Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Social Workers Punished

বিচার দাবি করে শাস্তির কোপে

সমাজকর্মী হিমাংশু কুমার ছত্তীসগঢ়ের আদিবাসীদের হয়ে বিচার প্রার্থনা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। জনস্বার্থ মামলায় অভিযোগ তুলেছিলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ভুয়ো সংঘর্ষে খুন করছে আদিবাসীদের।

রঞ্জিত শূর
শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২২ ০৫:০১
Share: Save:

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে জেলে গেলেন সমাজকর্মী তিস্তা শেতলবাড়। গুজরাত গণহত্যার বিচার চেয়েছিলেন তিনি। প্রশ্ন উঠল, নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও কেন তিনি দীর্ঘ ষোলো বছর নানা আদালতে ছুটে বেড়াচ্ছেন তিস্তা। তিস্তার দায়ের করা মামলা খারিজ করল কোর্ট। এর পরেই আদালতের রায়ের ভিত্তিতে তিস্তার বিরুদ্ধে এফআইআর করল পুলিশ। অভিযোগ ছিল, সরকারি আধিকারিকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা রটিয়েছেন তিনি।

সমাজকর্মী হিমাংশু কুমার ছত্তীসগঢ়ের আদিবাসীদের হয়ে বিচার প্রার্থনা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। জনস্বার্থ মামলায় অভিযোগ তুলেছিলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ভুয়ো সংঘর্ষে খুন করছে আদিবাসীদের। তাঁর সেই অভিযোগ খারিজ করে দিয়ে হিমাংশু কুমারকেই মোটা টাকা জরিমানা করে আদালত, পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগের জন্য। মাওবাদীদের সঙ্গে হিমাংশুর যোগ অনুসন্ধান করতে আদালত নির্দেশ দেয় পুলিশকে।

যাঁরা বিচার চাইলেন, তাঁদের তদন্ত ও শাস্তির মুখে পড়ার এই প্রবণতা সমাজকর্মীদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেকের মনেই সংশয় জন্মেছে, এমনটা ঘটতে থাকলে বিচার প্রার্থনা করাটাই ঝুঁকি মনে হবে না তো?

রাজস্থানে সম্প্রতি একটি ঘটনা ঘটেছে, যা নতুন করে দুর্ভাবনা উস্কে দিয়েছে। নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে মহিলা কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন রাজস্থানের যে মেয়েরা, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধেই এফআইআর করে ব্যবস্থা করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে মহিলা কমিশন। এক-দু’জন নয়, ষাট জন অভিযোগকারিণীর বিরুদ্ধে এফআইআর করার ছাড়পত্র পেয়েছে পুলিশ। বর্তমান চেয়ারপার্সন রেহানা রিয়াজ়-এর কার্যকালে মহিলা কমিশনে ৩৬৮০টি অভিযোগের বিচার হয়েছে। তার মধ্যে ৪১৮টি অভিযোগকে তিনি ‘ভুয়ো অভিযোগ’ ধার্য করেছেন। তার মধ্যে ষাট জনের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৮২ এবং ২১১ ধারা প্রয়োগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৮২ ধারায় উদ্দেশ্যমূলক ভাবে অন্যের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে কোনও পদস্থ সরকারি আধিকারিকের কাছে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করাকে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এবং ২১১ ধারায় বলা আছে, কারও ক্ষতির উদ্দেশ্যে মিথ্যা অভিযোগ করা অপরাধ।

বিচারপ্রার্থী মেয়েদের বিরুদ্ধে এই ধারাগুলির প্রয়োগের প্রতিবাদ করেছে রাজস্থানের বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন ও মহিলা সংগঠন। রেহানা রিয়াজ়ের পদত্যাগের দাবি করে স্মারকলিপিও জমা দিয়েছেন অনেকে। তাঁদের আপত্তি, মহিলা কমিশনের কাজ হল মহিলাদের স্বার্থ রক্ষা করা। পুলিশ এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় মহিলারা যথাযথ বিচার পান না, মেয়েদের স্বার্থ পুলিশ ও প্রশাসনের দ্বারা সুরক্ষিত হয় না বলেই তো মহিলা কমিশনের জন্ম। মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশনের কাছে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ জমা পড়ে পুলিশের বিরুদ্ধেই। পুলিশের তাচ্ছিল্য, পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে মেয়েদের অভিযোগ প্রচুর। অথচ কমিশন পুলিশের কথায় ভরসা করে মেয়েদের অবিশ্বাস করছে।

প্রশ্ন উঠেছে কমিশনের কাজের পরিধি নিয়েও। মহিলা কমিশনের কাজ অভিযোগের বিচার করে দোষী বা নির্দোষ খুঁজে বার করা, এবং যথাযথ শাস্তি বিধান করা। কমিশন প্রমাণের অভাবে অভিযোগ খারিজ করতে পারে। অভিযোগই মিথ্যা, বা তার পিছনে কোনও মন্দ অভিসন্ধি কাজ করছে— এমন ধরে নেওয়া কি ঠিক? কোনও অভিযোগের প্রমাণ নির্ভর করে সঠিক তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণ জোগাড় করার উপরে। তদন্তকারী সংস্থা কতটা যত্ন নিয়ে তদন্ত করেছে, কতটা স্বাধীন ভাবে বা নিরপেক্ষ ভাবে তদন্ত করেছে, কোনও অভিযোগ প্রমাণ বা অপ্রমাণের ক্ষেত্রে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রাজস্থানের মানবাধিকার সংগঠন ও মহিলা সংগঠনগুলি মনে করে, এর পর হয়তো মহিলারা আর কমিশনে অভিযোগ জানাতেই যাবেন না, ভয় পাবেন। কারণ, প্রমাণ করতে না পারলে মিথ্যা অভিযোগ করার দায়ে পড়তে হবে। তা-ও তাঁদের তরফ থেকেই, মেয়েদের নাগরিক অধিকারের রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করা যাঁদের দায়িত্ব!

মেয়েদের অভিযোগ দায়ের করার সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতটিও লক্ষণীয়। পারিবারিক বা সামাজিক চাপ পেরিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মহিলাদের অভিযোগ জানাতে আসাটা সামান্য ব্যাপার নয়। পুলিশ বা বিচারবিভাগের কাছে মেয়েদের অভিযোগ নিয়ে আসার জন্য সম্মত করতেই বহু চেষ্টা করতে হয় মানবাধিকার সংগঠন, নারী অধিকার সংগঠনের কর্মীদের। বিশেষত রাজস্থানের মতো রাজ্যে, যেখানে খাপ পঞ্চায়েতের সংস্কৃতি এখনও প্রবল। একেই ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী মহিলাদের কথার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করে সমাজ। তার উপর অভিযোগের প্রতিকারের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরাও মেয়েদের কথাকে সন্দেহ করলে পুরুষতন্ত্রকেই শক্ত করা হয় না কি?

মহিলা কমিশনের ক্ষেত্রে নারী সংগঠনগুলি আরও বলেছে— পরিবার বা অন্য কারও চাপে যদি কোনও মহিলা মিথ্যা অভিযোগ করে থাকেন, তবে কমিশনের দায়িত্ব হল ওই মহিলাকে কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করা, যাতে তিনি নিজেকে শুধরে নেন তার চেষ্টা করা, তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া নয়। এটা বুঝতে না পারা কমিশনের ব্যর্থতা। একটি অভিযোগের বিচারের এক বৃহত্তর সামাজিক তাৎপর্য মেলে তা থেকে। বিচারপ্রার্থী শাস্তি পেলে তাই নাগরিকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ঘটে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy