২০৩০ সালের মধ্যে বনভূমি সংরক্ষণের দ্বারা ১০০ কোটি টন কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ভারতের সামনে, প্যারিস চুক্তি অনুসারে। প্রতি বারের মতোই এ বছরের গোড়ার দিকে প্রকাশিত ভারতীয় বন সর্বেক্ষণের দ্বিবার্ষিক রিপোর্টও বলছে যে, বন আচ্ছাদন বেড়েছে ২০১৯ সালের চেয়ে ১৫৪০ বর্গ কিমি। কিন্তু, সেই পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে স্পষ্ট হবে— যা বেড়েছে, তা মূলত ডিগ্রেডেড ল্যান্ড বা নষ্ট বনভূমি; গভীর বা ভাল বন দ্রুত শেষ হচ্ছে। গভীর বনভূমির নীচেই বেশির ভাগ খনিজ পদার্থ রয়েছে। দ্রুত জিডিপি বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবেশগত ক্ষতির যথাযথ মূল্যায়ন না করেই বিভিন্ন ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে দ্রুত ছাড় দেওয়া হচ্ছে। লোকসভায় পেশ করা কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-২০২০ সালের মধ্যে ২৫,৮০০ হেক্টর বনভূমি বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৭-২০১৮ সালেই ৪৯৬ বর্গ কিমি বনভূমি নষ্ট করা হয়েছে ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের নামে।
আইনত বাধ্য থাকায় অ্যাফরেস্টেশন বা বনসৃজনের নামে বন দফতর যে সব গাছ লাগাচ্ছে তা মূলত বাণিজ্যিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন ইউক্যালিপটাস, অ্যাকাসিয়া বা রাবার। অর্থাৎ, একই রকম প্রজাতির বন তৈরি করা, যাকে বলা হয় ‘মোনোকালচার’। জলবায়ু পরিবর্তনে এবং জঙ্গলের উপরে নির্ভরশীল আদিবাসী গোষ্ঠীর উপর এর প্রভাব অপরিসীম। একটি হিসাব অনুযায়ী, ‘মোনোকালচার’ প্ল্যান্টেশনের কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতা প্রাকৃতিক বন বা জঙ্গলের ক্ষমতার চল্লিশ ভাগের এক ভাগ। কৃষি বনের ক্ষমতা জঙ্গলের ক্ষমতার সাত ভাগের এক ভাগ। এ ছাড়া প্রাকৃতিক বনের জীববৈচিত্র অনেক বেশি, যা বাতাসের কার্বন শোষণে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। পৃথিবীর উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে বছরে ২ লক্ষ কোটি টন কার্বন ধরে রাখার ক্ষমতাসম্পন্ন জঙ্গল প্রয়োজন, কিন্তু ‘মোনোকালচার’ প্ল্যানটেশনের দ্বারা মাত্র ১৬০০ কোটি টন কার্বন ধরে রাখা যাবে। অন্য দিকে, বিশ্ব জুড়ে জঙ্গলের উপরে নির্ভরশীল প্রায় ১৬ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকায় এই ধরনের বনের কোনও ভূমিকা নেই। ফলে আদিবাসীরাও এই জাতীয় বন রক্ষণাবেক্ষণে উৎসাহ পান না।
জাতীয় বনসৃজন প্রকল্পে অনেক টাকা রয়েছে এখন। ফলে, দুর্নীতিও অনিবার্য। অনেক রাজ্য ইতিমধ্যেই বনের পরিধির বাইরে বনসৃজন প্রকল্প রূপায়ণ করার জন্য ভর্তুকি ও উৎসাহভাতা দেওয়া শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ দফতর ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৫৯,০০০ কোটি টাকা এই খাতে ব্যয় করেছে। পরিবেশ দফতরের ‘ই-গ্রিন ওয়াচ’ পোর্টালের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৫-২০১৮ সালের মধ্যে কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশন ফান্ড থেকে অর্থ নিয়ে যে ২৩,৫০০ হেক্টর বনসৃজন করা হয়েছে, তার অর্ধেক জমিতে এক বা দুই প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। এ দিকে, এক গবেষক ওই পোর্টালে থাকা ছ’টি রাজ্যের ২০০০ নথি পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, এই বনসৃজন যে সব এলাকায় হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই সব এলাকায় কোনও গাছের অস্তিত্বই নেই! ভারতীয় বন সর্বেক্ষণের নোটে বলা হয়েছে যে, রাজ্যগুলির বন দফতরের পাঠানো বনসৃজনের তথ্য শতকরা ৭৫ ভাগই অসত্য! যথাযথ নজরদারি বা সোশ্যাল অডিট না হওয়ায় দুর্নীতি প্রশ্রয় পায়।
ভারতের বর্তমান বনপরিচালনা পদ্ধতি স্পষ্টতই বহুমাত্রিক সমস্যার সমাধানে উপযুক্ত নয়। পরিচালন ব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়োজন, যেখানে জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে জানতে পারছি, আদিবাসী-পরিচালিত জঙ্গল এলাকাতে জঙ্গল ধ্বংস হওয়ার প্রবণতা বন দফতর পরিচালিত বন এলাকার চেয়ে তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। ভারত সরকারের ‘বন অধিকার আইন ২০০৬’ জঙ্গলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জঙ্গলের উপর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই আইনের বলে অধিবাসীরা জঙ্গলে বসবাস করতে পারবেন এবং তাঁদের পার্শ্ববর্তী বন এলাকা নিজেরা পরিচালনা করতে পারবেন। কিন্তু বন দফতর তাদের কর্তৃত্ব ছাড়তে রাজি নয়। তাদের যুক্তি, আদিবাসীদের বনপরিচালনার ক্ষমতা নেই। তাঁরা সেই অধিকার পেলে আরও বন ধ্বংস হবে। কথাটি তথ্যগত ভাবেই ভুল। যে সব জায়গায় আদিবাসীদের বনপরিচালনার অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেখানে তাঁরা অত্যন্ত সফল ভাবে সেই কাজ করছেন। সংরক্ষিত বনদ্রব্য বিক্রি করে তাঁরা নিজেদের জীবনযাত্রার উন্নতিসাধন করছেন, এমন বহু উদাহরণ রয়েছে।
বনকে পণ্য হিসাবে না দেখে সামাজিক বাস্তুতন্ত্র বা ‘সোশিয়ো-ইকোলজিক্যাল সিস্টেম’ হিসাবে দেখতে হবে। স্থানীয় মানুষের হাতে বন পরিচালনার ক্ষমতা দিলে তাঁরা জীবনযাত্রার প্রয়োজন অনুসারে জীবজগৎ সংরক্ষণ করবেন। এতে এক প্রজাতির পরিবর্তে বহু প্রজাতির বন তৈরি হবে এবং জীববৈচিত্র বৃদ্ধি পাবে, যা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর ভূমিকা নেবে। বন সংরক্ষণে সরকারের খরচ কমবে।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy