তখন: পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন সনিয়া গান্ধী, মায়াবতী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধী, চন্দ্রবাবু নায়ডু, এইচ ডি কুমারস্বামী, বেঙ্গালুরু, ২৩ মে ২০১৮
এই নিবন্ধের শিরোনাম হতে পারত, ২০২৪ ও ২০০ আসনের গল্প। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীকে হারাতে হলে বিরোধীদের জোট বাঁধতে হবে, এই কথাটা বহু দিন ধরেই রাজধানীর বাতাসে ভাসছে, নতুন কিছু নয়। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগেও একই কথা শোনা গিয়েছিল। কথা কাজে পরিণত হয়নি। আর ঠিক দু’বছর পরে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদ পওয়ার, এম কে স্ট্যালিনরা বেশ কিছু দিন ধরেই বিজেপির বিরুদ্ধে জোটের কথা বলে আসছেন। তৃণমূলনেত্রী কিছু দিন আগে বিরোধী শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতাদের চিঠি লিখে বৈঠকে বসার প্রয়োজনের কথাও বলেছেন। শরদ পওয়ার জানিয়েছেন, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে বিরোধী দলনেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
এত দিন আঞ্চলিক দলের নেতারা যে কথা বলছিলেন, উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব-সহ পাঁচ রাজ্যে ভোটে ভরাডুবির পরে এ বার রাহুল গান্ধীর মুখেও সেই জোটের প্রয়োজনের কথা শোনা গেল। রাহুল বলেছেন, আরএসএস ও নরেন্দ্র মোদীর বিরোধীদের একজোট হতে হবে। কী ভাবে বিরোধীরা এককাট্টা হবেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে বলেও জানিয়েছেন রাহুল। প্রশ্ন হল, বিরোধী জোট কোথায় হবে? কিসের ভিত্তিতে হবে?
গুজরাত, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের সঙ্গেই বিজেপির লড়াই। সেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে আপাত ভাবে কারও জোটের প্রয়োজন নেই। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশার মতো কিছু রাজ্যে আঞ্চলিক দলের সঙ্গে বিজেপির লড়াই। সেখানে বিজেপিকে হারাতে কংগ্রেসের সঙ্গ না হলেও তৃণমূল বা বিজু জনতা দলের কিছু আসে যায় না। প্রকৃত অর্থে বিজেপি বিরোধী দলগুলির জোট প্রয়োজন শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, বিহারের মতো হাতে গোনা রাজ্যে।
লোকসভার রাজ্যওয়ারি আসনের হিসাব কষলে দেখা যায়, এই তিন ক্ষেত্রেই দু’শো আসনের অঙ্কের উপরে পুরো খেলাটা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গত দুই লোকসভা ভোটের ফল খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, দেশের কম-বেশি দু’শো লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের মুখোমুখি লড়াই হয়। আর বিজেপি সেখানেই বাজিমাত করে। গুজরাত, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে কম করে ৯০ শতাংশ আসনই বিজেপি জিতে নেয়। এই দু’শো আসনে আর কোনও আঞ্চলিক দলের উপস্থিতি নেই। ফলে বিরোধী জোটের কোনও প্রাসঙ্গিকতাই নেই। বিজেপির বিরুদ্ধে কোনও নির্বাচনী জোট করে কংগ্রেসের বিশেষ লাভ হবে না। লড়তে হবে একা কংগ্রেসকেই। বিরোধী শিবির এককাট্টা হলে একমাত্র এটুকু নিশ্চিত করা যাবে, তৃণমূল বা আম আদমি পার্টি কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরাবে না।
উত্তর ও পশ্চিম ভারতের তুলনায় পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে বিজেপি অপেক্ষাকৃত দুর্বল। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটি সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করছেন। কিছুটা অগ্রগতি হলেও এখনও সফল হননি। পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার, তার সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, তামিলনাড়ু ও কেরল— এই রাজ্যগুলিতে এখনও বিজেপি শিকড় গেড়ে ফেলতে পারেনি। এই রাজ্যগুলিতেও মোট লোকসভা কেন্দ্রের সংখ্যা সেই দু’শো। নরেন্দ্র মোদীর ঝড় ও অমিত শাহের চাতুর্য দিয়েও বিজেপি এই দু’শো আসনের মধ্যে পঞ্চাশটির বেশি জিততে পারেনি। বিজেপির সাফল্যের কারণ বাকি সাড়ে তিনশো আসন। যার মধ্যে দু’শো আসনে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের মুখোমুখি লড়াই।
বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির নির্বাচনী জোট দরকার আসলে কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং অবশ্যই উত্তরপ্রদেশে। যে সব রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে এক বা একাধিক আঞ্চলিক দলের উপস্থিতি রয়েছে। যেমন মহারাষ্ট্রে বিজেপির বিরুদ্ধে শিবসেনা, এনসিপি, কংগ্রেসের জোট প্রয়োজন। কর্নাটকে কংগ্রেস ও জেডিএস। হিসাব কষলে দেখা যাবে, এই পাঁচটি রাজ্যেও মোট লোকসভা আসনের সংখ্যা দু’শো।
ধরা যাক, বিজেপির বিরুদ্ধে জোট হল। এই পাঁচ রাজ্যের দু’শো আসনে বিজেপি বিরোধী দলগুলি নিজেদের ভোট এককাট্টা করল। যেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির মুখোমুখি লড়াই, সেখানে কেউ কংগ্রেসের ভোটে ভাঙন ধরাতে গেল না। সবাই নৈতিক ভাবে কংগ্রেসকে সমর্থন করল। আবার কংগ্রেসও পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, তামিলনাড়ুতে বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দলের পাশে দাঁড়াল।
এমনটা হলেই কি বিজেপিকে হারানো যাবে?
রাজনীতি ঠিক পাটিগণিত নয়। সেখানে সব সময় দুইয়ে দুইয়ে চার হয় না। শূন্যও হয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল, পশ্চিমবঙ্গ।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সিপিএম নেতারা এখনও প্রকাশ কারাটকে বাংলায় ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসানের জন্য দোষারোপ করেন। কারাট জেদ করে পরমাণু চুক্তি নিয়ে ইউপিএ সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার না করলে বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট হত না। বামফ্রন্টকেও এই ভাবে হারতে হত না।
সিপিএমের নেতারা যেটা স্বীকার করতে চান না, তা হল, শুধু তৃণমূল ও কংগ্রেসের ভোট যোগ হয়ে যাওয়ার ফলে ২০১১ সালে বামফ্রন্টের হার হয়নি। আসলে তখন রাজ্যের মানুষ মনস্থির করে ফেলেছিলেন, সিপিএমকে এ বার ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। যদি শুধু তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট হওয়ার ফলেই বামেদের হার হয়ে থাকত, তা হলে ২০১৬-তে সেই জোট ভেঙে যাওয়ায় ফের সিপিএমের জিতে যাওয়ার কথা ছিল। তা তো হয়নি। সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেও তৃণমূলকে হারাতে পারেনি। উল্টে ২০২১-এ সিপিএম, কংগ্রেস, দুই দলই শূন্যে নেমে এসেছে।
রাজ্যের রাজনীতিতে যাহা সত্য, জাতীয় রাজনীতিতেও তাহা মিথ্যা নয়!
পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ থেকে স্পষ্ট, শুধু নির্বাচনী জোট করে কোনও দলকে হারানো যায় না। রাজনৈতিক জোট দরকার। বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে হলে সেই বিরোধী রাজনৈতিক জোটের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা প্রয়োজন। তার নিজস্ব কর্মসূচি থাকা প্রয়োজন। তা মানুষের সামনে তুলে ধরার মতো নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থাকা প্রয়োজন। মোদী সরকার তথা বিজেপি হিন্দুত্ব, গরিব কল্যাণ, উচ্চবর্ণ-ওবিসি-দলিত ভোটব্যাঙ্কের মিশ্রণে যে রাজনীতি খাড়া করেছে, তার পাল্টা জবাব শুধু বিরোধীরা এককাট্টা হলেই মিলবে না। ‘বিজেপি আমাদের সকলের বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডিকে কাজে লাগাচ্ছে’— এই স্লোগান দিয়ে হয়তো বিরোধীরা এককাট্টা হতে পারেন। কিন্তু শুধু তাতে মানুষের ভোট জেতা যায় না। বরঞ্চ তৃণমূলনেত্রী এখন বেশি সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে গলা ফাটালে মানুষ মনে করতে পারেন, তিনি আসলে দলের নেতাদের দুর্নীতি, হিংসার রাজনীতি ধামাচাপা দিতে চাইছেন।
বিরোধীদের ঝোলায় কিছুই না থাকলে অন্তত মানুষকে মনস্থির করতে হবে, আর নয়, এ বার নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতেই হবে। মোদী সরকারের রাজত্বকাল আট বছর ছুঁতে চললেও এখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে, দেশের মানুষ নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে যে কাউকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসাতে তৈরি। বরং অন্য কেউ প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি নিদেনপক্ষে স্থায়ী সরকার দিতে পারবেন কি না, তাঁর নেতৃত্বে বিরোধীরা একটানা জোটবদ্ধ থাকতে পারবেন কি না, তা মানুষ খতিয়ে দেখবে। কংগ্রেস, তৃণমূল, তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি, বিজু জনতা দল, জেডিএসের মধ্যে এখনও যে অবিশ্বাসের আবহ, তাতে রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা নিজেদের মতো জোটের ডাক দিলেও সংশয় থেকে যায়।
বিরোধীদের দেখাতে হবে, তাঁরা শুধু নরেন্দ্র মোদীকে ক্ষমতা থেকে হটাতে এককাট্টা হচ্ছেন না। সরকারে এলে তাঁরা নতুন কিছু করে দেখাতে পারবেন, যা মোদী সরকার পারেনি। মনে রাখা দরকার, এই বিজেপি শুধুই ভোট চায় না। তাঁরা মানুষকে নিজেদের মতো ভাবাতে চায়, কী খাওয়া উচিত, কী নয়, কাকে ভালবাসা উচিত ও কাকে ঘেন্না করা দরকার, তা-ও মগজে ঢুকিয়ে দিতে চায়। এই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুধু নির্বাচনের জোট নয়, রাজনীতির নীতিগত জোটও দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy