দিলীপবাবুর মন্তব্য নিয়ে আবারও বিতর্কের ঝড়। ঝড়ঝাপ্টা অবশ্য তাঁর গা-সওয়া। এই তো সে দিন সান্ধ্য টিভির গভীর বিতর্কের মধ্যে এক মহিলা আলটপকা প্রশ্ন করে বসেছিলেন— দিলীপবাবু ধমকে বলেছেন, “ন্যাকামি করবেন না।” ব্যস! সুধীজনেরা অমনি বিচলিত। তাতে অবশ্য দিলীপবাবুর ভারী বয়েই গিয়েছে। তার পরও তিনি শীতলখুচির ঘটনা বিষয়ে মন্তব্য ছুড়লেন, নিজের স্টাইলেই।
আগেও যখন তিনি গরুর দুধে সোনা খুঁজে পেয়েছিলেন, অনেকে বিরক্ত হয়েছিলেন। করোনার বাজারে যখন পুজোপার্বণে সপারিষদ চরণামৃত খেয়ে বলছিলেন, “আমেরিকা-ইউরোপ ভয়ে ঘরে সেঁধিয়ে গিয়েছে আর আমরা মায়ের সামনে আছি, চিন্তা কিসের”— কম লোক বিচলিত হননি। করোনা প্রতিরোধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গোমূত্র খাওয়াচ্ছিলেন যখন, সে সময়ও। অথবা যখন জানিয়েছিলেন যে, গোমাতা বলতে দেশি গরুই বুঝতে হবে, বিদেশি গরুকে বড় জোর ‘আন্টি’ বলা যায়— কত জন হাসিঠাট্টা করেছিলেন। অভিনেতাদের রাজনীতিতে যোগদানের অপচেষ্টার পরিবর্তে নাচাগানার সদুপদেশ দান— অন্যথায় দিলীপবাবু নিজ হাতে তাঁদের রগড়ে দেবেন, এমত বিনয়ী বার্তায় সুকুমার গণমানসে চাঞ্চল্যসৃষ্টি তো একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা। কাজেই, বিতর্ক নতুন ব্যাপার নয়।
বঙ্গরাজনীতিতে এযাবৎ কাল সকলে শুদ্ধ সংস্কৃতে বাক্যালাপ করতেন, এমনটা না হলেও, ইদানীং কুকথা, বাজে-বকার কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়িই। বিস্তর হাহুতাশের পরেও অনস্বীকার্য, এই সব বিতর্কে দিলীপবাবুদের কিছুই এসে যায় না। কুবাক্যে পটু নেতাদের জনপ্রিয়তা যে ভাবে বেড়েছে, অধিকাংশ দল যে ভাবে দিলীপবাবু-সুলভ ব্যক্তিদের সামনে আনছে, রাহুলবাবু-সায়ন্তনবাবুরা দীর্ঘ দিন বাদে যে ভাবে জনসমক্ষে ভেসে উঠলেন শীতলখুচি ঘিরে আপত্তিকর মন্তব্যের সুবাদে— এটুকু স্পষ্ট যে, কুকথায় যাঁরা বিচলিত হন, ধারাবাহিক ভাবে তাঁদের পছন্দের বিপরীতে চলেও জনসমর্থন বাড়ানো যায়।
দিলীপবাবুরা বিশেষ দলের পেটেন্ট-করা সম্পদ, এমনটি ভাবাও অকারণ— সম-অনুপাতে না হলেও, কুভাষী নেতারা রয়েছেন সব দলেই অল্পবিস্তর। ভাবা জরুরি, ঠিক কোন ভরসায় এঁরা এমন অনর্গল অবান্তর কথা বলে চলতে পারেন, আপত্তিকর কথা বলেও হাততালি জিততে পারেন। তবে কি কুকথাই বঙ্গ-রাজনীতির লব্জ হয়ে দাঁড়াল? কুবাক্যই হয়ে দাঁড়াল রাজনীতির মূলস্রোত?
আর একটু গভীরে গিয়ে ভাবা জরুরি। ‘অন বুলশিট’ নামক প্রবন্ধে লেখক হ্যারি ফ্র্যাঙ্কফুর্ট ‘বুলশিট’-এর প্রাদুর্ভাব নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। বুলশিট, অর্থাৎ সত্য-মিথ্যার তোয়াক্কা না করে অনর্গল ভুলভাল কথাবার্তা— যাকে আমরা ‘প্রলাপ’ বলতে পারি। এক শ্রেণির মানুষ আপনার কাছে বার্তা পৌঁছোনোর নামে ‘প্রলাপ’ বকছেন— উদ্দেশ্য, আপনার মতামতকে প্রভাবিত করা। বস্তুত, কোনও বার্তার তোয়াক্কাই তাঁরা করেন না। আপনার মতামতটি নিজেদের মতো গড়ে নিতে তাঁরা যা-খুশি বলতে পারেন, বলেনও— যা মিথ্যার চেয়েও বিপজ্জনক।
মিথ্যাবাদী বনাম ‘প্রলাপ’-বক্তার ফারাকটুকু স্মর্তব্য। মিথ্যা যিনি বলছেন, তিনি সত্যকে স্বগত মান্যতা দিচ্ছেন, কেননা তাঁর অবস্থান সত্যের বিপরীতে। অপর দিকে যিনি ‘প্রলাপ’ বকছেন, তিনি সত্য-মিথ্যার তোয়াক্কা না করেই স্রেফ আপনার মতামতকে প্রভাবিত করার জন্য যা-খুশি-তাই বলছেন— সত্যের মান্যতার প্রশ্ন এখানে অবান্তর। তথ্য বা সত্য দিয়ে প্রথম জনের মোকাবিলা সম্ভব, কিন্তু দ্বিতীয় জনের ক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ।
দিলীপবাবুর কথাবার্তা তো বটেই, রাজ্যের বা দেশের মাথা যাঁরা, জনগণের প্রতি তাঁদের বার্তার অধিকাংশটাই সত্য-মিথ্যার ঊর্ধ্বে— ‘প্রলাপ’। ঢালাও ‘প্রলাপ’-এর বাজারে, এমনতর বক্তব্যের সরাসরি পক্ষে বা বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, পরমহংস-সুলভ দক্ষতায় সত্যিটাকে ছেঁকে নেওয়ার কাজটা দুরূহ। স্বাভাবিক ভাবেই দিলীপবাবুর রগড়ে দেওয়ার সংলাপের আগে-পরে, ওই একই সাক্ষাৎকারে, আরএসএস-এর আদর্শানুসারী বাংলা গড়ার বার্তা বিরোধীদেরও নজরে পড়েনি। প্রধানমন্ত্রীর ‘দিদি-দিদি’ সুরে আমরা ভুলছি এনআরসি-র কথা। চিটিংবাজির দায়ে জেল-খাটা নেতা জামিন পেয়েই টিভিতে বসে শুনিয়েছেন সততার নির্দেশিকা। আর্থিক দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হওয়ার মুহূর্তে মন্ত্রী বলেছেন, “তাতে কী হয়েছে, নেতাজিকেও তো জেলে যেতে হয়েছিল।”
অধিক উদাহরণ নিষ্প্রয়োজন। কথাটা হল, নেতাদের ভাষণ, জনসমক্ষে কথাবার্তা নিছক কুকথা বা মিথ্যা হলে, বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে সত্যের আভাস পাওয়া সম্ভবপর। কিন্তু নেতাদের বক্তব্য ‘প্রলাপ’ হলে একমাত্র পথ— বক্তব্যকে অগ্রাহ্য করে সত্যের সন্ধান। কিন্তু মুশকিল, অহোরাত্র ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, ফেক নিউজ়ের সময়ে সাধারণ নাগরিকের পক্ষে ‘প্রলাপ’-এর পাঁক ঘেঁটে সত্যের অনুসন্ধান দুঃসাধ্য। এক দিকে ‘প্রলাপ’-কে প্রাইম টাইম নিউজ় হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে তার জনগ্রাহ্যতা বৃদ্ধির ব্যাপারে সমাজ ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। অন্য দিকে, আমজনতার সামনে মিডিয়াকে ছেড়ে সত্য জানার বিকল্প পথই বা কী!
নেতারা তত দিনই ‘প্রলাপ’ বকতে থাকবেন, যত দিন আমরা তাতে মজে থাকব। উত্তরণের পথ এই ‘প্রলাপ’কে অগ্রাহ্য করতে পারা, গুরুত্বহীন ভাবতে পারা। ক্রমাগত ‘প্রলাপ’ শ্রবণ আমাদের যাপনে শিকড় বিছিয়েছে— সে অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে দীর্ঘ চর্চা ও বিপ্রতীপ অভ্যাস জরুরি। দায়িত্ব সহজ নয়। নিজের নেতার ‘প্রলাপ’কে যত দিন ‘ও রকম তো ওরাও বলে’ দিয়ে ঢাকতে চাইব, তত দিন ‘প্রলাপ’-এর সংস্কৃতিই ভবিতব্য।
নেতাদের আচরণ অবশ্যই বদলাতে হবে, কিন্তু কিছু বদল নিজেদের জন্যেও ভাবুন। ‘প্রলাপ’-এর প্রাদুর্ভাবের পিছনেও নিজেদের অগভীর চিন্তার অভ্যাস, যাপন এবং মেনে নেওয়ার, মানিয়ে নেওয়ার সংস্কৃতির ভূমিকা কম নয়। মিডিয়ার বুদ্ধিদীপ্ত মানুষরাও ভাবুন, কেন ‘প্রলাপ’-এর প্রতি আপনাদের এমন অমোঘ আকর্ষণ? আপনি, আপনারা, আমরা তো তেমন নেতাই পাব, যেমনটি পাওয়ার যোগ্য। স্বখাতসলিলে ডুবে মরতে বসলে, সে দোষ অন্য কারও নয়। সে পরিণতির দায় অন্য কেউই নেবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy