প্রশ্নহীন: শিশুটিকে গাড়ি পিষে দিয়ে চলে যাওয়ার পর তার পরিবার, কলকাতা, ৩১ জুলাই। স্বাতী চক্রবর্তী
আট বছরের তৃষা দত্ত ফুটপাতে ঘুমোচ্ছিল। শনিবার রাত্রি সাড়ে আটটা নাগাদ একটি চার চাকার গাড়ি বহুতল বাড়ির বেসমেন্ট থেকে উঠে এসে তার ঘুমন্ত শরীরকে বেমালুম পিষে দিয়ে গেল। রক্তাক্ত বালিকা হাসপাতালে পৌঁছল এবং অচিরেই মারা গেল। প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, ওখানে নীচ থেকে খাড়া পথে ওঠার সময় সামনের রাস্তায় কী আছে সেটা পুরোপুরি দেখা যায় না, চালক হয়তো ঘুমন্ত শরীরটাকে দেখতে পাননি। হতে পারে। অন্য দিকে, গাড়িটি নাকি বেশি জোরে উঠছিল, গতি কম থাকলে হয়তো সামলানো যেত। হতেই পারে। আবার, গাড়ি ঢোকা ও বেরোনোর ব্যবস্থা তদারকির জন্য যে কর্মীর ওখানে মোতায়েন থাকার কথা, তিনি এই ঘটনার সময় কী করছিলেন সেটাও বড় প্রশ্ন। তাঁকে নাকি জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ওই বহুতলের নিরাপত্তা কর্মীদের সতর্ক করা হয়েছে, যাতে এমন দুর্ঘটনা না ঘটতে পারে। ফুটপাতবাসীরা যাতে সামনের রাস্তায় না থাকেন সেটাও দেখতে বলা হয়েছে। মোটের উপর— ধৃতরাষ্ট্রই সত্য— ঘটেছে যা ছিল ঘটিবার, ফলিবে যা ফলিবার আছে।
সোমবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার বিবরণ, প্রতিবেশীদের বক্তব্য, পরিবারের প্রতিক্রিয়া। মেয়েটির বাবা নেই, মা রান্নার কাজ করে সংসার চালান। তৃষা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত, সে-দিনও পড়াশোনা সেরে শুয়ে পড়েছিল, শরীরটা নাকি ভাল ছিল না। লেখাপড়ায় মন ছিল মেয়েটার, রাস্তার আলোতেও পড়াশোনা করতে দেখা যেত তাকে, কপাল ভাল হলে কোনও দিন হয়তো তার ছবি কাগজে ছাপা হত, ক্যাপশনে উল্লেখ থাকত বিদ্যাসাগরের। কিন্তু কপাল অন্য রকম, অতএব অন্য ছবি ছাপা হল। তার মুখটা ছোট আকারে, পাশে শোকার্ত স্বজনদের বড় ছবি, তাঁদের চোখেমুখে এক গভীর শূন্যতা, সে-দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দুঃখ, কষ্ট বা হাহাকারের মতো শব্দগুলোকে অর্থহীন অসার শব্দমাত্র মনে হয়। বরং ভয় করে।
কিসের ভয়? অনাদ্যন্ত মধ্যবিত্ত মনে সব ভাবনাই নিজের চার পাশে পাক খায়, তাই নিজের ভীতিবোধটাকে নিয়েই ভাবতে চেষ্টা করছিলাম। যদি এই মৃত্যু থেকে সমবেত ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠার আশঙ্কা থাকত, তা হলে ভয়টাকে সহজেই মেপে নেওয়া যেত। ‘ওদের’ ক্ষুব্ধ প্রত্যাঘাতে ‘আমাদের’ সামাজিক সুস্থিতি নষ্ট হলে ভয় তো হবেই। কিন্তু কোনও প্রত্যাঘাতের চিহ্নমাত্র তো ওই ছবিতে নেই, নেই ওই পথবাসী মানুষগুলোর প্রতিক্রিয়াতেও। তাঁরা ক্রোধে জ্বলে ওঠেননি, ভেঙে দেওয়ার গুঁড়িয়ে দেওয়ার ডাক দেননি, এমনকি সাংবাদিকের সামনেও আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটাননি। মেয়ে-হারানো মা কেবল প্রশ্ন তুলেছেন, “যে গেট দিয়ে গাড়িটা বেরোয়, মেয়েটা তো শুয়েছিল তার এক ধারে। তবু কী ভাবে...” এবং জানিয়েছেন তিনি, প্রতি দিন ওখানেই সবাই ঘুমোন, গাড়ি আসছে জানালে সরে যান, সে দিন কেউ জানায়নি, তার উপর অন্ধকার ছিল, মেয়েটাকে অমনি পিষে দিয়ে গেল? এই প্রশ্নে যে যন্ত্রণা নিহিত, তার তল পাই না, পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, এ-যন্ত্রণা বুঝতে চাইবার নির্বোধ স্পর্ধা নেই। শুধু এইটুকু মনে হয় যে, এই জননী এবং তাঁর পাশের মানুষগুলো ক্ষোভে ফেটে পড়বার সাধ্যও হারিয়েছেন। কিংবা, তাঁরা আপন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জেনে গিয়েছেন, ক্ষোভ প্রকাশের অধিকার তাঁদের নেই, তার কোনও অবকাশও নেই।
বাস্তববাদী সহনাগরিক বলবেন, এ-সব ভেবে লাভ কী? শহরের রাস্তায় লোকে বাস করবে, দিনে রাঁধবে, রাতে ঘুমোবে, এমনটা চললে— চলতে দেওয়া হলে— মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে, কী করা যাবে? তাঁরা খেয়াল করিয়ে দেবেন যে ওই পথবাসীরা নিজেরাও জানেন রাস্তাটা সংসার পাতার জায়গা নয়, তাই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটলেও মনের বেদনা মনে চেপে ভবিতব্যকে মেনে নেন। বাস্তববাদ নির্ভুল, অব্যর্থ, মোক্ষম। আর ভয়টাও সেই কারণেই এত বেশি ঘাড়ে চেপে বসে। মেনে নিয়ে নিয়ে দিন গেল মেনে নিতে, সে-কথা তো অনেক কাল আগেই জেনেছি আমরা। এখন যেন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, মেনে নেওয়া কেবল আমাদের ইতিহাস নয়, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎও বটে। মধুবংশীর গলি-তে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র বলেছিলেন কলোনির কেরানিরক্তে প্রচণ্ড দোলা-দেওয়া স্থির প্রতিজ্ঞাগুলির কথা: ‘আমাদের প্রত্যেকের ইঁদুরের মতো মরাই শেষ নয়/ তার পরেও মহত্তম ভবিষ্যৎ’। আজ মনে হয়, মহত্তম ভবিষ্যতের কল্পনাও ‘তিরস্কৃত, পলাতক, দিশাহীন দূরে’, আমরা যে যার মধুবংশীপুরে আছি বেশ। আর, ইঁদুরের মতো মরাই যাঁদের শেষ কথা, তাঁরাও মেনে নিয়েছেন, মানিয়ে নিয়েছেন। এই কথাটা ভাবলে চেতনায় এক শিরশিরে ঠান্ডা টের পাই, ভয় হয়। শান্তিকল্যাণের ভয়। অনড় অচল জগদ্দল শান্তিকল্যাণ।
এক দিন ভাবতাম, ঠিক আছে, অনেক লোককে রাস্তাতেই থাকতে হবে, এই কঠোর সত্য না-হয় মেনে নেওয়াই গেল। শ্রাবণের মুষলধারায় অন্ধকার রাত্রিতে ‘হায় পথবাসী হায় গতিহীন হায় গৃহহারা’ শুনতে শুনতে না-হয় সেই কঠোর সত্যকে একটা তূরীয় উপলব্ধির স্তরে উন্নীত করে আত্মসংস্কৃতির শিল্পসম্মত অনুশীলন করা গেল। তাঁদের জীবন ও জীবিকার দায়িত্ব কে নেবে, সেই প্রশ্নও না-হয় ভুলে গেলাম, কিংবা— একই কথা একটু কায়দা করে বললে— বাজারের হাতে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তাঁদের একেবারে মেরে ফেলার ব্যাপারটা কি বন্ধ করা যায় না? আর কিছু না-করা যাক, যখন-তখন বেঘোরে গাড়ি চাপা পড়ে মরে যেতে হবে, এটা কি অনিবার্য? বহুতল আবাসনের সিংহতোরণ দিয়ে রাস্তায় গাড়ি বেরোবার সময় তো সাধারণ নিয়মেই তার চার পাশটা দেখাশোনা করা জরুরি, রাস্তায় কেউ শুয়ে না-থাকলেও জরুরি। অথচ অনেক সময়েই সেই ব্যবস্থা কাজ করে না, নিরাপত্তা কর্মী থাকলেও করে না। তার জন্য সর্বদাই কর্মীদের দায়ী করলে অন্যায় হবে, তাঁরাও মানুষ, এবং খরচ কমানোর তাগিদে বহু ক্ষেত্রেই কর্মীর সংখ্যা কমানো হয়েছে, যাঁরা কাজ করেন তাঁদের উপর অমানুষিক চাপ বেড়েছে। এটা বাজারের লীলা। যে বাজার প্রত্যেকটা বড় শহরকে আরও বড় করে তোলার প্রক্রিয়ায় অগণন মানুষকে পথে বসাচ্ছে বা নির্বাসিত করছে, তারই লীলা। অঙ্কটা সহজ ও সরল— যাদের প্রাণ বাজারের কাছে মূল্যহীন, বাজার তাদের বাঁচাতে উদ্যোগী হবে না।
অন্য দিকে, দরিদ্র, সর্বস্বান্ত, সম্পূর্ণ অ-সহায় নগরবাসীর ন্যূনতম নিরাপত্তার কথা ভাবা যাঁদের কাজ? প্রশাসক? রাজনীতিক? তাঁরা ওঁদের জীবনকে গুরুত্ব না দিন, অন্তত মৃত্যুকে যদি গুরুত্ব দিতেন, তা হলে এই ধরনের বিপর্যয় রোধের সম্ভাবনা অনেকটাই বাড়ত। সে জন্য আবশ্যক ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর নিয়মিত নজরদারি, সেই ব্যবস্থার শর্ত লঙ্ঘিত হলে প্রয়োজনীয় প্রতিকার ও শাস্তিবিধানের তৎপরতা। সেটা করা যাবে না কেন? এক দিন এই সব ভাবতাম। এখন আর ভাবি না, কারণ দেখেশুনে বোধিলাভ ঘটে গিয়েছে। রাজ্য বা শহরের অভিভাবকের আসনে যাঁরা বসেন, তাঁরা ভোটের দায়ে অথবা তুমুল বিরোধিতার চাপে না পড়লে কিছু করেন না, করবেন না। ভোটের বাজারে তৃষা দত্তদের দাম নেই, তাদের নিয়ে বিরোধী রাজনীতিরও মাথাব্যথা নেই— এক কালে হয়তো কিছুটা ছিল, তে হি নো দিবসা গতাঃ। সুতরাং হঠাৎ হঠাৎ কোনও গাড়ি এসে ওঁদের চাপা দিয়ে যাবে।
ওঁরা সেটা ঠিকঠাক বুঝে নিয়েছেন। তাই যতটা পারেন নিজেরা নিজেদের আগলে রাখেন, একে অন্যকে গাড়ি-চাপার বিপদ থেকে এবং আরও লক্ষ রকমের বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন, তা না হলে বেঁচেই থাকতে পারতেন না। অনন্ত বিপন্নতার সঙ্গে এই নিরন্তর লড়াইয়ে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হবে, সে ওঁরা জানেন। তাই ওই শীতল শূন্যতার ছবি দেখে আমরা ভয় পেলে ওঁদের কিচ্ছু যায় আসে না। বরং কঠিন বাস্তববোধের কারণেই তৃষার সৎকার করে এসে তাঁরা হয়তো প্রতিজ্ঞা করেন, কেউ ঘুমিয়ে থাকলে অন্য কাউকে আরও সজাগ থাকতে হবে। এক কালে মানুষ রাত্রিতে পালা করে জেগে থাকত, আগুন আবিষ্কারের পরে আগুন জ্বালিয়ে রাখত, বিপদের হাত থেকে বাঁচতে। আধুনিক শহরের নিশাচর বিপদও তো কোনও অংশে কম নয়।
এই সমবেত আত্মরক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে কি এক দিন অন্য ধরনের সংহতির বোধ তৈরি হতে পারে? সেই বোধ গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই কি নতুন রাজনীতি নির্মাণ করা যায়? জানি না। তবে একটা কথা মনে হল— আমাদের পূর্বপ্রজন্মের সেই মানুষেরা হয়তো সমবেত রাত্রিজাগরণের কালেই বুঝেছিলেন, আগুন কেবল ভয় দেখায় না, অন্য কাজেও লাগে। এই কথাটা মনে হওয়ার পরে ভয়ের বোধটা যেন একটু কমল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy