যে নেকড়ে বাঘটা মেষশাবককে বলেছিল, “তুই না হলে নিশ্চয়ই তোর বাপ জল ঘোলা করেছিল”— তাকে তো আমরা যুগ যুগ ধরে কত গালিই দিলাম। কিন্তু যে বাঘটা আমাদের মধ্যে ঢুকে বসে আছে, তাকে তাড়াতে পারলাম না। বাঘটা প্রায়ই বেরিয়ে আসে, আঁচড়ে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে স্রেফ বীরত্ব দেখাবার অছিলায়। তবে কালে কালে বাঘেরও কিছু বদল হয়েছে; আধুনিক বাঘেরা আচরণে কিছুটা শিয়ালধর্মী, এক জন শুরু করলে চার দিক থেকে অন্যেরা সমস্বরে ধুয়ো ধরে। এই সমবেত উত্ত্যক্ত করাকে ডিজিটাল পরিভাষায় বলা হয় ‘ট্রোলিং’ এবং এই ধারার ধারক ও বাহকদের বলা হয় ‘ট্রোল’।
এখানে বাঘ বা শিয়াল কোনও শব্দই বীরত্ব বা ভীরুত্বব্যঞ্জক নয়, শুধুই আচরণগত কিছুটা সাদৃশ্যবাচক। যে কোনও বিতর্কিত ঘটনার ক্ষেত্রে এক পক্ষকে সমর্থন করে বিপক্ষকে দুটো কথা শোনানো মানুষের প্রায় একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে পড়ে। কিন্তু সেই সূত্র ধরে যখন দলবদ্ধ ভাবে এক জনকে আক্রমণ করা হয় এবং শালীনতার সীমা পেরিয়ে সেই ব্যক্তির বা তার পরিবারের প্রতিও অপমান, উপহাস, এমনকি ঘৃণা ছড়িয়ে আক্রমণকারীরা চূড়ান্ত উল্লাস প্রকাশ করে, তখন তাকে ট্রোলিং ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। অর্থাৎ, এক কালে যা ছিল ‘টিজ়িং’ বা ‘বুলিং’ আন্তর্জালক্রমে তাই হয়েছে ট্রোলিং, যা প্রতিবাদের ছদ্মবেশে আসলে কাউকে অপমান করার রীতি। একে অনায়াসেই একটি সামাজিক ব্যাধি বলা যায়।
হ্যাঁ, ট্রোলিংকে ‘পিছনে লাগা’ বলা আর ভাঙচুর-বোমাবাজিকে দুষ্টু ছেলের দুষ্টুমি বলা একই পর্যায়ের লঘুকরণ। কারণ ট্রোলিং এক ধরনের (ডিজিটাল) নৃশংসতা, যা এক জন ব্যক্তির সামাজিক সম্মানকে হত্যা করে উল্লসিত হয়। একে বরং তুলনা করা যায় গণহিংসার সঙ্গে, যেখানে অপরাধের আগে অপরাধী নির্দিষ্ট হয়ে যায় এবং মানুষ নিজের সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়। আন্তর্জাল এবং ডিজিটাল মাধ্যমে আমরা যতই জড়িয়ে পড়ছি, এই প্রবণতা ততই ছড়িয়ে পড়ছে।
এর পিছনে কারণ অনেক। প্রথমত, সমাজমাধ্যমে আমাদের অনায়াস যাতায়াত যে কোনও বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকারকে সহজ ও শক্তিশালী করে তুলেছে। আমরা যে ভাবে চায়ের দোকানে বা রকের আড্ডায় মতামত দিতাম বা দিই, তার চেয়ে অনেক সহজে স্মার্টফোনের বোতাম টিপে অনেক বিষয়ে মন্তব্য ছুড়ে দিতে পারি।
দ্বিতীয়ত, এই মন্তব্য একমুখী এবং অনেক সময়েই নিজের পরিচয় গোপন রেখে দেওয়াও সম্ভব। ফলে যা খুশি বলে দেওয়া যায়, কারও মুখোমুখি হতে হয় না বলে চক্ষুলজ্জার বাধাটুকুও থাকে না। নেহাত বেকায়দায় পড়লে চুপ করে গেলেই হল। ক্ষেত্রবিশেষে মন্তব্য উড়িয়ে দেওয়াও সম্ভব, যে জন্য বিন্দুমাত্র দায়িত্ব না নিয়েও যে কোনও আলোচনায় ঢুকে পড়ে মতামত দেওয়া যায়।
তৃতীয়ত, দলবদ্ধ ভাবে ঘটানোর কারণে যে কোনও ভুল মতামত বা কুৎসিত মন্তব্যের দরুনও অপরাধবোধ হয় ন্যূনতম; বরং একটা সফল ট্রোলিং থেকে একটা দলবদ্ধ আমোদ আর একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার ‘কম্বো-এনজয়মেন্ট অফার’ পাওয়া যায়। এই দলবদ্ধ মন্তব্য যদি হয় কোনও ব্যক্তি মানুষের উদ্দেশে, তা হলে তার প্রভাব সরাসরি মানুষটির কাছে পৌঁছতে পারে। কারণ, আন্তর্জালের কল্যাণে এখন প্রায় সকলেরই একটা জানলা সমাজমাধ্যমের দিকে খোলা থাকে। সেই জানলা দিয়ে তাকে ‘হাতে পাওয়া’ ট্রোলবাহিনীর পক্ষে সহজ হয়। অন্যথায় যাকে গালাগাল দেওয়া হচ্ছে সে যদি না-ই শুনল, তা হলে তো অর্ধেক মজাই মাটি।
মনে আছে ঠিক দু’বছর আগে, করোনার একেবারে প্রথম ধাপে এই শহরের একটি প্রবাসী তরুণ করোনাক্রান্ত হয়ে দেশে ফিরেছিলেন। সংবাদমাধ্যম তাঁর নামটি (মাত্র) গোপন রেখে অন্যান্য তথ্য জানিয়েছিল সবিস্তারে। তৎক্ষণাৎ ট্রোলবাহিনী তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছিল; কিছু না জেনেই তারা ছেলেটিকে ‘বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে’ বলে সাব্যস্ত করে বিভিন্ন সূত্র থেকে ছেলেটির ও তার মায়ের নাম ও ছবি খুঁজে বার করে সমাজমাধ্যমে প্রচার করে তাঁদের প্রতি গালাগালির বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। অথচ, কেউ জানতই না তাঁদের কী অপরাধ, তাঁদের থেকে আদৌ কারও সংক্রমণ ছড়িয়েছে— এমন প্রমাণ ছিল কি না।
এই তো, কিছু দিন আগে এক কবির বিরুদ্ধে কুম্ভিলকের অভিযোগ আনলেন এক গল্পকার, ট্রোলবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল কবির উপর। কারণ, তাঁর পরিচিতি বেশি। তাঁকে অপমান করে আমোদও তাই বেশি। ফলে কবির প্রোফাইল ‘চোর’ সুভাষণে এবং ‘চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা’ ইত্যাদি সদুপদেশে ভাসিয়ে দিলেন সমাজসেবীরা, যাঁরা দুটো লেখার কোনওটাই পড়েননি। গল্পকারও আলাদা করে ট্রোল-শিকার হলেন। এই হল বিশুদ্ধ ট্রোল-এর উদাহরণ।
ভাইরাস যেমন রূপ বদলেছে, ট্রোল-শিল্পীরাও ইদানীং পরিবর্তিত রূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। ধ্রুপদী ট্রোলেরা ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনার উপর তাঁদের একতরফা মতামত দিয়ে থাকেন। কিন্তু পরিবর্তিত ট্রোলেরা কোনও ঘটনা না ঘটানোর জন্যও কিছু মানুষকে নির্বাচন করে গালাগালি দিতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি রামপুরহাটে ঘটে যাওয়া গণহত্যার পর ট্রোলবাহিনী কিছু মানুষকে বেছে নিয়ে (তাঁদের মধ্যে অনেকে অতীতে একটি প্রতিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন) তাঁরা কেন প্রতিবাদ করছেন না, এই নিয়ে আস্ফালন শুরু করেন। মজার কথা হল, সেই অতীতের প্রতিবাদের জন্য যাঁরা তখন তীব্র গালাগালির শিকার হয়েছিলেন, আজ প্রতিবাদ না করার জন্য তাঁরাই তীব্রতর আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছেন। সে দিনের সেই প্রতিবাদীদের মধ্যে এক বর্ষীয়ান কবি যখন এ বারও একগুচ্ছ প্রতিবাদের কবিতা লিখে ফেললেন, ট্রোলবাহিনী আরও বেশি আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল এই বলে যে, এই প্রতিবাদ যথেষ্ট তীক্ষ্ণ নয়। কবিতায় কী কী উপাদান থাকা উচিত ছিল তাই নিয়ে কেউ সম্পাদিত কবিতা ছাপলেন, কবিতা না লিখে কবি কেন মিছিলে হাঁটলেন না, তাই নিয়ে কেউ প্রবন্ধ লিখলেন। প্রতিবাদ করলেও যা, না করলেও তা-ই। ট্রোলের অভিধানে সব ছবিই সুকুমার রায় বর্ণিত ‘কালাচাঁদের ছবি’। মানে, যা যা আঁকা হয়নি তা-ই আঁকা উচিত ছিল।
না, এ সব মোটেই কোনও মজার কথা নয়। আজ এক জন কবি, গত কাল এক বেতারকর্মী, পরশু এক জন অভিনেতা, আগামী কাল হয়তো এক জন শিক্ষক— এই ভাবে প্রতি দিন
ট্রোলিং-এর ব্যস্ত শ্মশানে কেউ না কেউ পুড়েই চলেছেন আর তাই দেখে সমবেত জনতা হাততালি দিচ্ছেন, এ বড় আনন্দের কথা নয়। প্রথমত, তরুণ শিক্ষিত জনগণ এক জন জনপ্রিয় বর্ষীয়ান কবিকে কোনও অপরাধ ছাড়াই ‘পরজীবী’, ‘ক্লীব’, ‘মিথ্যাবাদী’ বলে গালাগাল দিচ্ছে। এই কথাটি লিখতেই যেন নিদারুণ গ্লানি হয়। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাল ও সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করে গঠনমূলক সমালোচনা এবং প্রকৃত প্রতিবাদের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, এই নিরর্থক ও নিরন্তর কুৎসার মধ্যে দিয়ে তা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সেই দায়িত্ব যাঁদের ছিল, তাঁরাও বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছেন, কারণ তাঁরা প্রতিবাদ আর টিটকিরি গুলিয়ে ফেলেছেন, এমনকি যা ঘটেনি বা যা তাঁদের পছন্দমতো পদ্ধতিতে ঘটেনি তাই নিয়েও প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন। সদ্য ঘটে যাওয়া উপাচার্য-নিগ্রহের ঘটনার পরও অন্যান্য উপাচার্য-অধ্যক্ষরা কেন প্রতিবাদ করছেন না, এই ধুয়ো তুলে ট্রোলবাহিনী তাঁদের দিকে মেরুদণ্ডহীন-পরজীবী ইত্যাদি বিশেষণ ছুড়তে শুরু করেছে।
এই ট্রোলবাহিনীর দয়াতেই ‘সুশীল সমাজ’ আর ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দ দু’টি বহু দিনই গালাগালিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই ভণ্ডামির এ বার প্রতিবাদ হওয়া দরকার, হচ্ছেও কোথাও কোথাও। সাহিত্যিক, চিত্র পরিচালক, শিল্পী ইত্যাদি সৃষ্টিশীল মানুষেরা বিভিন্ন ঘটনায় প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাই বলে এঁরা কোনও সমসত্ত্ব প্রজাতি নন যে, সব ঘটনায় সবাই একই ভাবে প্রতিবাদ করবেন বা প্রতিবাদ শুধু তাঁরাই করবেন! তাঁদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে যাঁরা কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের বোতাম টিপবেন তাঁরাও কিছু শ্রমজীবী নন। প্রতিবাদের দায়িত্ব সকলেরই আছে। আমার মাইনে না বাড়লে যেমন প্রতিবাদটা নিজেই করি, বুদ্ধিজীবী খুঁজে বেড়াই না, তেমনই স্কুল সার্ভিস কমিশনের উত্তীর্ণ প্রার্থীরা কেন বছরের পর বছর রাস্তায় বসে আছেন, বা আইসার-এর ছাত্র শুভদীপ রায় কেন আট বছরেও গবেষণা শেষ করতে পারেননি, সে উত্তরও আমাদেরই চাইতে হবে। সে সব না করে আজ ট্রোলিং-এ ব্যস্ত থাকলে আমাদের সন্তানও কোনও দিন রক্তাক্ত ফিরতে পারে! সে দিন কার কাছে প্রতিবাদ চাইব!
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে আমরা নানা বিষয়ে কৈফিয়ত চাইতে পারি। কিন্তু সহনাগরিকের কাছে কেন প্রতিবাদ করেছেন বা কেন করেননি, সে কৈফিয়ত চাইবার অধিকার আমাদের নেই। কাকে আক্রমণ করছি, আর কাকে করছি না, কিসের প্রতিবাদ করছি, কিসের করছি না— আজ সব জড়িয়ে পেঁচিয়ে গিয়েছে।
সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy