Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
দাড়ির দৈর্ঘ্য থেকে শাড়ির রং, ডিজিটাল দুনিয়ায় সবই প্রচারকৌশল
Prashant Kishor

ভোটকুশলীর অচ্ছে দিন

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘ক্যাম্পেন ম্যানেজার’ নিয়োগের সংস্কৃতি নতুন নয়। সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মূলত দুই ব্যক্তির লড়াই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৪৪
Share: Save:

সেবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রোনাল্ড রেগন রিপাবলিকান প্রার্থী। রেগনের একটা দোষ ছিল। মাঝেমধ্যেই তিনি উদ্ভট মন্তব্য করে নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনতেন। বোঝা দায় হত, তিনি সত্যিই উল্টোপাল্টা বকছেন না কি রসিকতা করছেন! রেগন তাঁর প্রচারের দায়িত্বে নিয়োগ করলেন রাজনৈতিক উপদেষ্টা স্টুয়ার্ট স্পেনসারকে। রেগনের উদ্ভট কথা বলার বদভ্যাস বন্ধ করতে স্পেনসার এক বিচিত্র দাওয়াই দিলেন। তা হল, মাথায় কিছু না এলে, উদ্ভট কথাবার্তা না বলে ভোটারদের সামনে এমন কিছু বলতে হবে, যার কোনও সারমর্ম নেই। ফলে তা নিয়ে বিতর্কও হবে না।

মনে রাখা দরকার, এটি ১৯৮০ সালের ঘটনা। ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-টুইটার-ইনস্টাগ্রাম-ইউটিউবের যুগ নয়। এক বার কেউ কোথাও মুখ ফস্কে কিছু বললে, তা নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে রসিকতা শুরু হয়ে যাওয়ার চল নেই। তবু ভোটারদের সামনে কী বলবেন, কী বলবেন না, তা বুঝতে রেগনের ভোটকুশলীর প্রয়োজন পড়েছিল।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘ক্যাম্পেন ম্যানেজার’ নিয়োগের সংস্কৃতি নতুন নয়। সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মূলত দুই ব্যক্তির লড়াই। দল সেখানে গৌণ। ভারতে এক দশক আগে পর্যন্তও তার প্রয়োজন পড়েনি। কারণ ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র’ ভারতে নির্বাচন বরাবরই বিভিন্ন দলের মধ্যে লড়াই। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর হয়ে প্রচারের দায়িত্বও দলের। ইন্দিরা গান্ধী নিজের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যতিক্রমই ছিলেন।

২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন ও জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর আবির্ভাবের পরে সেই ব্যতিক্রমটাই এখন নিয়ম। বিজেপি গত আট বছরে নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়েই অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়েছে। রাজনৈতিক লড়াই যতই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, ততই ভোটকুশলীদের চাহিদা তুঙ্গে উঠেছে।

গত দু’সপ্তাহ ধরে সনিয়া গান্ধী থেকে কংগ্রেসের শীর্ষনেতারা হাতে খাতা-পেনসিল নিয়ে প্রশান্ত কিশোরের সামনে যে ভাবে রাজনীতির অ-আ-ক-খ বুঝলেন, তাতে একটি বিষয় স্পষ্ট। এ দেশের রাজনীতিকরা ভোটকুশলীদের সাহায্য ছাড়া এক পা-ও এগোনোর কথা ভাবতে পারছেন না। তা সে বিজেপি, কংগ্রেস-ই হোক বা তৃণমূল, ডিএমকে, টিআরএস, ওয়াইএসআর কংগ্রেসের মতো আঞ্চলিক দল। গান্ধী পরিবার প্রশান্ত কিশোরকে কংগ্রেস চালানোর একচ্ছত্র ক্ষমতা দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসে যোগ দেননি। তার অর্থ এই নয়, কংগ্রেস আগামী দিনে ভোটকুশলী, প্রচার ম্যানেজার সংস্থার সাহায্য ছাড়াই ভোটের ময়দানে নামবে। কর্নাটক, তেলঙ্গানা নির্বাচনে কংগ্রেস ইতিমধ্যেই একদা প্রশান্ত কিশোরের সতীর্থ ভোটকুশলী হিসেবে সুনীল কানুগোলুকে নিয়োগ করেছে। হয়তো গুজরাত নির্বাচনের জন্যও তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হবে।

২০১৪-য় লোকসভা নির্বাচনে প্রশান্ত কিশোরের তৈরি সিএজি (সিটিজ়েনস ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্ন্যান্স) মোদীর প্রচারের দায়িত্বে ছিল। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে অমিত শাহ বিজেপির হাল ধরলেন। পিকে আর বিজেপিতে হালে পানি না পেয়ে সিএজি-র ভোল বদলে আইপ্যাক তৈরি করলেন। শূন্যস্থান দখল করল বিজেপির নিজস্ব ‘অ্যাসোসিয়েশন অব বিলিয়ন মাইন্ডস’ নামের সংস্থা। অমিত শাহ থেকে জেপি নড্ডার জমানাতেও তারা বিজেপির হয়ে নির্বাচনী কৌশল থেকে ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রচারে নীরবে কাজ করে চলেছে।

এখানেই শেষ নয়। ভোটকুশলী বা ‘ইলেকটোরাল স্ট্র্যাটেজিস্ট’ হিসেবে আমজনতা এখনও হয়তো প্রশান্ত কিশোর বা তাঁর হাতে তৈরি আইপ্যাককেই চেনে। বাস্তবে গত সাত-আট বছরে দেশের রাজনীতিতে প্রশান্ত কিশোরের মতো একগুচ্ছ ভোটকুশলী, আইপ্যাকের মতো রাজনৈতিক উপদেষ্টা বা প্রচার ম্যানেজার সংস্থার আবির্ভাব হয়েছে। আইপ্যাকের মতো হয়তো মাইন্ডশেয়ার অ্যানালিটিক্স, ডিজ়াইনবক্সড, চাণক্য, ওয়াররুম, পলিটিক্যালএজ সংস্থার নাম লোকের মুখে মুখে ফেরে না। বাস্তবে এদের প্রতিটি সংস্থাই বিভিন্ন রাজ্যে কোনও বা কোনও রাজনৈতিক দল বা নেতার হয়ে নির্বাচনে কাজ করে চলেছে। কোন রাজ্যে কত শতাংশ ভোটার শেষ বেলায় মনস্থির করেন, কোন বুথে কত জন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন, কত জন পাননি, কোন এলাকায় কী সমস্যা নিয়ে ভোটারদের চিন্তা বেশি, কোথায় কোন জাতের মানুষের ভোটই শেষ কথা বলে, তার হিসাব কষে প্রচারের মন্ত্র ঠিক করাই এদের কাজ।

লক্ষ্য একটাই। নেতা বা নেত্রী আদতে যা-ই হোন, মানুষের চাহিদা বুঝে তাঁর ভাবমূর্তি তৈরি। শর্ত একটাই। নেতানেত্রী ও তাঁর দলের কর্মীদের ভোটকুশলী বা প্রচার ম্যানেজার সংস্থার শেখানো বুলি আওড়ে যেতে হবে। এই ভোটকুশলীদের কেউ কর্পোরেট বা আর্থিক উপদেষ্টা সংস্থার প্রাক্তন উচ্চপদস্থ কর্তা। কেউ আবার আইআইটি বা আইআইএম-এর কৃতী ছাত্র।

সুনীল কানুগোলুই যেমন। প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকেন। ২০১৪-য় প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর প্রচারে কাজ করেছেন। কিশোর বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার পরে সুনীলই ছিলেন বিজেপির ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিলিয়ান্ট মাইন্ডস’-এর প্রধান। ২০১৭-য় উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে কিশোর যখন কংগ্রেসের দায়িত্বে, তখন সুনীল বিজেপির প্রচারের দায়িত্বে। তাঁর হাত ধরেই যোগী আদিত্যনাথের লখনউ-এর গদি দখল। তার পরে স্বাধীন ভাবে কাজ করছেন। কখনও ডিএমকে, এডিএমকে, এখন আবার কংগ্রেসের হয়ে।

আলাদা আলাদা নাম, আলাদা কাজের ধরন হলেও ভোটকুশলীদের মধ্যে মিল একটাই। তাঁদের প্রচারের কৌশল মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। রাজনৈতিক নেতাদের ভাবমূর্তি তৈরির খেলা।

প্রশান্ত কিশোরের কথাই ধরুন। ২০১৪-য় নরেন্দ্র মোদীকে ‘বিকাশপুরুষ’ হিসেবে তুলে ধরে তাঁর ‘অব কি বার, মোদী সরকার’-এর স্লোগান থেকে ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটে ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’, প্রচারের সুর মূলত ব্যক্তিনির্ভর। পিকে এর মাঝে নীতীশ কুমার, অরবিন্দ কেজরীওয়াল, জগন্মোহন রেড্ডি, এম কে স্ট্যালিন, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহের জয়ের পথ তৈরি করেছেন। প্রতি বারই ব্যক্তিগত ক্যারিসমা তৈরিই ছিল তাঁর সাফল্যের মূল রসায়ন। এ বার কংগ্রেসের জন্য তাঁর দাওয়াই ছিল ‘মোদী হানিকারক হ্যায়’ ও ‘অব মোদী জানেওয়ালে হ্যায়’-এর স্লোগানে মোদীর ভাবমূর্তি ভাঙার কৌশল। এ যেন নিজের এক হাতে তৈরি জিনিস অন্য হাতে ভাঙার চেষ্টা।

উল্টো দিকে, তৃণমূল, ডিএমকে, টিআরএস, আপ, সব আঞ্চলিক দলই মূলত ব্যক্তি বা পরিবারনির্ভর। তাঁদের ঘিরে আস্থাভাজন অনুগামীদের দরবার। ফলে ভোটকুশলীদের ব্যক্তিপুজো-নির্ভর প্রচার বেশ খাপ খেয়ে যায়। এমনকি বিজেপির মতো ক্যাডারভিত্তিক দলও যত ব্যক্তির ভাবমূর্তির উপর ভরসা করছে, তত সেই ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য প্রশান্ত কিশোরদের দরকার পড়ছে।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, মোদী-পূর্ব যুগেও রাজনৈতিক প্রচারের জন্য পেশাদারদের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। ১৯৮৯-তে যেমন রাজীব গান্ধীকে ক্ষমতায় ফেরাতে তাঁর বাল্যবন্ধু অরুণ নন্দার রিডিফিউশন সংস্থা ‘মাই হার্ট বিটস ফর ইন্ডিয়া’ স্লোগান তুলেছিল। প্রচারে প্রশ্ন ছিল, জোট সরকার টিকবে তো? সেই প্রচারের মতো ২০০৪-এ অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারকে ক্ষমতায় ফেরাতে ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর প্রচারও কাজে আসেনি। কিন্তু তখনও বিজেপির ভোটকুশলী বলতে দলের নেতা প্রমোদ মহাজনকেই লোকে চিনত। বাইরে থেকে পেশাদার ভাড়া করে আনতে হত না। প্রচারের ভারপ্রাপ্ত সংস্থাগুলিও এ কালের ভোটকুশলীদের মতো রাজনীতিকদের দাড়ির দৈর্ঘ্য থেকে শাড়ির রং ঠিক করে দিত না। নেতানেত্রীরাও শুধুমাত্র ভোটকুশলীদের শেখানো বুলি আওড়ে যেতেন না।

হলিউডের ছবি দ্য ক্যান্ডিডেট-এ দেখা গিয়েছিল, আমেরিকার এক রাজনীতিক তাঁর ভোটকুশলীর শেখানো বুলি আওড়েই ভোটে জিতে যান। কিন্তু তার পর ভোটে জিতে অভিনন্দনের বন্যার মধ্যেই তাঁর ভোটকুশলীর কলার চেপে ধরে জানতে চান, ‘এ বার আমরা কী করব?’ আশা করা যায়, এ দেশে সেই দিন আসতে এখনও ঢের দেরি।

অন্য বিষয়গুলি:

Prashant Kishor IPAC BJP Political Strategist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy