Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
চিনের সঙ্গে লড়াই? ভারতের পক্ষে আদৌ লাভজনক নয়
China

কাশ্মীরে বনভোজনে বেজিং

পুনর্বার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় নিরাপত্তা নীতি নিয়ে যে ভাবে দামামা বাজিয়েছেন শি চিনফিং, তাতে চিন্তিত না হওয়ার তো কোনও কারণ নেই।

শি চিনফিং।

শি চিনফিং। ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২২ ০৫:৫৬
Share: Save:

চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বেশ্বর হয়ে প্রত্যাবর্তনের পর বিদেশনীতিতে শি চিনফিং নতুন মেয়াদের প্রথম বোমাটি ফাটিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের সঙ্গে একটি সুস্পষ্ট ভারত-বিরোধী যৌথ বিবৃতিতে সই করে। ভারতের যাবতীয় আপত্তি সমালোচনাকে নস্যাৎ করা সেই বিবৃতির বার্তা খুবই চোখা। আর দেরি না করে সত্বর পাক অধিকৃত কাশ্মীরে থাবা বসাবে বেজিং, দরকার হলে ইসলামাবাদ ছাড়াও আরও দেশকে (তুরস্ক, আফগানিস্তান) সঙ্গে নিয়ে সেখানের চিনার আখরোট অরণ্যে বনভোজন করবে! এই উদ্যোগের পোশাকি নাম চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর। এই প্রকল্প রূপায়ণে ভারতের কূটনৈতিক আস্ফালনের তোয়াক্কা তো করা হবেই না, বরং বিবৃতিতে হুঙ্কার স্পষ্ট। যে কোনও হুমকি বা ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে তৈরি লাল চিন।

সাউথ ব্লকের থেকে ভাল আর এখন কে জানে প্রিয় যে, অদ্য ফুল খেলবার দিন নয়! বছরখানেক ধরে দেখা যাচ্ছে ছাপান্ন ইঞ্চির বিক্রম বর্তেছে ভারতের বিদেশমন্ত্রীর ছাতিতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর তো আরও বেশি করে। ইউরোপের মুখের উপর তিনি বলে দিয়েছেন, আপনারা মশাই এক বিকেলে যা রাশিয়ান তেল সওদা করেন আমরা তা করি মাসে। অধুনা পরম সখা আমেরিকাকে রক্তের গোলার মতো চোখ তুলে বলেছেন, এত দিন কোথায় ছিলেন! অস্ত্র তো সব বেচে দিয়েছেন পাকিস্তানকে। রাশিয়া যদি না থাকত তবে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার এত দিনে দফারফা। আপনাদের বদান্যতাতেই তো এত বাড় বেড়েছে পড়শির।

কথাগুলি গা-গরম করা, এবং সত্যি বলতে, মিথ্যেও তো নয়! নিরাপত্তা পরিষদের ভোটে এখনও পর্যন্ত ভারসাম্য দেখিয়ে মস্কোর সঙ্গে একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, আন্তর্জাতিক ময়দানে ভারতকে দরকষাকষির ক্ষেত্রটাকে কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে। গত কয়েক মাসে উন্নত বিশ্বের নেতাদের ঘন ঘন ভারত সফরই তার প্রমাণ। কিন্তু চিনকে কী ভাবে কায়দা করে ওঠা যাবে সেই সূত্র কূটনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ভাবে এখনও ভারতের কাছে নেই। বছরে শেষের হালখাতায়, সবচেয়ে বড় লাল দাগ এখনও পর্যন্ত এটাই। যদিও এ কথা মোটেই বলা যাবে না নতুন বছরে ভারতের হাতে রয়েছে শুধু পেনসিল। জি-২০ এবং শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন বা এসসিও-র মতো দু’টি জাঁদরেল গোষ্ঠীর নেতৃত্ব আগামী এক বছর ভারতের হাতে। দু’টির শীর্ষ সম্মেলনই শুধু ভারতে হবে না, বছরভর দেশের বিভিন্ন রাজ্যে চলবে অসংখ্য ইভেন্ট। পর্যটন থেকে সন্ত্রাসবাদ— ভারতের সামনে এক অনন্য সুযোগ নিজেদের শক্তি এবং চ্যালেঞ্জকে বিশ্ববাসীর সামনে এনে তার প্রতিষেধকের জন্য বিভিন্ন ভাবে চাপ তৈরি করা। এসসিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এই গোষ্ঠীতে আধিপত্য চিনের। চিন যেখানে তাদের মহাযোগাযোগ প্রকল্প ওবর নিয়ে শি-এর তৃতীয় দফায় আগ্রাসী হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে, তার মোকাবিলার জন্য ভারতকে আন্তর্জাতিক মতামতকে পাশে আনতে হবে। বোঝাতে হবে যে, এই ওবর শুধুমাত্র চিনের অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক সম্প্রসারণবাদকেই পুষ্ট করবে, বাকিদের তাতে লবডঙ্কা!

পুনর্বার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় নিরাপত্তা নীতি নিয়ে যে ভাবে দামামা বাজিয়েছেন শি চিনফিং, তাতে চিন্তিত না হওয়ার তো কোনও কারণ নেই। ২০২৭-এর সময়-রেখা তিনি এঁকে দিয়েছেন চিনের প্রাচীরে। বলেছেন, ২০২৭-এর মধ্যে চিনা সেনাকে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে হবে। সামনে বিপুল চ্যালেঞ্জের কথা তুলে শি চিনবাসীকে ডাক দিয়েছেন কোনও শক্তির কাছে না ঝুঁকে, তার সর্বসাধ্য মোকাবিলা করতে। ঘরপোড়া রাষ্ট্রগুলি এতে যে যুদ্ধের প্রচ্ছন্ন গন্ধ পাবে তাতে আর আশ্চর্য কী। শি-এর এই নয়া নিরাপত্তা নীতির অন্তত তিনটি দিক। প্রথমত, চিন তার পরমাণু অস্ত্রের ভাঁড়ার গুণগত এবং সংখ্যাগত ভাবে শক্তিশালী করতে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভারসাম্যকে যা উল্টে দিতে পারে। দুই, সেনাসংখ্যা বাড়িয়ে স্থানীয় যুদ্ধের জন্য আরও ভাল ভাবে প্রশিক্ষিত করতে চাইছে। যার অর্থ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা সংলগ্ন অঞ্চলে যে চাপ ভারতকে সহ্য করে যেতে হচ্ছে, তা আরও বাড়বে বই কমবে না। তিন, নৌ-সেনাকে ঢেলে সাজানো, যাতে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে উপস্থিতি স্থায়ী করা যায়। এক কথায়, চতুর্দেশীয় অক্ষ বা কোয়াডের বিরুদ্ধে কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করা যায় ২০২৭ সালের মধ্যে। অর্থাৎ বেজিং-এর উদ্দেশ্য, আমেরিকার বিরুদ্ধে সংঘর্ষের পূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরও হুমকি দেওয়া, যারা ওয়াশিংটনকে ঘিরে ব্লক তৈরি করতে চাইছে।

তাই এ কথা বলাই যায় যে, নতুন শতকের বিশের দশক, ভারতের সমুদ্র এবং স্থলসীমান্তবর্তী এলাকায় নিরাপত্তা পরিস্থিতির একটা মৌলিক পরিবর্তনের সাক্ষী হতে চলেছে। যদিও এর সঙ্গে শি কিছুটা সান্ত্বনা পুরস্কার ঘোষণার ঢঙে বলেছেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তাঁর আগামী দিনের অগ্রাধিকার। কিন্তু চিনা সংলাপের দ্বিচারিতার জন্য অতীত খোঁড়ার দরকার পড়ছে না। উহানের মনোরম লেক, মমল্লপুরমের প্রাচীন স্থাপত্য, অথবা সবরমতীর দোলনার স্মৃতি এখনও টাটকা নরেন্দ্র মোদীর কাছে, যেখানে তিনি ঘরোয়া সংলাপে চিনের সঙ্গে শান্তির পায়রা উড়িয়েছিলেন।

পশ্চিমের দেশগুলি আশায় বসে ছিল, শি তৃতীয় বার ফিরে অপেক্ষাকৃত উদারীকরণের নীতি নেবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছেন চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সর্বাধিনায়ক। জানিয়েছেন, দেশের সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে থাকবে তাঁর দল। সরকারি সংস্থাগুলিকে আরও শক্তিশালী আর ক্ষমতাশালী করা হবে। বেসরকারি উদ্যোগ থাকবে, কিন্তু শি-এর হুঁশিয়ারি, যে সব সংস্থায় বাড়াবাড়ি রকম পুঁজি ক্ষমতা এবং সম্পদের চিহ্ন দেখা যাবে সেখান থেকে দুর্নীতিকে উৎখাত করতে সক্রিয়তা বাড়ানো হবে। এক কথায়, সরকারি বা বেসরকারি, পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে দলের হাতে।

ভারতের কাছে বিষয়টি যেমন সুযোগ নিয়ে আসবে, চ্যালেঞ্জও খাড়া করবে। পশ্চিম এত দিনে বুঝতে পারছে তাদের বিনিয়োগ ও বাজারকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হবে। এই সময়ে প্রযুক্তিগত অংশীদারি এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থায় নিজেদের সুযোগ বেড়ে যাওয়া সম্ভব ভারতের। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, পশ্চিমের সঙ্গে চিনের অর্থনীতির যুদ্ধ যদি আরও কদাকার রূপ নেয়, তবে তা ভারতের জন্য আদৌ সুখকর নয়। আমাদের ওষুধ শিল্প, অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক্স শিল্প এখনও চিনের আমদানি-নির্ভর। ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নির্বাচনী স্লোগানে সুন্দর— চিপ-সহ কাঁচামাল, চিনের আমদানিতে!

আমরা জানি, কূটনীতিতে আলোচনা এবং সংলাপই ঈশ্বর। কাঠের গোল বা আধুনিক লম্বা টেবিল, যুদ্ধক্ষেত্র। শব্দ এবং বাক্য তির এবং ধনুক। কিন্তু সেই বাক্য শব্দ সংলাপকে শক্তি দেয় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তির তুলনামূলক অবস্থান। তাতে যত দিন না বেজিং-এর ধারেকাছে যেতে পারছে নয়াদিল্লি, কা কস্য পরিবেদনা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। চিন-পাকিস্তান বিবৃতি আঁচ করে যেমন ঠিক তার আগের দিন এসসিও সম্মেলনে, বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছিলেন, “সদস্য রাষ্ট্রগুলি (চিন পাকিস্তান) যেন তাদের প্রকল্প রূপায়ণে ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বকে মান্যতা দেয়।”

বেজিং শুনুক বা না শুনুক, আগামী এক বছর এসসিও এবং জি-২০ প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্র হিসাবে ভারতকে এই ভাবেই গলা ফাটিয়ে যেতে হবে।

অন্য বিষয়গুলি:

China Pakistan India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy