Sourced by the ABP
নিওন আলোয় পণ্য হলো যা-কিছু আজ ব্যক্তিগত।” চল্লিশ বছর আগে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের পঙ্ক্তিতে অমোঘ যাথার্থ্যে লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। আজ বিজ্ঞাপনের নিয়ন আলো বসেছে পিছনের বেঞ্চে, আর ব্যক্তিগত প্রায় সব কিছুই বাজারি হয়ে গিয়েছে আন্তর্জালে— সমাজমাধ্যমে আমাদের ‘আমার মতন সুখী কে আছে’ প্রমাণ করার নিরন্তর প্রবল তাগিদে। তাই আমাদের মোবাইল, ট্যাবলেট বা ল্যাপটপের ইন্টারনেট ব্রাউজ়ারটি আজ আমাদের চেনে একান্ত আপনজনের চেয়েও অনেক বেশি। আন্তর্জালে আপনি কী খুঁজছেন, কত বার একটি বিশেষ ওয়েবসাইটে ক্লিক করছেন, এ সব তথ্য সে শুধু একেবারে নিয়মিত সংগ্রহই করে তা নয়, অনর্গল সরবরাহ করে বৈদ্যুতিন ব্যবসাদুনিয়ার ই-রিটেলরদের। যে সংস্থা সেই তথ্য কিনতে চায়, তাকেই। আর, আমরা নিজেদের অজানতেই নিঃশব্দে বিদেশি বহুজাতিকের সেলস-টার্গেট পূরণের মাধ্যম হিসাবে কাজ করি।
এদের অন্তঃসলিলা বিজ্ঞাপনের স্রোত আন্তর্জালের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অজানতেই আমাদের অনেক বেশি প্রভাবিত করে। যিনি যেটা খুঁজছেন বা ভালবাসেন, তাঁর ইন্টারনেট ঘাঁটার ইতিহাস বিশ্লেষণ করে, কৃত্রিম মেধাসঞ্জাত গণনপ্রক্রিয়া প্রয়োগ করে তাঁর নাকের ডগায় সেগুলো ঝুলিয়ে দিতে হবে— এটাই মোদ্দা কথা। এর জন্য ভোক্তাদের আজকাল কষ্ট করে গুগল ক্রোম-এ গিয়ে ব্রাউজ় করার কিংবা ফেসবুকের দ্বারা প্রস্তাবিত অসংখ্য পাতায় ঘুরে বেড়ানোরও দরকার পড়ে না— বাড়ির একাধিক ফোনে সিরি, গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট কিংবা বাড়িতে অ্যামাজ়ন-এর অ্যালেক্সা-র মতো কণ্ঠস্বরভিত্তিক যন্ত্র-সঙ্গী সক্রিয় থাকলেই যথেষ্ট। আজ যদি রাতে খেতে বসে গিন্নিকে বলেন, “এ বার কিছু নতুন টি-শার্ট কিনতে হবে, পুরনোগুলোর রং চটে গিয়েছে,” কয়েক বার টি-শার্ট শব্দটি যদি দু’জনেই উচ্চারণ করেন, কালকেই আপনার মেল-বক্সের কিনারা ঘেঁষে, ইউটিউব ভিডিয়ো শুরুর আগে, এবং ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে আপনি হরেক কোম্পানির টি-শার্টের বিজ্ঞাপনে ভেসে যাবেন। বাড়িতে থাকা ধ্বনি-নির্ভর যন্ত্র-সঙ্গী আপনাদের কথোপকথনের মধ্যে থেকেই টি-শার্ট নামক কিওয়ার্ডটি তুলে নিয়ে, সেই প্রয়োজনের কথা ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে চুক্তিবদ্ধ একাধিক বাণিজ্যিক সংস্থাকে।
এ অবশ্য ব্যবসার একেবারে গোড়ার কথা: জিনিসপত্র কেনা হয় না, গছানো হয়। অর্থাৎ, যে চাহিদা নেই, তাকে তৈরি করে নিতে হয়। তার জন্য অবশ্যই মানুষের লোভকে ইন্ধন জোগানো, এবং ব্যক্ত/অব্যক্ত সব রকম ইচ্ছা অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দেখানোর বিরাট তাগিদ রয়েছে। এগুলোর বাস্তবায়ন ঘটছে ইন্টারনেটের এক অদৃশ্য, সমান্তরাল দুনিয়ায়, যেখানে আমরা সবাই বিমূর্ত ভাবে উপস্থিত আছি আমাদের অনেক সহজলভ্য অথচ বিপজ্জনক তথ্য নিয়ে। কিন্তু, বিজ্ঞাপন কি শুধু পণ্য বেচে? রাজনীতির কারবারিরাও এখন এই ডিজিটাল বিপণনের পথের পথিক— ‘নেটিজ়েন’-দের অবিরত গিলিয়ে চলা হচ্ছে সত্য, অর্ধ সত্য এবং ডাহা মিথ্যা ‘তথ্য’-র মিশ্রণ, যাতে তাঁরা প্রভাবিত হন সেই রাজনীতির দ্বারা। এই খেলারই আরও মারাত্মক দিক হল নজরদারি— যিনি বা যাঁরা মেরুদণ্ড সোজা রেখে প্রশ্ন করতে পারেন, তাঁদের চিহ্নিত করার জন্য আজকাল আর আনাচেকানাচে ব্ল্যাক শার্ট বাহিনী মোতায়েন রাখার দরকার পড়ে না, একটা মোটামুটি অর্ধশিক্ষিত আইটি সেল থাকাই যথেষ্ট। ইন্টারনেট ক্রিয়াকলাপের প্যাটার্ন ধরে ফেলা যায়, কে বা কারা বেসুরো গাইছেন বা গাইতে পারেন। ব্যবসা অক্ষুণ্ণ রাখতে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলি সরকারপক্ষকে নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে দেয় আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য, নিয়ন্ত্রণ করে বিরুদ্ধ স্বর। স্বঘোষিত ‘বিশ্বগুরু’র প্রতি সামান্য সমালোচনামূলক কোনও ফেসবুক পোস্টেরও রীতিমতো অ্যালগরিদম মেনে রিচ কমিয়ে দেওয়াটা কোনও সম্ভাবনা নয় আর, বরং ঘোর বাস্তব।
২০১৬ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারি কর্তৃপক্ষ ‘পোস্ট-ট্রুথ’ বা উত্তর-সত্য শব্দটিকে বছরের সেরা শব্দের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সাংবাদিক ম্যাথিউ ড্যানকোনার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই উত্তর-সত্য আসলে যাঁকে পরিবেশন করা হচ্ছে, তাঁর ধর্মীয়, জাতিগত, বা অন্য কোনও আবেগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু বাছাই করা সত্য, প্রেক্ষিতহীন অর্ধসত্য, এবং অনেকটা মিথ্যের জটিল সংমিশ্রণে এক ধরনের নিয়মত্রান্ত্রিক ধারণা নির্মাণ। আজকের দিনে যখন সৃষ্টিশীল কৃত্রিম মেধার কল্যাণে বানিয়ে ফেলা যায় অবিকল বাস্তবানুগ নকল লেখা, ছবি, কণ্ঠস্বর, বা ভিডিয়ো, তখন এই উত্তর-সত্যের নির্মাণ অনলাইন ও সমাজমাধ্যমকে কত সহজে এবং কতটা দূষিত করবে, সেটা বুঝতে সমস্যা হয় না। ২০১৬-তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা-র পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গেই লক্ষ করা গেল সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে থাকা ব্যবহারকারীদের তথ্য চুরি এবং সেখান থেকে তাঁদের মানসিক ছাঁচ চিহ্নিত করে ভোটের স্বার্থে তার ব্যবহার। গড়ে উঠল রাজনৈতিক মতামত নির্মাণের অনেক কারখানা। বিপুল লগ্নির উপরে দাঁড়িয়ে থাকা এই উত্তর-সত্যের কারখানার এন্ড-প্রোডাক্ট হিসাবে ক্ষমতার চূড়াতে থাকা মুষ্টিমেয় মানুষের মর্জিমাফিক উৎপাদিত ধ্যানধারণা ছড়িয়ে পড়ল আমাদের সভ্যতায়। গত সাত বছরে যন্ত্রমেধা ও মোবাইল প্রযুক্তির হাত ধরে এই বিষ পৌঁছে গিয়েছে সমাজের প্রত্যন্ততম প্রান্তে, গভীরতম বিন্দুতে।
২০২৩-এ ভারতে মোটামুটি ৭১% মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। এঁদের একটা বিরাট অংশ ইন্টারনেটের অন্ধকার জগৎ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থেকেও হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকের মতো সমাজমাধ্যম ব্যবহার করছেন প্রতি দিন। ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে বিজেপির তদানীন্তন নেতা কপিল মিশ্রের এনআরসি-সিএএ’র প্রতিবাদকারীদের জমায়েত জোর করে ভেঙে দেওয়া সংক্রান্ত বক্তব্যের একটি ভিডিয়ো ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর কী ভাবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রক্তাক্ত হয়েছিল রাজধানী, তা ভোলা অসম্ভব। একই ভাবে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্পর্বে মুজফ্ফরপুর বা বেঙ্গালুরুর মতো জায়গায় সমাজমাধ্যমে ঘুরে বেড়ানো উস্কানিমূলক ভ্রান্ত তথ্যের দরুন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানো বা গত চার বছরে সমাজমাধ্যমে ঘৃণাসূচক মন্তব্য ও মাল্টি-মোডাল তথ্যের অপব্যবহারের দরুন গণপ্রহারে হত্যার ত্রিশটিরও বেশি নথিবদ্ধ ঘটনাও অনেকের মনে থাকবে। এক আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থার সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ভারতে ভুয়ো তথ্যের মূল চালিকাশক্তি হল ধর্মীয় ঘৃণা আর উগ্র জাতীয়তাবাদ, যার কেন্দ্রে রয়েছে ‘লাভ জেহাদ’ বা ‘ঘর ওয়াপসি’-র মতো সব কিওয়ার্ড। প্রথম বিশ্বের ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মতো শুধু মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নয়, সমাজমাধ্যমকে রমরমিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে এই উগ্র জাতীয়তাবাদকে সামনে রেখে সমাজেরই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে হিংস্র জনমত গঠনের কাজেও। ২০১৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ভারতে যত শতাংশ মানুষ ‘ফেক নিউজ়’-এর দ্বারা প্রভাবিত হন, সেই অনুপাতটি বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে খানিকটা হলেও বেশি।
আরও একটি লোকসভা নির্বাচনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও আমরা কি কিছু শিখলাম? এখনও ‘মিডিয়া লিটারেসি’ শব্দটি কি জায়গা করে নিতে পারল আমাদের স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমের কোথাও? অথচ আমেরিকার বেশ কিছু স্টেটে, এবং ইউরোপেও স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের আজ শেখানো হয় সমাজমাধ্যমে ভেসে বেড়ানো আসল ও নকল খবরের মধ্যে পার্থক্য করতে, ঘৃণা এবং উস্কানিমূলক মন্তব্য চিহ্নিত করে রিপোর্ট করতে। তাদের ওয়াকিবহাল করা হয় ইন্টারনেট ব্যবহারের বিপদ ও প্রয়োজনীয় সতর্কতার ব্যাপারে; জানানো হয় ওয়েবসাইটে ঢোকার তাড়নায় কখনও প্রযোজ্য শর্তাবলি না পড়ে সব মেনে নেওয়ার বাটনটিতে ক্লিক করতে নেই; শেখানো হয় কতটা ব্যক্তিগত তথ্য জনপরিসরে রাখা উচিত ইত্যাদি। আমাদের তরুণ প্রজন্ম ছোটবেলা থেকেই স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এবং সমাজমাধ্যমে অভ্যস্ত। নিছক সমালোচনা বা যথেষ্ট ফাঁক-যুক্ত কিছু আইনের দোহাই না দিয়ে, আমরা কবে উদ্যোগী হয়ে উঠব ইন্টারনেটের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো বাঘ-কুমিরের হাত থেকে এদের বাঁচাতে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy