—প্রতীকী চিত্র।
জুন মাসের শুরু থেকেই কেমন যেন চার পাশ ‘পরিবেশপ্রেমী’ হয়ে ওঠে। কারণ, ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস।দিনভর নানা অনুষ্ঠান, সভাসমিতি, আলোচনাচক্রের পাশাপাশি বেশ কিছু ‘প্রতীকী’ অনুষ্ঠানও হয়। পরিবেশ রক্ষায় গুচ্ছগুচ্ছ শপথ নেন মন্ত্রী-সান্ত্রি থেকে আমজনতার অনেকেই। তবে রাত ফুরোলেই সে সব শেষ।
পরিবেশ নিয়ে যতই কথা হোক না কেন, এ দেশের সরকারের কাছে তা এখনও দুয়োরানি। পরিবেশ দফতরের কাজ কিংবা দায়িত্ব বণ্টনের দিকে তাকালেই তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় স্তরে দু’-এক জন পরিবেশমন্ত্রী অবশ্য ‘সক্রিয়’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তবে তাঁরা নিতান্তই ব্যতিক্রম। শোনা যায়, পশ্চিমবঙ্গে এক পরিবেশমন্ত্রীর মূল লক্ষ্য ছিল রামসার তালিকাভুক্ত পূর্ব কলকাতার জলাভূমির উপর দিয়ে উড়ালপুল নির্মাণ! সেই পরিকল্পনা অবশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। কেন্দ্রীয় স্তরেও ছবিটি একই রকম। ‘উন্নয়ন’-এর ছুতোয় অরণ্য, নদী, পাহাড় ধ্বংস হয়েছে। হিমালয়ে একের পর এক বাঁধ তৈরি করে নদীর স্বাভাবিক পথ বন্ধ করা হয়েছে। এই পরিবেশ ধ্বংসের খেসারত দিতে হয়েছে আমজনতাকে, বিশেষ করে আর্থ-সামাজিক ভাবে প্রান্তিক স্তরে থাকা নাগরিকদেরই। দ্য কমনওয়েলথ জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৪ সালের পর থেকে ২০২০ সালের মে মাস পর্যন্ত ভারতের জাতীয় বন্যপ্রাণী পর্ষদের কোনও বৈঠক হয়নি। ওই পর্ষদের চেয়ারম্যান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।
এ দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয়ের গুরুত্ব কতটা, তা দলগুলির নির্বাচনী ইস্তাহারে চোখ বুলোলেই বোঝা সম্ভব। পরিবেশ-সংক্রান্ত বিষয়ের উল্লেখ একেবারেই থাকে না, সে কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, অন্যান্য বিষয় যত জোরালো ভাবে থাকে, পরিবেশ কি তার সিকিভাগ গুরুত্বও পায়? কেউ অবশ্য বলতে পারেন, বেকারত্ব, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি হাজার সমস্যা আছে। নির্বাচনে সেগুলিকে বাদ দিয়ে পরিবেশের কথা বললে মানুষ শুনবে কি? পেটে ভাত না জুটলে পৃথিবী উষ্ণতর হচ্ছে কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ বাড়ছে, এ সব কথা মানুষের শোনার সময় কোথায়?
বেকারত্ব কিংবা অন্যান্য সমস্যা যে মানুষের কাছে অনেক বেশি প্রকট, সে কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যদি পৃথিবী ক্রমাগত ধ্বংসের দিকে এগোয়, যদি বেঁচে থাকার পরিবেশ না-থাকে, তা হলে ভোটই বা দেবে কে, কর্মসংস্থান কিংবা উন্নয়নের সুযোগই বা নেবে কে? পরিবেশের সঙ্গে অর্থনীতি, জীবনযাত্রা ইত্যাদির যে ওতপ্রোত সম্পর্ক, সে কথা কি রাজনৈতিক তরজায় এসেছে? দিনভর রাজনৈতিক বিতর্কে যত শব্দ নানাবিধদুর্নীতি নিয়ে ওঠে, তার ছিটেফোঁটাও পরিবেশ-সংক্রান্ত অনিয়ম কিংবা ‘উন্নয়ন’-এর ধাক্কায় পরিবেশ-দুর্গতদের নিয়ে হয় না। মনে হয়, পরিবেশ-দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিলিই বুঝি রাষ্ট্র এবং সমাজের একমাত্র কর্তব্য!
নাগরিক সমাজের মুষ্টিমেয় লোক যে পরিবেশের কথা ভাবেন না, বা পরিবেশ আন্দোলনে শামিল হন না, এমন নয়। পরিবেশকর্মীদের বিভিন্ন সংগঠন আছে, তারা নিজেদের মতো চেষ্টা করে। কোথাও তা আঞ্চলিক স্তরে, কোথাও বা একদমই স্থানীয় স্তরে। সম্প্রতি সংবাদপত্রেই একটি ছোট খবর চোখে এসেছিল। সোদপুর এলাকায় নাগরিকদের চাপেই একটি পুরনো জলাশয় বেঁচে গিয়েছে। তার রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করেছে প্রশাসন। তবে এই ধরনের ঘটনা বোধ হয় ‘বিচ্ছিন্ন’ উদাহরণ। তা না হলে যে ভাবে শহর এবং শহরতলিতে গাছ কমছে, তাতে নাগরিকদের মধ্যে সেই উদ্বেগ তো চোখে পড়ে না। উল্লেখ্য, যশোর রোডে ‘উন্নয়ন’-এর শিকার হচ্ছে বহু প্রাচীন মহীরুহ। তাদের বাঁচাতে নাগরিকদের অনেকে একজোট হয়েছেন। কিন্তু যশোর রোডের দু’ধারের জনপদে ওই গাছ বাঁচাতে বড় মাপের প্রতিক্রিয়া এখনও সে ভাবে চোখে পড়েনি। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে ওই গাছেদের মৃত্যু কোনও প্রশ্ন হয়ে উঠবে বলেও মনে হয় না। নিত্যদিন যে ভাবে নাগরিকেরাও আইনের ফাঁক গলে কিংবা প্রশাসনিক ঔদাসীন্যের দৌলতে পরিবেশকে নষ্ট করছেন, তাতে গাছের মৃত্যু কিংবা পরিবেশের ধ্বংস ভোটের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, এমন ভাবা মুশকিল।
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু বদলের মোকাবিলায় বার বার বৈঠক করেছেন রাষ্ট্রনেতারা। চলতি বছরের শেষে দুবাইয়ে ফের এক দফা বৈঠক হবে। সেই সব বৈঠকের ফলাফল কী, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠেছে। বস্তুত, পৃথিবীকে যে বাঁচাতে হবে, এ নিয়ে রাষ্ট্রনেতারা কখনও দ্বিমত হননি। শুধু কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের দায়িত্ব কে নেবে, তা নিয়েই যত বিতণ্ডা। উন্নত বনাম উন্নয়নশীল দুনিয়ার কূটনৈতিক দড়ি টানাটানি শেষে কিছু সমাধানের পথ বেরিয়েছে। সেই পথে হাঁটার জন্য গালভরা আশ্বাস দিয়ে চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে সমাধানের ‘পথে’ পথিক কি হতে পেরেছেন রাষ্ট্রনেতারা? কেউ কেউ অবশ্য বলতেই পারেন, এক দিনে তো হবে না। সমাধানের পথে হাঁটছে তো ভারত-সহ বিভিন্ন দেশ।
গুটিগুটি পায়ে এগোচ্ছে। কিন্তু ‘কতটা পথ পেরোলে’ তবে সত্যিই ‘পথিক বলা যায়’?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy