ঐতিহ্যময়: বই ছাপার পুরনো প্রযুক্তি, বি জি প্রেস, কাদাপাড়া, ফুলবাগান, কলকাতা
এই প্রবন্ধ আমার লেখার কথা নয়। যার অধিকার ছিল, করোনা তাকে কেড়ে নিয়েছে। বাকি আছি আমরা ক’জন সহযোগী। তাই কলম ধরতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গটা ব্যক্তিতর্পণ নয়, বৌদ্ধিক ও ঐতিহাসিক চর্চা। ছাপা বইয়ের দিন ফুরিয়ে যায়নি, ডিজিটাল যুগেও তার বিস্তার বাড়ছে। কিন্তু বই ছাপার আদি পদ্ধতি, হাতে টাইপ সাজিয়ে হাতে-টানা যন্ত্রের সাহায্যে কাগজে তার ছাপ তোলা, আজ লুপ্তপ্রায়। কলকাতা সম্ভবত বিশ্বের শেষ কেন্দ্র, যেখানে এই প্রযুক্তি এখনও কিছুমাত্রায় টিকে আছে, অভিজাত শিল্পকর্ম হিসাবে নয়, আটপৌরে চাহিদা মেটাতে, প্রধানত হরেক রকম ‘জব প্রিন্টিং’-এর কেজো তাগিদে। এটা শহরের ঢিলেঢালা অনগ্রসর চরিত্রের লক্ষণ হতে পারে, কিন্তু অন্য বিচারে এটাও শহরের এক কৌতূহলকর পরিচয়। এই বিস্মৃতপ্রায় প্রযুক্তি এক সাংস্কৃতিক সম্পদ, যার সদ্ব্যবহার করলে অন্যান্য উপকার ছাড়াও অর্থনৈতিক লাভ হতে পারে।
আমাদের অনেক সম্পদের মতো এটাও কিন্তু হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। গত শতকের শেষেও এমন ছাপাখানা বাংলা জুড়ে বেশ কিছু ছিল, একে একে বাতিল হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির তাগিদে। যন্ত্র, টাইপ ইত্যাদি ওজনদরে বিক্রি হচ্ছে। বছর পনেরো আগে চন্দননগরে এক রীতিমতো প্রাচীন কাঠের প্রেস দেখেছিলাম, শিল্প-পুরাতত্ত্বের নিরিখে অসাধারণ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠগবেষণা কেন্দ্রের তরফে সেটি সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলাম। শুনলাম, মালিকরা বাংলারই একটি সংগ্রহশালায় সেটি দান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বেশ কিছু ঐতিহাসিক যন্ত্র দরদ দিয়ে সংরক্ষণ করেছেন মুদ্রণের দীর্ঘ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী জয়ন্ত বাগচী মহাশয়। এগুলি বিরল ব্যতিক্রম, অধিকাংশ প্রেস বিকোচ্ছে লোহার দরে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই কেন্দ্রে মুদ্রণ নিয়ে চর্চার প্রাণপুরুষ ছিলেন প্রয়াত স্বপন চক্রবর্তী। তাঁর অভাব অপূরণীয়। তা বলে তাঁর চর্চাক্ষেত্রের গুরুত্ব কমেনি, বরং দিন দিন বাড়ছে। কয়েক বছর বাদে সব চর্চাই নিষ্ফল হবে, ইতিহাস হয়ে যাবে প্রত্নতত্ত্ব।
বাংলা তথা ভারতে মুদ্রণের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য স্বপনের কাঁধে বন্দুক রেখে আমাদের ছোট দল প্রচুর চাঁদমারি করেছি। কখনও লক্ষ্যভেদ হয়েছে, প্রায়ই হয়নি। অনেকের স্মরণ থাকতে পারে, ২০০৯ সালে বঙ্গে (কেবল বাংলা ভাষায় নয়) মুদ্রণের বিবর্তন নিয়ে স্বপনের আয়োজিত অসাধারণ প্রদর্শনী, যার বৌদ্ধিক মূল্য একটা প্রামাণ্য চিত্রসম্বলিত গবেষণাগ্রন্থের কম নয়। প্রদর্শনীটি অসাধারণ ছিল অন্য কারণেও। এক, নানা সরকারি-বেসরকারি পক্ষের অকুণ্ঠ সহযোগিতা: রাজভবন, সরকারি ছাপাখানা, বিশ্বভারতী, বহু গবেষক, সংগ্রাহক ও অতীতের দিকপালদের বংশধর। আইসিসিআর তাদের চমৎকার প্রদর্শনশালা খুলে দিয়েছিল। দুই, আমার ঊনপঞ্চাশ বছরের কর্মজীবনে সারস্বত কাজে কর্পোরেট সূত্রে অর্থপ্রাপ্তির এই একমাত্র অভিজ্ঞতা। প্রদর্শনীর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে আমরা আরও স্থায়ী কিছু করার কথা ভাবলাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, মুদ্রণের এই আদি যুগান্তকারী প্রযুক্তির কোনও পূর্ণমাত্রার অনুপুঙ্খ তথ্যচিত্র বা ভিডিয়ো নেই, যত দূর জানি, নেই বিশ্বে কোথাও। (ইউটিউবের হরেক নিদর্শন কোনওটাই পূর্ণাঙ্গ নয়, এবং প্রযুক্তির সামাজিক ও ব্যবসায়িক পটভূমি তুলে ধরছে না।) আমাদের মাথায় চাপল, যাদবপুরের চিত্র ও মিডিয়া চর্চাকারীদের সঙ্গে নিয়ে এই প্রযুক্তির একটা বিশদ ভিডিয়ো দলিল তৈরি করব, কলকাতার প্রেসপাড়ার জীবন্ত প্রেক্ষাপটে। তাতে প্রযুক্তিটার আসন্ন বিলুপ্তির পরও অন্তত ইতিহাসটুকু ধরা থাকবে। ইতিহাস কিন্তু অধরাই থেকে গেল, কারণ অধরা রইল প্রয়োজনীয় অর্থ, অঙ্কটা বিপুল না হলেও। সেই অকৃত দলিলের একটা ক্ষুদ্র বাস্তব দলিল রয়ে গিয়েছে: না-তোলা ছবির জন্য স্বপনের লেখা স্ক্রিপ্ট।
আমাদের আসল স্বপ্ন অবশ্য অন্য ছিল: মুদ্রণের একটা স্থায়ী সংগ্রহশালা গড়ে তোলা। এমন সংগ্রহ আছে পাশ্চাত্যের প্রথম মুদ্রাকর গুটেনবার্গের কর্মক্ষেত্র জার্মানির মাইনৎসে, মুদ্রণের প্রথম যুগের পীঠস্থান অ্যান্টওয়ার্পে। মুদ্রণের আদি জন্মভূমি পূর্ব এশিয়ায় আছে বেজিং-এ আর দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়াংজুতে। বাংলা তথা ভারতে মুদ্রণের ভরপুর ঐতিহ্য, একাধারে প্রযুক্তিগত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক বিকাশ, কোনও সংগ্রহে একত্র করার চেষ্টা হয়নি।
উদ্যোগের গোড়ার দিকে আমাদের উৎসাহদাতা ছিলেন সে সময়ের সত্যিকারের ব্যতিক্রমী রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী। তিনি চেয়েছিলেন সংগ্রহশালা হোক রবীন্দ্র সেতুর অদূরে পুরনো টাঁকশালে: তখনই শোনা যাচ্ছিল, রিজ়ার্ভ পুলিশ সেখান থেকে তাদের বহু দিনের ডেরা সরিয়ে নেবে। রাজ্যপালের প্রচেষ্টাও কিন্তু নিষ্ফল হল।
উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিল যখন জাতীয় গ্রন্থাগার নতুন ভবনে উঠে যাওয়ায় বেলভিডিয়ারের সৌধটি খালি হল। সেটির নতুন ব্যবহারের পরিকল্পনা করতে ইতিহাসবিদ বরুণ দে-র নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন হল। স্বপন চক্রবর্তী তখন জাতীয় গ্রন্থাগারের অধিকর্তা। সিদ্ধান্ত হল, এই ঐতিহ্যমণ্ডিত ভবনটির উপযুক্ত সদ্ব্যবহার হবে কেবল মুদ্রণ নয়, ভাষার সব রকম বাহন ও তার প্রয়োগের এক সংগ্রহশালা স্থাপন করলে: মৌখিক প্রয়োগ (ওর্যালিটি), পুঁথি-পাণ্ডুলিপি, মুদ্রণ, মায় ভাষার বৈদ্যুতিন রূপান্তর। ব্যবস্থা থাকবে বাচনশিল্প অভিনয় প্রভৃতি ভাষার প্রদর্শিত বা ক্রিয়াসিদ্ধ ব্যবহার পরিবেশন করার। এতটা ব্যাপক ক্ষেত্র জুড়ে সংগ্রহশালা কোনও দেশে আছে বলে আমাদের জানা নেই।
পরিকল্পনা রচনার উপদলের প্রধান হিসাবে পরম সমৃদ্ধ হয়েছিলাম। ভারত জুড়ে কেবল ভাষার বৈচিত্র নয়, তার প্রকাশ, ব্যবহার ও সংরক্ষণের কত বিচিত্র পদ্ধতি: সত্যিই কল্পনার অতীত ছিল। সংগ্রহশালার বিন্যাস আর প্রযুক্তি নিয়েও কম শিখিনি। পরামর্শ দিয়েছিলেন একাধিক বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান, সর্বাগ্রে এডিনবরার স্কটিশ জাতীয় সংগ্রহশালা। শেষোক্তটির সঙ্গে ফলপ্রসূ বিনিময়ের সম্ভাবনা ছিল, কারণ কলকাতার সঙ্গে তাদের ছিল পূর্বতন যোগ, প্রবেশদ্বারের দেওয়াললিপিতেই যার উল্লেখ আছে।
খেপে খেপে সংস্কৃতি মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা চলল। গ্রন্থাগারের প্রধান হিসাবে স্বপন ছিলেন তার মুখ্য ভূমিকায়। বিবিধ, কখনও পরস্পরবিরোধী নির্দেশের জট কাটিয়ে কোনও দিন প্রস্তাবটি রূপায়িত হল না। যথারীতি ফাইল চাপা পড়ে গেল। দু’-এক জন কর্তা পরে ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখালেও কখনওই পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা ছিল না। ওই ভবনে এখন অন্যান্য প্রদর্শনী হয়েছে। তার একটির বিষয় বাংলার কিছু মনীষী। খুবই সাধু প্রস্তাব, কিন্তু তার ফলে ‘মিউজ়িয়াম অব দ্য ওয়ার্ড’-এর ঠাঁই জুটল না।
আজ এই স্মৃতিমন্থন এক বিশেষ কারণে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার আলিপুর সংশোধনাগার ও চার পাশের এলাকার রূপান্তরের এক বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটি বিতর্কিত; সেই বিতর্ক এখানে আলোচ্য নয়। তবে বলা হয়েছে, প্রকল্পের একাংশ থাকবে সংগ্রহশালার জন্য, স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে, হয়তো অন্য বিষয়েও। আরও ঘোষণা, অদূরে সরকারি মুদ্রণশালা (বি জি প্রেস) এই প্রকল্পের অংশ হবে, তার জমি নিলামের তোড়জোড় চলছে।
বি জি প্রেস এবং অন্যান্য সরকারি ছাপাখানা মুদ্রণযন্ত্র ও আনুষঙ্গিক সামগ্রীর অমূল্য আকর। সেগুলিও কি নিলাম হবে? যদি হয়, ভারতীয় মুদ্রণের ইতিহাসের উপাদান রক্ষার শেষ সম্ভাবনা অন্তর্হিত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সারা বিশ্ব।
যন্ত্রগুলি এখনও সরকারের হাতে। সরকারি আদেশ ও আবেদনে অবশ্যই আরও নানা সামগ্রী এখনও বিলুপ্তি থেকে উদ্ধার করা সম্ভব। সেগুলি সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের উপযুক্ত স্থান ওই চত্বরেই মজুত, একই প্রকল্পের অংশ হিসাবে। এমন সুবর্ণ সমাপতন বড় হয় না। সর্বভারতীয় স্তরে যা সম্ভব হল না, রাজ্য স্তরে তার অন্তত কিছুটা বাস্তবায়িত করার এই শেষ সুযোগ দু’হাতে গ্রহণ করা জরুরি। এই কাজের উপযুক্ত অনেক উৎসাহী প্রশিক্ষিত তরুণ কর্মী ও গবেষক এই রাজ্যে আছেন। তাঁদের কিছু করতে দিন, গড়তে দিন। বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষা ও তার বিস্তার আজ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বীকৃত কর্মসূচি। এই অমূল্য সংযোজনটি যেন তাতে যোগ্য মর্যাদার সঙ্গে গৃহীত হয়। সঠিক জায়গায় সঠিক সামগ্রী ঘটনাক্রমে মজুত হয়েই আছে, কেবল সাজিয়ে তুলে ধরার অপেক্ষায় আছে তারা।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy