বহু দিন আগে দ্বীপের নাম টিয়া রং নামে একটা সিনেমার পোস্টার দেখেছিলাম। কাজে-অকাজে সুন্দরবনে যখন যে দ্বীপে গেছি, জলবেষ্টিত সবুজে মোড়া ভূখণ্ডটি দেখে মনে হয়েছে, এটাই বুঝি সেই টিয়া রং দ্বীপ। এখন আর তা মনে হওয়া মুশকিল। মাঝে কয়েক বছরে উপর্যুপরি বেশ কয়েকটা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনের দ্বীপগুলির উপর দিয়ে বয়ে গেছে। প্রতি বারই নিয়ম করে বাঁধ ভেঙেছে, নোনাজলে নষ্ট হয়েছে চাষের জমি, মরেছে পুকুরের মাছ, ভেসে গেছে হাঁসমুরগি, গবাদি পশু, ঘরবাড়ি-সহ গেরস্তালির সরঞ্জাম। মানুষও যে মরেনি, তা নয়।
সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে দ্বীপবাসীদের একই দুর্দশার পুনরাবৃত্তি রাজ্য তথা জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলিতে কয়েক দিন ধরে লিড নিউজ় ছিল।
তার পরেও এক বছর কেটে গেছে। মাঝারি আকারের লঞ্চে গোসবা হয়ে কুমিরমারি যাওয়ার পথে সারেং মান্নাবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কেমন আছেন দ্বীপের বাসিন্দারা? প্রশ্ন শুনে হাসলেন সাতজেলিয়ার বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের তরুণ। বললেন, বাদার মানুষের আবার থাকা না থাকা! ইয়াসের পর নেতা-মন্ত্রী-কর্তারা এসেছিলেন। নানা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। নদীবাঁধ পাকা হবে, পর্যটন শিল্পকে চাঙ্গা করতে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা হবে, বাঁধের পাশে ম্যানগ্রোভ লাগানো হবে, সেতু হবে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছবে, ইত্যাদি। জিজ্ঞেস করলাম, তার পর? ভদ্রলোক হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, যাচ্ছেন তো কুমিরমারি, নিজের চোখেই দেখবেন। বাদাবনের সব দ্বীপেরই এক গপ্পো। আগে ছিল জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ, এখন সঙ্গে ফি বচ্ছর ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব।
গঁদখালি থেকে ঘণ্টা চারেকের জলপথ। মোল্লাখালি পেরিয়ে রায়মঙ্গলের এক পাড়ে কুমিরমারি, প্রায় সাড়ে সতেরো হাজার মানুষের বাস সেখানে। অন্য পাড়ে একদা বিতর্কিত মরিচঝাঁপি, এখন পুরোটাই দক্ষিণরায়ের দখলে। তবে উদ্বাস্তুদের লাগানো নানা ফলের গাছ এবং গেরস্তালির চিহ্ন নাকি আজও রয়ে গেছে সেখানে। নদীর পাড় বরাবর বাদাবন তারজালি দিয়ে ঘেরা। মাঝে মাঝে বন দফতরের লাগানো বিপদসূচক লালকাপড়ের নিশান। কিন্তু সে সব উপেক্ষা কোমর-জলে মীন ধরছেন মহিলারা, জাল ফেলছেন কেউ কেউ। বেপরোয়া ভাবে কাঁকড়া ধরতে সুন্দরবনের ‘কোর এরিয়া’-তে ঢুকে বাঘের শিকার হচ্ছেন অনেকে।
কুমিরমারিতে নামার জন্যে গোটা চারেক ঘাট রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল ভাঙনঘাট। সার্থক নাম, ভাঙতে ভাঙতে বাঁধ প্রায় উধাও, ম্যানগ্রোভের চিহ্নমাত্র নেই। ঘাট থেকে পাকা রাস্তা ধরে একটু এগোতেই কয়েকটা পুকুর, শুকনো ফুটিফাটা। জানা গেল, ইয়াসের সময় নোনা জল ঢুকে সব মাছ মরে গিয়েছিল। নতুন করে মাছ ছাড়ার জন্যে সেই জল সেঁচে বার করে দিয়ে এখন বৃষ্টির জন্যে অপেক্ষা। ভেঙে পড়া কাঁচা বাড়ি বাসিন্দারা সাধ্যমতো সারিয়ে নিলেও গ্রামের ভিতরে ধ্বংসের চিহ্ন মেলায়নি। কোথাও মরা গাছ, কোথাও বা চালহীন খুঁটি। সরকারি অনুদান পেয়েছেন অনেকে, সবাই নয়। এখানেও সেই কাটমানি এবং আমরা-ওরার গপ্পো।
আলাপ হল হাসিখুশি আলোরানি সর্দারের সঙ্গে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই দ্বীপের বাসিন্দা। আয়লা থেকে ইয়াস, প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ে এলাকার বহু মানুষ তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর মতে আয়লার পর থেকে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপে ক্ষয়ক্ষতির প্রকোপ বেড়েছে। মাটির বাঁধ ভেঙে নদী এগিয়ে আসছে দ্বীপের ভিতরে। মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখত যে ম্যানগ্রোভ, কাঠ-মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে তা প্রায় উজাড়। দ্বীপের প্রায় অর্ধাংশে এখনও বিদ্যুদয়নের কাজ বাকি।
অনেকেই ওখানে বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভের বীজ সংগ্রহ করে চারা তৈরি করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাছে বিক্রি করেন। সেই চারা বাঁধের উপর লাগানো হলে এলাকার মানুষই দায়িত্ব নিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করেন। পুরনো গাছ যাতে চুরি না হয়, তার জন্যে নজরদারি করেন। ক্রমাগত ভাঙনের ফলে বাঁধ সংলগ্ন অনেক জায়গাতেই গাছ লাগানোর মতো জমি না থাকায় সমস্যা হচ্ছে, তবু ওঁরা সাধ্যমতো লড়ে যাচ্ছেন। ঘূর্ণিঝড়ের বাড়বাড়ন্ত থেকে ওঁরা বুঝেছেন, বাদাবন না বাঁচলে দ্বীপ বাঁচবে না।
এক জন জানালেন, জীবিকার প্রশ্নে ওঁরা কী ভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন। সত্তরটি পরিবার নিয়ে গঠিত জল ব্যবহারকারী সমিতি এবং পঞ্চায়েতের যৌথ উদ্যোগে বুজে যাওয়া মহেশখালি খাল পুনরায় কেটে মাছ চাষ শুরু করেছেন। চাষের কাজেও ব্যবহার করছেন খালের জল। বুজে আসা নৌকাডুবি খাল পুনরুদ্ধারের চেষ্টা হচ্ছে। আগে যাঁরা জন খাটতে ভিনরাজ্যে পাড়ি জমাতেন, তাঁদের কেউ কেউ ফিরে এসে এ সব কাজে হাত লাগিয়েছেন। গঠিত হয়েছে কুমিরমারি ইকো টুরিজ়ম। স্থানীয় উৎপাদনের বিপণনের স্বার্থে স্থির হয়েছে, অতিথি সৎকারে কেবল এখানকার প্রকৃতিজাত বা উৎপাদিত আনাজ ও মাছমাংসই ব্যবহার করা হবে। বাদাবন থেকে সংগৃহীত মধু প্রক্রিয়াকরণ ও বিপণনের জন্যে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়েছে।
সব মিলিয়ে, দ্বীপের বাসিন্দারা প্রকৃতির রোষকে প্রতিহত করার মরিয়া চেষ্টায় ব্যস্ত। খুঁজছেন কর্মসংস্থানের নতুন উপায়ও। আত্মপ্রত্যয়ী মুখগুলি দেখে বিশ্বাস জাগে, এ ভাবেও ঘুরে দাঁড়ানো যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy