Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
স্বাস্থ্য পরিষেবার বিপজ্জনক দিক যখন বেরিয়ে আসছে
RG Kar Medical College and Hospital Incident

কেন এত দেরি

এই আন্দোলনের জেরে রাজ্যের সামগ্রিক স্বাস্থ্য-প্রশাসন ও পরিষেবার যে সব অন্ধকার, বিপজ্জনক দিক বেরিয়ে আসছে, তাকে শুধু ভয়াবহ বললে কিছুই বলা হয় না।

শাসক: আর জি কর আন্দোলনের শেষ পর্বে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪ সেপ্টেম্বর।

শাসক: আর জি কর আন্দোলনের শেষ পর্বে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ১৪ সেপ্টেম্বর। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৬:৫১
Share: Save:

অবশেষে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রায় সব দাবিই মেনে নিল সরকার। আর জি কর-কলঙ্কের পর থেকে টানা মাস দেড়েক রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা যে-ভাবে কর্মবিরতির এই আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন, সেটা তাঁদের সংহতি ও দৃঢ়তার পরিচয়। অন্য দিকে, সরকারের তরফে বিভিন্ন দাবি মানার মধ্যে স্পষ্ট হয় যে, সেগুলি নেহাত অসঙ্গত ছিল না।

বস্তুত এই আন্দোলনের জেরে রাজ্যের সামগ্রিক স্বাস্থ্য-প্রশাসন ও পরিষেবার যে সব অন্ধকার, বিপজ্জনক দিক বেরিয়ে আসছে, তাকে শুধু ভয়াবহ বললে কিছুই বলা হয় না। আর জি করের ধর্ষিতা, মৃতা চিকিৎসক-পড়ুয়াটি নিজের জীবনের বিনিময়ে আমাদের এটাও জানিয়ে দিয়ে গেলেন, রাজ্যবাসী ক্রমশ এমন একটি স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার ‘শিকার’ হয়ে পড়ছেন, যেখানে টাটকা এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তারবাবুদের ‘শিক্ষা’র উপর আস্থা রাখা যে কোনও সময় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। আর সমস্যাটি রোগীর বাঁচা-মরার।

এই প্রসঙ্গে আরও আলোচনার আগে বলা দরকার, লাগাতার আন্দোলনে রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবা যথেষ্ট ধাক্কা খেয়েছে। অসংখ্য রোগী নাকাল হয়েছেন। কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এগুলি দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু দেখা গেল, যে লক্ষ্যে এই আন্দোলন, বৃহত্তর নাগরিক সমাজ তাকেই সমর্থন জুগিয়েছে। অর্থাৎ, প্রতিবাদী চিকিৎসকদের দাবি এবং সমাজের চাহিদা একই বিন্দুতে পৌঁছে কার্যত একাকার। এ বার আংশিক কর্মবিরতির পর্বটুকু যত দ্রুত মেটে, ততই ভাল।

জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন-মঞ্চে সরাসরি কোনও রাজনৈতিক রং চোখে পড়েনি। যদিও বিভিন্ন স্তরের এমন কিছু পরিচিত মুখ আন্দোলনকারীদের পক্ষে সক্রিয়, যাঁদের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা অজানা নয়। তথাপি এই আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতির রং দিতে আপত্তি করা হয়েছে, সেটাই সাধারণের নজরে এঁদের অন্যতম প্লাস পয়েন্ট!

কিন্তু বলতেই হবে, কমবয়সি যে চিকিৎসকেরা এই আন্দোলনের ঘোষিত পরিচালক, দাবি ‘উসুল’ করে নিতে তাঁরা যে কোনও দুঁদে রাজনীতিকের থেকে কিছু কম নন! যে ভাবে তাঁরা ‘রাষ্ট্রশক্তি’-র সঙ্গে টানা স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে গেলেন, সেই মানসিকতা এবং কায়দাকানুনও রাতারাতি রপ্ত করা যায় না। সত্যি বলতে, এর জন্য ‘রাজনীতি’র পাঠ শেখা চাই। মনে হয়, এ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।

আলোচনার টেবিলে নিজের চাহিদা আদায় করে নেওয়ার ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মুনশিয়ানা’ সুবিদিত। নরমে-গরমে, কখনও বা আদরে-আবদারে মমতা বহু সময় বহু গুরুতর দর-কষাকষিতে ‘সফল’ হতে পেরেছেন। এটা তাঁর এক প্রকার ‘ইউএসপি’ বলা চলে। এ বার ছবি আলাদা।

এখানে জুনিয়র ডাক্তারেরা প্রতিটি শর্ত নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে দিনের পর দিন টানাপড়েন চালিয়ে গেলেন। বার বার ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে আলোচনার অপেক্ষায় বসিয়ে রাখলেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদের অধিকাংশ দাবি আদায় করে নিলেন। এতেই শেষ নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এক ওজনদার নেত্রী তাঁদের ‘বাবা-বাছা, লক্ষ্মী সোনা ভাই’ ইত্যাদি সম্ভাষণ করছেন এবং প্রত্যুত্তরে তাঁরা, বলতে গেলে, সেটা প্রত্যাখ্যান করে চলে যাচ্ছেন— এই সব দৃশ্যও পর্যবেক্ষকদের ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে।

অনেকেরই ধারণা, পরিস্থিতি অনুযায়ী ‘উপযুক্ত’ পদক্ষেপ করতে সরকারের দেরি হয়েছে বলেই আন্দোলনের মেজাজ এই ভাবে চড়ে যায়। এ কথা ঠিক, জ্যোতি বসুর মতো পুলিশ দিয়ে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের লাঠিপেটা করার পথে মমতা যাননি। আবার উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথের অনুকরণে ‘এসমা’ জারি করে চিকিৎসকদের উপর চাকরি বাঁচানোর চাপ সৃষ্টিও তিনি করেননি। বরং বলেছেন, ও-সব দমনপীড়ন তাঁর ‘নীতি’ নয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, শাসক সিদ্ধান্তগ্রহণে সময়মতো তৎপর এবং দৃঢ় হতে পেরেছিলেন।

ঘটনা হল, মমতা এত দিন ধরে যে-ভাবে নিজের ভাবমূর্তি গড়তে চেয়েছেন, তাতে লোকচক্ষে তাঁর আবেগ ও আন্তরিকতার একটি বড় পরিসর তৈরি হয়েছে। অথচ এ বার আর জি কর-কাণ্ডের পরে তাতে কিছু ফাঁক নিদারুণ ভাবে চোখে লাগছিল। নিন্দকেরা যা-ই বলুন, ‘বাবা-বাছা-লক্ষ্মী-সোনা’ বলা, বৃষ্টির মধ্যে ছাতা এগিয়ে দেওয়া ইত্যাদির মধ্যে মমতার নিজস্ব একটি নির্মাণ আছে। যেটা তাঁকে নিবিড় জনসংযোগের ‘সুফল’ দিয়ে থাকে। অধিকাংশ মানুষ তাঁকে এ ভাবেই দেখতে অভ্যস্ত।

তাই ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী যদি ক্ষুব্ধ পড়ুয়াদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন, তাঁদের রাগ-দুঃখ-অভিযোগ বলার সুযোগ দিতেন, উত্তাপ অবশ্যই অনেকটা প্রশমিত হত। একই ভাবে ঘটনার অভিঘাত বিবেচনা করে সন্দীপ ঘোষ নামক নরকীটকে এবং পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে দ্রুততার সঙ্গে তাঁদের পদ থেকে নামিয়ে দেওয়াও অত্যন্ত জরুরি ছিল। জটিলতা তাতেও খানিক কমে যেত। শাসকের দোলাচলকে ‘বিলম্বিত বোধোদয়’ বলে কটাক্ষ করার পরিস্থিতিও তৈরি হত না।

সন্দীপকে অন্য হাসপাতালে পুনর্বাসন দিতে চাওয়া এবং বিনীতকে বহাল রাখার সিদ্ধান্তগুলি যে বাস্তবোচিত হচ্ছে না, মমতার মতো বিচক্ষণ রাজনীতিকের সেটা বুঝতে দেরি হবে কেন? জানা নেই। তবে এক সূত্রে শুনেছি, ঘটনার পরেই নাকি অধ্যক্ষ, সুপার, বিভাগীয় প্রধানের ভূমিকা, কাজের দায়িত্ব, এক্তিয়ার বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে তথাকথিত ‘নির্ভরযোগ্য’ মহল থেকে নানা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে নাকি ‘বোঝানো’ হয়েছিল, হাসপাতালে এমন কিছু হলে তার দায় অধ্যক্ষের নয়! তিনি শুধু ‘শিক্ষা’ সংক্রান্ত বিষয় দেখেন!

বলা হয়েছিল, সন্দীপকে আর জি কর থেকে সরিয়ে দিলেই নাকি পড়ুয়াদের ক্ষোভ প্রশমিত হবে! এখন বোঝা যায়, সবটাই ছিল সন্দীপকে আড়াল করার অপচেষ্টা। সন্দীপ জালে পড়লে স্বাস্থ্য-প্রশাসনের ভিতরের পাঁক আপাদমস্তক ছড়াবে, তখন কোনও ‘মেঘনাদ’ বা কারও কোনও অনুচর পার পাবে না— যে ‘পাপচক্র’ এর পিছনে কাজ করেছিল, সন্দীপের ‘পদত্যাগের ইচ্ছাপ্রকাশ’ও ছিল তাদেরই মস্তিষ্কপ্রসূত ছক। মুখ্যমন্ত্রী যাতে ‘উত্তপ্ত’ পরিস্থিতিতে না যান, তেমন ‘পরামর্শ’ তাঁর কানে পৌঁছে দিতেও দেরি হয়নি। মমতা নিজের বিচারবুদ্ধিতে চললে সম্মান এবং সঙ্কট দুটোই সামলানো সহজ হয়ে যেত।

অনুরূপ ঘটনা বিনীতকে নিয়েও। আজ পরিষ্কার, পুলিশ প্রথম থেকে ঘটনাটিকে ঘেঁটে দিতে যথাসম্ভব সক্রিয়তা দেখিয়েছে। বার বার সেখানে গিয়েও কমিশনার তা ‘আঁচ’ করতে পারেননি— যেটা তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে সন্দেহের উদ্রেক করে। মধ্যরাতের তাণ্ডবে পুলিশের লেজেগোবরে অবস্থা তো বলা বাহুল্য। সেই বিনীত সরলেন, তবে আন্দোলনকারীদের ‘শর্ত’-এ!

এটা ঘটনার প্রকাশ্য দিক। ফিরে যাই সেই জীবন-মরণের প্রশ্নে। দাস-ঘোষ মার্কা গ্যাং স্বাস্থ্য-প্রশাসন এবং শিক্ষাকে যে ভাবে কুরে কুরে খেয়েছে, তার নিট ফল, বাজারে এক শ্রেণির অদক্ষ, অল্পশিক্ষিত ডাক্তার ছড়িয়ে দেওয়া। যাঁরা হুমকি-প্রথা বা থ্রেট-কালচারের বরপুত্র! এঁরা কার্যত পড়েননি, শেখেননি, জানেননি। টাকা খাইয়ে বা তথাকথিত ‘লবি’ ধরে পরীক্ষার খাতায় উত্তর টুকলি করে এঁরা এমবিবিএস!

শিক্ষা-দুর্নীতির ‘সুবাদ’-এ অযোগ্য শিক্ষকের হাতে আগামী দিনের ছাত্ররা ‘পড়বেন’! আর হুমকি-প্রথার প্রসাদে এ বার আমার-আপনার চিকিৎসা করবেন এক দল অপশিক্ষিত ‘ডাক্তারবাবু’! তাঁদের সংখ্যা কত, ধরার কোনও পদ্ধতি নেই। এ সব খুঁটিনাটি শীর্ষশাসক না-ও জানতে পারেন, কিন্তু এক বার জানা হয়ে গেলে, যাঁরা এ কাজ করেছেন, এবং যাঁরা এই পাপ সয়েছেন, সেই গণশত্রুদের চেনা সহজ। তাঁদের শাস্তি দেওয়া শাসকের আশু কর্তব্য।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy