। তার পরে স্ত্রীকে বলেছেন। ইচ্ছে করেই সন্ধ্যায় সস্ত্রীক পূর্বনির্ধারিত বিয়ের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছেন। এটা দেখাতে যে, তিনি পালিয়ে যাননি। আর্মি হাউসের নিরাপত্তার আড়ালে লেজ গুটিয়ে বসে নেই। প্রাণঘাতী হামলা তাঁকে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে পারেনি।
তার দশ দিন পর আবার আত্মঘাতী হামলা হয়েছে তাঁর কনভয়ে। বিস্ফোরক-বোঝাই ভ্যান নিয়ে সরাসরি মুশারফের গাড়িতে ধাক্কা মারতে এসেছে আল কায়দা জঙ্গিরা। বিস্ফোরণে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের কাচ না ভাঙলেও তাতে চিড় ধরেছে। সবক’টা টায়ার ফেটে চৌচির। কিন্তু ভিতরে বসা মুশারফ টসকাননি। উল্টে কোমরবন্ধ থেকে সর্বক্ষণের সঙ্গী গ্লক অটোম্যাটিক পিস্তল বার করেছেন। অনুগত গাড়িচালক জান মহম্মদ সন্ত্রস্ত হয়ে ব্রেক কষেছেন। পিছনের সিট থেকে উদ্যত পিস্তল হাতে মুশারফ বলেছেন, ‘দাবা! দাবা!’ মানে, অ্যাক্সিলারেটরে আরও চাপ দে! গতি বাড়িয়ে দ্রুত বেরিয়ে চল! কয়েকশো ফুট যেতে না যেতে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ। আবার সজোরে ব্রেক কষেছেন জান মহম্মদ! আবার তাঁর প্রভু নির্দেশ দিয়েছেন, ‘দাবা! দাবা!’ তত ক্ষণে চারটে টায়ারের একটাও আর গাড়ির সঙ্গে লেগে নেই! স্রেফ ধাতব রিমের উপর ভর করে ঊর্ধ্বশ্বাসে গাড়ি ছুটিয়েছেন চালক। ম্যাস্টিক অ্যাসফল্টের রাস্তায় বিকট আওয়াজ তুলতে তুলতে চারটে রিমের উপর ঘষটাতে ঘষটাতে আর্মি হাউসে পৌঁছেছেন মুশারফ। মার্সিডিজের গায়ে অজস্র গুলির ফুটো। বুলেটনিরোধক কাচে চিড়। বিভিন্ন দিকে লেগে আছে টাটকা রক্ত আর মাংসের পিণ্ড। ঝুলছে ছিন্নভিন্ন মানবশরীরের অংশ। পোর্টিকোয় দৌড়ে এসেছেন স্ত্রী। তার পর হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো চিৎকার শুরু করেছেন। ধ্বংসস্তূপ থেকে নেমে ধ্বস্ত বেগমকে জড়িয়ে ধরে ভিতরের ঘরে নিয়ে গিয়েছেন মুশারফ। বলেছেন, ‘‘আমি ঠিক আছি! শান্ত হও।’’ বেরিয়ে শুনেছেন, সেই হামলায় ঘটনাস্থলেই ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের লেখাজোখা নেই। কিন্তু তাঁকে ছুঁতে পারেনি কেউ। কারণ, তাঁর জীবনের স্টিয়ারিংটি ধরা ছিল ভাগ্যদেবীর হাতে।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে হত্যার ঘটনায় পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘ফেরার’ ঘোষণা করেছে। দেশের এক বিশেষ আদালত তাঁর অনুপস্থিতিতে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। আবার সেই দেশেরই অন্য এক আদালত সেই দণ্ড খারিজ করেছে। ভাগ্যদেবী!
এই জীবনকাহিনি থ্রিলার নয়তো কী! কিন্তু সেই থ্রিলারের নায়ককে মৃত্যুর আগে গোটা একটা বছর কাটাতে হল ভিন্দেশের হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। দেহে অজস্র নল এবং মনে অবিরাম ক্ষত নিয়ে। তার আগে টানা পাঁচ-পাঁচটা বছর এক অদ্ভুত অসুখে ভুগে। এর চেয়ে কোনও গুপ্তঘাতক বা আত্মঘাতী বোমারু তাঁকে হত্যা করলে সম্ভবত অনেক বীরত্বব্যঞ্জক হত ইহলোক থেকে তাঁর বিদায়। মামুলি ‘প্রস্থান’ নয়। ‘মহাপ্রস্থান’ হত পারভেজ মুশারফের।
তাঁর নাম প্রথম শুনি ১৯৯৯ সালে। তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের আমন্ত্রণে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর ‘লাহোর বাসযাত্রা’ কভার করতে গিয়ে। তখন চারদিকে ভারত-পাক সম্পর্কে সুপবন বহিতেছে। আবেগের ওভারডোজ। অমৃতসর থেকে ‘সদা-ই-সরহদ’ (সীমান্তের ডাক) নামক ভলভো বাসে চড়ে ওয়াঘা সীমান্তে এসে নেমেছেন দেব আনন্দ, কপিল দেবরা। সেখানে তাঁদের ঘিরে ব্যান্ড পার্টি, নাচাগানা, আকাশে পুষ্পবৃষ্টিকারী হেলিকপ্টারের চক্কর। তূরীয় মেজাজ। পারলে তখনই কাঁটাতারের বর্ডার-টর্ডার তুলে দিয়ে একটা যৌথ ক্রিকেট টিম বানিয়ে ফেলে বিশ্বকাপটা নিয়ে আসে দুই ভাই। মাখো মাখো সেই বেরাদরির আবহে বাজপেয়ী-নওয়াজ একত্রে উগ্রপন্থা দমনের জন্য ‘লাহোর ঘোষণাপত্র’ সই করেছিলেন।
সেই মিঠে মলয়বাতাসেই লাহোর দুর্গে বাজপেয়ীর সম্মানে একটি নৈশভোজ দিয়েছিলেন নওয়াজ। দেখা গেল, সেই চুঁইয়ে-পড়া জ্যাবজ্যাবে সুসম্পর্কের চিটেগুড়ে আকৃষ্ট হননি পাকিস্তানের তিন বাহিনীর প্রধান। বাতাসে ভেসে এল, তাঁদের এই সিদ্ধান্তের পিছনে আসল মাথা নাকি পাক ফৌজের সুপ্রিম কমান্ডার। কে লোকটা? তখনই প্রথম নামটা শুনলাম— জেনারেল পারভেজ মুশারফ।
জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। বড় হওয়া করাচি এবং ইস্তানবুলে। লাহোরের কলেজে প্রথমে গণিতশাস্ত্র এবং তার পরে অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া। বিলেতে গিয়ে সমরশাস্ত্র অধ্যয়ন। পরিবারের অমতে ১৯৬১ সালে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগদান। ১৯৬৪ সালে পাক ফৌজের গোলন্দাজ বাহিনীতে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। সেই প্রথম সরাসরি যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। আশির দশকে পাক সেনার আর্টিলারি ব্রিগেডের কমান্ডার। নব্বইয়ের দশকে ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। অতঃপর ‘স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ’-এর কমান্ডার। ক্রমশ ডেপুটি মিলিটারি সেক্রেটারি এবং ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন্স। আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধে তালিবানদের পাক সমর্থনের মদতদাতা। ১৯৯৮ সালে মুশারফকে পাক ফৌজের সর্বাধিনায়ক পদে বসান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ। যে সর্বাধিনায়ক বাজপেয়ীর সম্মানে নৈশভোজে এলেনই না!
কেন আসেননি, তা জানা গেল সেই বছরের অগস্ট মাসে। যখন কার্গিল সংঘাত শুরু হল। যা লাহোর ঘোষণাপত্রের চরম পরিপন্থী! পাকিস্তানের তরফে বলার একটা মরিয়া চেষ্টা হয়েছিল যে, কার্গিলে যা হচ্ছে, তা কাশ্মীরি জঙ্গিগোষ্ঠীই করছে। কিন্তু পাক বাহিনীর (তথা তাদের সর্বাধিনায়কের) সক্রিয় ইন্ধন যে তার পিছনে ছিল এবং সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানি সেনা যে কার্গিলে ঢুকেছিল, তা প্রকাশ্যে আসতে দেরি হয়নি। যে কারণে ভারতবাসীর কাছে মুশারফ বরাবর ‘কার্গিলের খলনায়ক’ হয়েই থেকে যাবেন। সে তিনি যতই পরবর্তী কালে পাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে সার্ক শীর্ষবৈঠকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার পর পোডিয়াম থেকে নিজের আসনে ফেরত যাওয়ার আগে আচমকা একটা হাফ টার্ন নিয়ে মঞ্চে বসা বাজপেয়ীকে খানিকটা বিমূঢ় করে তাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সন্ত্রাসদমনে ‘সদর্থক’ বার্তা দিয়ে যান না কেন। অথবা ভাবীকাল কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছতে-পারা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করুক না কেন।
২০০২ সালের ওই বিখ্যাত করমর্দনের আগের বছর ২০০১ সালে আগরা শীর্ষবৈঠক ভেস্তে গিয়েছে। জুলাইয়ের মাঝবরাবর দু’দিনের সেই শীর্ষবৈঠককে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। ২০০৫ সালে ‘র’-এর প্রাক্তন প্রধান এএস দুলাট দাবি করবেন, শীর্ষবৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পিছনে বড় ভূমিকা ছিল তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীর। কিন্তু তত দিন পর্যন্ত জনপ্রিয় ধারণা ছিল, বৈঠক ভেস্তে যায় মুশারফের গোঁয়ার্তুমিতে! সেটা ভাবার কারণও ছিল। মধ্যরাতে বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পর অজমের শরিফ যাত্রা রাতারাতি বাতিল করে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ভারত ছেড়েছিলেন পাক প্রেসিডেন্ট। নাটকীয়!
আনন্দবাজার পত্রিকার হয়ে আগরা শীর্ষবৈঠক কভার করতে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম এবং শেষ মুশারফকে খুব কাছ থেকে দেখা। কথা হয়নি। হওয়ার প্রশ্নও ছিল না। কিন্তু লোকটাকে বেজায় স্মার্ট লেগেছিল।
মাথার একেবারে মাঝবরাবর সিঁথি। কানের কাছে কপালের দু’পাশের রগের কাছে চুল সম্ভবত ইচ্ছাকৃত ভাবেই সাদা ছেড়ে রাখা। বাকি অংশ বেগুনি। রং হতে পারে। মেহেন্দি বা হেনাও হতে পারে। রেশমের মতো সেই চুলে জুলাই বিকেলের রোদ্দুর পিছলে যেতে যেতে একটা বেগুনি ঝিলিক মেরে যাচ্ছিল। চোখে সোনালি ডাঁটির রিমলেস চশমা। যত্নে ছাঁটা গোঁফ। খানিক সানুনাসিক অথচ খরখরে গলা। কথা বলেন স্পষ্ট উচ্চারণে। ইংরেজিতে কোনও জড়তা নেই। হিন্দি এবং উর্দুতেও স্বচ্ছন্দ।
পোশাকে শৌখিনতার স্পষ্ট ছাপ। যেমন নির্ভুল ফৌজি ছাপ চলনবলনে। হাঁটেন মেরুদণ্ড সোজা রেখে। মাপা পদক্ষেপে। দেখলাম, পরনে স্যুট থাকুক বা শেরওয়ানি, যে কোনও অভিবাদনের জবাবে ডান হাতের তালুটা ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ডান ভুরুর কাছে উঠিয়ে কয়েক সেকেন্ড ধরে রেখে এক ঝটকায় হাতটা দেহের সমান্তরালে নীচে নামিয়ে আনেন। ওই স্যালুটটা চিরকাল মনে থাকবে। ওই কয়েক সেকেন্ড বলে দেয়, লোকটা আশরীর ফৌজি। এতটাই যে, মনে মনেও সব সময় উর্দিটা পরে থাকে।
শ’য়ে শ’য়ে ক্যামেরার ফ্রেমের মুখোমুখি বেগমকে নিয়ে তাজমহলের সামনে ‘লাভার্স বেঞ্চ’-এ গিয়ে যখন বসলেন, তখনও ভেটকে বসে সাধারণ গ্রুপ ফটো তোলার মতো দু’হাঁটুতে হাত রাখলেন না। বসলেন একটু তেরছে। যাতে ক্যামেরার অমিত শক্তিশালী লেন্সও সাইড প্রোফাইলে প্রাক্তন কমান্ডোর ঈষৎ বর্তুলাকার মধ্যপ্রদেশ ধরতে না পারে।
দেখেই মনে হয়েছিল, লোকটার মধ্যে একটা ক্যারিশমা আছে। একে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়া মানায়। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এর কলম্বো থেকে ছেড়ে-আসা উড়ানকে করাচি বিমানবন্দরে নামতে না দেওয়ার নির্দেশ দেন এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের মারফত (আর মাত্র সাত মিনিট ওড়ার মতো জ্বালানি ছিল বিমানে), তখন মাঝ আকাশ থেকে এরই অঙ্গুলিহেলনে আস্ত একটা সেনাবাহিনী বিমানবন্দরের দখল নিয়ে নিতে পারে। তার পর নির্দেশপ্রদানকারী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিনা রক্তপাতে একটা সামরিক অভ্যুত্থান করিয়ে গোটা দেশের শাসনভার নিজের হাতে নিয়ে নিতে পারে। ১৯৯৯ সালের সেই অভ্যুত্থানের দু’বছর পরে ২০০১ সালে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে বসতে পারে। এবং সেই শাসন টানা সাতটা বছর চালাতে পারে। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রকারী’ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে গৃহবন্দি রেখে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চালু করতে পারে। এই লোকটাই কোমরে গ্লক অটোম্যাটিক রাখতে পারে। এই রংদার লোকটাই পোষা কুকুরের নাম রাখতে পারে ‘হুইস্কি’।
ফৌজি পরিচয়কে বিসর্জন দিয়ে ২০১০ সালে নিজের রাজনৈতিক দল শুরু করেছিলেন মুশারফ। বলেছিলেন, ২০১৩ সালে ভোটে অংশ নিয়ে আবার দেশের প্রেসিডেন্ট হতে চান। ফিরেওছিলেন। সে ফেরাও ছিল পুরোপুরি মুশারফ-সুলভ। এমিরেটসের চাটার্ড বিমানে পাকিস্তানি এবং বিদেশি সাংবাদিকদের বহর নিয়ে করাচির জিন্না আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছিলেন তিনি। দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সামনে ছোটখাটো একটা বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। আশা করেছিলেন, আবার শুরু করবেন মূলস্রোতের রাজনীতির আকাশে তাঁর উড়ান।
কিন্তু ততদিনে ভাগ্যদেবী তাঁর হাত ছেড়ে গিয়েছেন। দেশের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল রায় দেয়, মুশারফ ভোটে লড়তে পারবেন না। তার দু’দিনের মধ্যে ইসলামাবাদ হাই কোর্ট তাঁকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেয়। রায় শোনার পর অনুগত নিরাপত্তারক্ষীদের আড়ালে আদালত থেকে সটকে পড়েছিলেন প্রাক্তন কমান্ডো। গিয়ে উঠেছিলেন তাঁর ফার্ম হাউসে। সেখানেই তাঁকে গৃহবন্দি করে পাক সরকার। পরদিন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ইসলামাবাদ পুলিশের সদর দফতরে। পাক পার্লামেন্টের সেনেট তাঁর বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগ এনে প্রস্তাব পাস করায়।
কয়েক মাস পরে পাকিস্তানের একটি আদালত থেকে জামিন পান মুশারফ। ২০১৬ সালে তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রার অনুমতি দেওয়া হয়। মুশারফ যান দুবাই। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে পাকিস্তানে ফিরবেন, এমনই দাবি করতেন তাঁর অনুচরেরা। ফিরলেনও। কিন্তু কফিনবন্দি হয়ে। উপেক্ষিত হয়ে। আগুন নিভে গিয়েছে।
পারভেজ মুশারফের ইন্তেকাল দেখতে দেখতে ১৫ বছর আগের লাহোর বিমানবন্দরের দৃশ্যটা মনে পড়ে গেল। ভিন্দেশি সাংবাদিকের লাগেজ ট্রলিতে রাখা সুটকেসের উপর থেকে হড়কে পড়ে যাচ্ছে ‘ইন দ্য লাইন অফ ফায়ার’।
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy