বছর দশেক আগে স্লোগান ছিল ‘পরিবর্তন’। এ বার শোনা যাচ্ছে ‘আসল পরিবর্তন’। পরিবর্তন ভাল বা মন্দ, দু’দিকেই হতে পারে। তাই প্রশ্ন হল, পরিবর্তনের মাপকাঠি কী, এবং কোন অর্থে সেই পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ? পরিসংখ্যান কী বলে? অর্থনৈতিক দিক থেকে রাজ্যের গত দশ বছরের পরিস্থিতি তার আগের জমানার সঙ্গে, এবং গোটা দেশের নিরিখে বিচার করলে কী দেখা যাবে?
কতটা পরিবর্তন হয়েছে, এবং তা ভাল না মন্দের দিকে, তা বুঝতে পরিবর্তনের সূচক কী, আর মাপকাঠি হিসেবে কার সঙ্গে তুলনা করা হবে— অর্থাৎ পরিবর্তনের নিক্তিটা কী— সেটাও ভাবতে হবে। সীমিত পরিসরের কারণে এখানে যে তিনটি সূচকের মধ্যে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব, সেগুলো হল— এক, রাজ্যের মাথাপিছু বা গড় আয় (যা জাতীয় আয় পরিসংখ্যান থেকে বার্ষিক ভিত্তিতে পাওয়া যায়); দুই, মাথাপিছু পারিবারিক ব্যয় (যা জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা কিছু বছর অন্তর সংগ্রহ করে); এবং তিন, এর ভিত্তিতে গণনা করা দারিদ্ররেখার নীচে থাকা জনসংখ্যার অনুপাত। প্রথম দু’টির ক্ষেত্রে আমরা মূল্যস্ফীতির প্রভাব সরিয়ে এদের প্রকৃত বৃদ্ধির হার দেখব। আমরা পশ্চিমবঙ্গের গত এক দশকের পরিস্থিতির সঙ্গে তার আগের, অর্থাৎ বামফ্রন্ট জমানার তুলনা করতে পারি। কিন্তু গোটা দেশের পরিস্থিতি গত এক দশকে এবং তার আগে কী রকম ছিল, সেটা না জানলে তুলনাটা ঠিক হবে না। কারণ, কিছু এমন উপাদান আছে (যেমন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম), যা সময়ের সঙ্গে পাল্টায়, এবং গোটা দেশেই তাদের প্রভাব পড়ে।
আবার, যে কোনও সময়সীমার মধ্যে আমরা রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে গোটা দেশের গড় পরিস্থিতির তুলনা করতে পারি। কিন্তু কিছু উপাদান থাকতে পারে, যা আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে সব জমানাতেই বিদ্যমান, তাই শুধু গত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গ ও সমগ্র ভারতের তুলনা করলে পক্ষপাতের সম্ভাবনা থেকে যাবে। অর্থাৎ, আগের জমানাতেও রাজ্য ও দেশের আপেক্ষিক পরিস্থিতি কী ছিল, সেটা দেখতে হবে এবং তার সঙ্গে তুলনা করতে হবে। ধরুন, কোনও স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা কোনও নিৰ্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কেমন উন্নতি করছে, সেটা জানতে চাই। শুধু সময়ের ব্যবধানে কতটা উন্নতি হয়েছে, সেটা দেখলে সমস্যা হল যে, হয়তো দেখব উন্নতি হয়েছে, কিন্তু অন্য সব স্কুলেও হয়তো উন্নতি হচ্ছে। আবার, শুধু অন্য স্কুলের সঙ্গে তুলনা করার সমস্যা হল: হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই স্কুলটি বেশি উন্নতি করেছে, যা শুধু বর্তমান সময়সীমার মধ্যে তুলনায় ধরা পড়বে না।
আমরা যদি মাথাপিছু জাতীয় আয়ের গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হার দেখি, তা হলে দেখব যে, নব্বইয়ের দশকে রাজ্যের বৃদ্ধির হার (৫.৫%) দেশের গড় বৃদ্ধির হারের (৪.৬%) চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু তার পরের দুই দশকেই রাজ্যের বৃদ্ধির হার দেশের গড় বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম— অর্থাৎ, তুলনামূলক ভাবে পশ্চিমবঙ্গ সারা দেশের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে রাজ্যের গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৮%, আর সারা দেশের ক্ষেত্রে তা ছিল ৫.৫%। ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে রাজ্য ও দেশের গড় বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৪.২% এবং ৫.২%। অর্থাৎ, গত এক দশকে রাজ্যের আপেক্ষিক বৃদ্ধির হার দেশের তুলনায় এবং তার আগের দুই দশকের তুলনায় কমেছে। কিন্তু, একই সঙ্গে লক্ষণীয় যে, দেশের সার্বিক বৃদ্ধির হারও এই দশকে তার আগের দশকের তুলনায় কমেছে।
মাথাপিছু পারিবারিক ব্যয়ের বৃদ্ধির হার যদি দেখি? খেয়াল রাখতে হবে যে, এই সমীক্ষা প্রতি বছর হয় না। ২০১১-১২ সালের পরে একটাই বছরের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে— ২০১৭-১৮। গত দুই দশকের মধ্যে যদি তুলনা করি, রাজ্যের নগরাঞ্চলে মাথাপিছু ব্যয়ের বৃদ্ধির হার একই থেকেছে (৩.৮%)। শুধু তা-ই নয়, ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে রাজ্যের আর দেশের মধ্যে এই বৃদ্ধির হারে তফাত নেই, কিন্তু গত এক দশকে রাজ্যের ব্যয় বৃদ্ধির হার (৩.৮%) দেশের ব্যয় বৃদ্ধির হারের (৪.৭%) তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে। নগরাঞ্চলে যে হেতু অর্থনৈতিক সুযোগের বিস্তার বেশি, ব্যয়ের বৃদ্ধির হারের এই ছবিটি আয়ের বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু পারিবারিক ব্যয়ের বৃদ্ধির হার যদি দেখি, ছবিটি সম্পূর্ণ পাল্টে যাচ্ছে। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে রাজ্যে এই বৃদ্ধির হার (২.৪%) সারা দেশের বৃদ্ধির হারের (৩.২%) তুলনায় কম ছিল। গত দশ বছরে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে এই ব্যয় বৃদ্ধির হার (৫%) সারা দেশের গ্রামাঞ্চলে বৃদ্ধির হারের (৩%) চেেয় উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি।
এর প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে দারিদ্ররেখার নীচে থাকা জনসংখ্যার অংশের পরিসংখ্যানে— গত দুই দশকেই এই রাজ্য দারিদ্র হ্রাসের ক্ষেত্রে সমগ্র দেশের তুলনায় সফলতর। ২০০০ সালের সঙ্গে ২০১১-র যদি তুলনা করি, রাজ্যে দারিদ্ররেখার নীচে থাকা মানুষের অনুপাত কমে ২৭% থেকে ২০% হয়েছে। আর সর্বশেষ যে বছরের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, অর্থাৎ ২০১৮ সালে, রাজ্যে দারিদ্ররেখার নীচে থাকা মানুষের অনুপাত কমে ১৪% হয়েছে। সমগ্র দেশের সঙ্গে যদি তুলনা করি, ২০০০ সাল থেকে ২০১১-র সময়কালে এই অনুপাত ২৬% থেকে কমে ২২% হয়েছে। আর ২০১৮ সালে দারিদ্ররেখার নীচে থাকা মানুষের অনুপাত কিঞ্চিৎ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২.৮%। অর্থাৎ, গত দুই দশকে দারিদ্র হ্রাসে পশ্চিমবঙ্গের সাফল্য একই রকম হলেও, সারা দেশের তুলনায় তার সাফল্য অধিকতর, এবং তা খুব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে গত এক দশকে।
পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখলে, যে মাপকাঠিগুলি আমরা দেখলাম, তাতে গত এক দশকে তার আগের দশকের তুলনায় পরিবর্তনের খুব একটা উল্লেখযোগ্য প্রমাণ নেই, একটি ব্যতিক্রম ছাড়া— গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু পারিবারিক ব্যয় বৃদ্ধির হার এই রাজ্যেরই আগের দশকের এবং গত এক দশকে দেশের গড়পড়তা বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। এর পিছনে সরকারের নানা অনুদানমূলক প্রকল্পের (কন্যাশ্রী, কৃষক বন্ধু, যুবশ্রী ইত্যাদি) ভূমিকা থাকা সম্ভব। একই সঙ্গে আয়ের বৃদ্ধিতে রাজ্যের পরিস্থিতি গত দুই দশকে খুব একটা পাল্টায়নি, এবং সারা দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ খানিকটা পিছিয়ে আছে। এর প্রভাব কর্মসংস্থানের উপর পড়তে বাধ্য। তাই উন্নয়নের বদলে খয়রাতির রাজনীতি বলে যে সমালোচনা শোনা যায়, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নয়।
শুধু যদি অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে বিচার করি, তা হলে রাজ্যের অবস্থা এই জমানায় বা তার আগের জমানায় যা-ই হয়ে থাকুক না কেন— গত সাত বছরে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের অর্থনৈতিক রেকর্ডের ভিত্তিতে সে দলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেলের উপর ভরসা করা মুশকিল। কোভিড-১৯ সঙ্কট শুরু হওয়ার আগের কয়েক বছর থেকেই মোদী জমানায় সারা দেশের সার্বিক বৃদ্ধির হার ক্রমহ্রাসমান এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে দারিদ্র হ্রাস তো দূরের কথা, নানা সূত্র থেকে সঙ্কটের চিহ্ন অনস্বীকার্য।
শেষ বিচারে পরিসংখ্যান নয়, ভোটারদের কাছে পরিবর্তনের উপলব্ধি এবং প্রত্যাশা বড় ভূমিকা পালন করে। ভোটারদের সিদ্ধান্তে অনেকগুলো উপাদানের ভূমিকা থাকে, যার মধ্যে আছে দলীয় আনুগত্য এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রতি মনোভাব— সে বিক্ষোভই হোক, বা সন্তোষ। নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা অনুমান করা অসম্ভব— কিন্তু দু’টি উপাদান বড় ভূমিকা নেবে বলেই মনে হয়।
প্রথমটা হল, তৃণমূলের দশ বছরের শাসনকালে যে পরিবর্তন হয়েছে, সামগ্রিক ভাবে মানুষ তার অভিমুখ সম্বন্ধে কী মনে করছেন। গ্রামীণ বাংলায় এক ধরনের জনমুখী প্রকল্পের প্রসার ঘটেছে, গ্রামীণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা খানিক হলেও বেড়েছে— এই ধরনের পরিবর্তনকে রাজ্যের মানুষ বেশি গুরুত্ব দিয়ে পরিবর্তনকে ‘ভাল’ মনে করছেন, না কি দুর্নীতি, প্রশাসনিক অব্যবস্থা, রাজনৈতিক নিপীড়ন ইত্যাদির কারণে ‘মন্দ’ ভাবছেন। অন্যটি হল, বিজেপি কী বিকল্পের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের অনুজ্জ্বল অর্থনৈতিক রেকর্ডের ভিত্তিতে সেই প্রতিশ্রুতি ভোটারদের কতটা আকর্ষণ করবে, উন্নয়নের আর পরিচিতি-সত্তাভিত্তিক বিভাজনের রাজনীতির আপেক্ষিক ভূমিকা কত বড় হবে।
অর্থনীতি বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy