বিশ শতকের গোড়ায় জাতীয়তাবোধের উন্মেষে মেয়েদের অধিকারের প্রসঙ্গটি তত আলোচিত নয়। মেয়েদের জীবনে জাতীয়তাবোধ কী ভাবে প্রতিফলিত হতে পারে, দেশসেবায় তাঁরা কতটা যোগ দিতে পারেন, সে সিদ্ধান্ত বহুলাংশে নিয়েছে পুরুষসমাজ। উনিশ শতকের ধারণা— নারী অন্দরমহলের বাসিন্দা, ঐতিহ্যের আধার, তার বিশুদ্ধতা অক্ষুণ্ণ রাখা দরকার। সতীদাহ, বিধবাদের আত্মাহুতি হয়ে উঠেছে জাতীয়তাবাদের প্রতীক। কংগ্রেস নেতারা উনিশ শতকের শেষে বুঝেছিলেন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মেয়েদের যুক্ত হওয়া দরকার।
প্রথমে আসেন বিশিষ্ট পরিবারের মেয়েরা। বঙ্গভঙ্গের সময় রাখিবন্ধন বা অরন্ধনে বাড়ির পুরুষদের শর্তসাপেক্ষে মধ্যবিত্তের অন্দরমহল যুক্ত হল। বিভিন্ন স্তরে জাতীয়তাবোধ নানা চেহারা পেল। বিয়ের আগে মেয়েরা পরিবারের কারণে হয়তো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহী, বিয়ের পরে নয়। বাড়িতে ব্রিটিশ কর্মচারী থাকলে অন্দরমহলের কণ্ঠ রুদ্ধ। বিপ্লবী উজ্জ্বলা মজুমদারের বাবা জমিদার, চোদ্দো বছর বয়সি মেয়েকে বিপ্লবীদের দৌত্যে পাঠান। মীরা দাশগুপ্ত ও লীলা নাগের বাবা বিদেশি দ্রব্য বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন, ক্ষুদিরামের মৃত্যুতে উপবাস করেন। রেণু সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের পরিবারও ছিল শাসকবিরোধী।
মেয়েদের কাছে দেশাত্মবোধের যে ধারণা তৈরি হল তাতে মাতৃত্ব বা নারীত্ব বড় কথা। দেশ হল সম্প্রসারিত পরিবার: বিপ্লবীদের গৃহে লুকিয়ে রাখা, সেবা-শুশ্রূষা, গোপনে রাজনৈতিক চিঠি চালাচালি, দেশরক্ষা ভান্ডারে স্ত্রীধন অর্পণ— এ সব করেছেন তাঁরা। আত্মজীবনীতে সতীশ পাকড়াশী লিখেছেন, মেয়েদের রাজনৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক অধিকার না থাকায় তাঁদের দলে আনার পরিকল্পনা ছিল না; মা, বৌদি, স্ত্রী, বোন হিসাবে তাঁরা সাহায্য করেছেন।
গান্ধীবাদী আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকা ছিল সীমিত। গান্ধীজির মেয়েদের প্রতি ভাষণে প্রায়ই সীতা বা মীরার উল্লেখ থাকত। পুরুষদের মদ্যপান থেকে নিবৃত্ত করা মেয়েদের কর্তব্য, তাই অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনে মেয়েরা মদ বিক্রি প্রতিরোধে নিয়োজিত। কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় ও খুরশিদবেনকে গান্ধীজি বলেছিলেন, অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে স্বেচ্ছাসেবিকা নিয়োগ জরুরি এবং শিশুদের দেখাশোনা যেন বিঘ্নিত না হয়। শহরাঞ্চলে মেয়েরা পিকেটিং, বয়কট, আন্দোলন সংগঠন করলেও লবণ আইন আন্দোলন, খাজনা বন্ধের আন্দোলনে গ্রামাঞ্চলে পুরুষের সঙ্গে যোগ দেন মেয়েরা। লবণ সত্যাগ্রহে অগ্রণী ভূমিকা ছিল মেদিনীপুরের মাহিষ্য কৃষক পরিবারের মেয়েদের।
জওহরলাল নেহরু বিশ্বাস করতেন মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া মুক্তি নেই। আবার বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের কথায় পাই, ঘর-গেরস্তালি ও বাইরের রাজনৈতিক জগৎকে একত্রে সামলানো মেয়েদের পক্ষে কঠিন। এই পরিবারের আর এক নারী স্বরূপরানীর মনে হয়েছিল, পরিবারে রাজনীতির আগমন গার্হস্থ ঝড়ের সমান। তবে নেহরু পরিবারের মেয়েরা বুঝেছিলেন, তাঁদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশের মেয়েদের উৎসাহিত করতে পারে।
দেশকে মুক্ত করার মন্ত্র নিয়ে যে মেয়েরা কাজ করেছেন তাঁদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখা হয়নি। তাঁদের যে সহকর্মীরা স্বাধীন ভারতে নেতৃত্ব দিলেন তাঁরাও সে কথা ভাবলেন কই! এই মেয়েরা লাঠি ও ছোরা খেলা, আগ্নেয়াস্ত্র চালানো, বোমা বানানো, ছদ্মবেশে দলের নেতৃত্বের সঙ্গে সংযোগ রক্ষার কায়দাকানুন সবই জানতেন। এঁদের দেওয়া খবরের ভিত্তিতে বিপ্লবী দলের পরবর্তী পরিকল্পনা ঠিক হত, বা তাঁরা গ্রেফতারি এড়াতেন। টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান অভিযুক্তদের অন্যতম পারুল মুখোপাধ্যায়ের অনেক ছদ্মনাম: নীহার, শান্তি, আরতি, শোভারানী, খুকি, সুরমা। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী ইভলিন স্বামীকে বই ও বিপ্লবী ইস্তাহার লেখায় সাহায্য করতেন। বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়েছেন চট্টগ্রামের দুর্গমাঞ্চলে চা-বাগানের ছোটবাবুর স্ত্রী আরতি দেবী।
ট্রেনিং ক্যাম্পে বিপ্লবীদের সাঙ্কেতিক ভাষা, আলোর সঙ্কেত শেখানো হত। ১৯৩৬ সালে বিপ্লবী শান্তিসুধা ঘোষ পুরীতে অন্তরিন থাকাকালীন উলের সেলাইয়ের ফর্মুলা চেয়ে বন্ধুর কাছে চিঠি লিখলেন। বহু দিন পর চিঠি এল, সেন্সরের ছাপ-সহ। উলের ডিজ়াইনকে গোপন কোড বা বোমার ফর্মুলা ভেবে চিঠি গোয়েন্দা পুলিশের হেড অফিস ঘুরে এসেছে।
সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন আভা দে, সুচেতা কৃপালনী, ইরা পাল চৌধুরী, নেলী সেনগুপ্তা, বাসন্তী দেবী, লাবণ্যপ্রভা দত্ত। চব্বিশ পরগনার বহু কৃষক কন্যার মতো প্রাণ দিয়েছেন উত্তমী, সরোজিনী, বাতাসী দাসী। ঢাকা জেলার কংগ্রেস সহ-সভানেত্রী আশালতা সেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে জেলে গিয়েছেন। সুরেন্দ্রনাথ পারিয়ার স্ত্রী ঊর্মিলাবালা পারিয়া চৌকিদার ট্যাক্সের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে পুলিশি প্রহারে নিহত হন, মেদিনীপুর জেলার অন্যতম শহিদ তিনি। কলকাতায় মহিলা সত্যাগ্রহীদের উপর গুলিতে মারা যান প্রতিভা দেবী। পুলিশি প্রহারে নিহত হন সিন্ধুবালা মাইতি, সরসীবালা দাস। ক’জনকে মনে রেখেছি আমরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy