অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস লিখেছিলেন, ব্যাঙ্কের যদি আপনার কাছে কয়েক হাজার টাকা পাওনা থাকে, তবে তা আপনার সমস্যা। কিন্তু ব্যাঙ্কের যদি আপনার কাছে কয়েক কোটি টাকা পাওনা থাকে, তবে তা ব্যাঙ্কের সমস্যা। আপনি যদি গাড়ি বা বাড়ির একটি ইএমআই না দিয়ে উঠতে পারেন, তবে ব্যাঙ্ক আপনার জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে। কিন্তু আপনি যদি ব্যাঙ্কের থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বেমালুম চেপে যান, তা হলে?
তা হলে কী হবে, তার উদাহরণ হিসেবে ভিডিয়োকন গ্রুপের কথা বলা যেতে পারে। তাদের কাছে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের মোট বকেয়া ৬৪,৮৮৩ কোটি টাকা। ভারতের নতুন দেউলিয়া আইনের আওতায়, ভিডিয়োকন গ্রুপকে কিনে নিচ্ছে বেদান্ত গ্রুপের অধীন আর একটি সংস্থা, যারা ব্যাঙ্কগুলিকে মোট ২,৯৬২ কোটি টাকা দিচ্ছে। অর্থাৎ, ভিডিয়োকন ধার নিয়েছিল প্রায় ৬৫,০০০ কোটি টাকা, আর ব্যাঙ্কগুলি তার থেকে ফেরত পাচ্ছে মাত্র ২,৯৬২ কোটি। ভারতের বর্তমান পুঁজিবাদে এই হচ্ছে আপনার আর কর্পোরেটের তফাত। তবে, ব্যাঙ্ক অব মহারাষ্ট্র এই চুক্তির বিরোধিতা করায় আপাতত লেনদেনের উপর স্থগিতাদেশ জারি হয়েছে। কিন্তু, এই কাহিনিতেই বর্তমান ভারতে ব্যাঙ্কের অনাদায়ি ঋণের টাকা ফেরানোর প্রক্রিয়ার সার্বিক ব্যর্থতা লুকিয়ে রয়েছে।
ভারতের নতুন দেউলিয়া সংক্রান্ত আইন ২০১৬ সালে শুরু হয়, যার মাধ্যমে মনে করা হয়েছিল যে, অনাদায়ি ঋণের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এই আইনকে হাতিয়ার করে ব্যাঙ্কগুলি ঋণখেলাপি সংস্থার কলার চেপে ধরে টাকা আদায় করতে সক্ষম হবে। কিন্তু বাস্তবে কী হয়েছে? ২০২১ সালের মার্চ অবধি মোট ৪,৩৭৬টি সংস্থার বিরুদ্ধে এই আইনের আওতায় প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই আইনে ব্যাঙ্কগুলি কয়েকটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাতক সংস্থার থেকে টাকা আদায় করতে পারে। প্রথমত, ব্যাঙ্ক এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাটি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে কিছু টাকার লেনদেন করে সমস্যা মেটাতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় ১৬% সংস্থা সমস্যার সমাধান করেছে। দ্বিতীয়ত, সংস্থা এবং ব্যাঙ্কগুলি অন্য কোনও সংস্থার শরণাপন্ন হতে পারে, যারা ঋণগ্রস্ত সংস্থাটিকে কিনে নেবে, এবং সেই টাকাটি তুলে দেবে ব্যাঙ্কের হাতে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় রেজ়োলিউশন। এই প্রক্রিয়ায় ১৩% সংস্থা অংশগ্রহণ করেছে। তৃতীয়ত, সংস্থার যাবতীয় সম্পত্তি বেচে দিয়ে পাওনাদারদের টাকা মেটানো যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় লিকুইডেশন। ২০২১-এর মার্চ পর্যন্ত ৪৮% সংস্থা এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
কিন্তু ব্যাঙ্কগুলি কত টাকা ঋণগ্রস্ত সংস্থাগুলির কাছ থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে?
রেজ়োলিউশন প্রক্রিয়ায় মার্চ ২০২১ অবধি ৩৪৮টি সংস্থার ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে। এই ৩৪৮টি সংস্থার থেকে ব্যাঙ্কগুলির মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৫,১৬,০৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাঙ্কগুলি আদায় করতে পেরেছে মোট ২,০২,৬১৭ কোটি টাকা— মোট ঋণের মাত্র ৩৯.৪৬%। বাকিটা মুছে গিয়েছে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে। এখনও অবধি এসার স্টিল ও ভূষণ স্টিলের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলি সর্বাধিক টাকা ফেরত পেয়েছে। এই দুই সংস্থার থেকে পাওনাদার ব্যাঙ্কের প্রাপ্য অর্থ ছিল ১ লক্ষ কোটি টাকার সামান্য বেশি, যার মধ্যে ৭৬,৫৮৯ কোটি টাকা ব্যাঙ্কগুলি ফেরত পেয়েছে। এই দুই সংস্থাকে আমরা যদি হিসেবের বাইরে রাখি, তবে দেখা যাবে যে, বাকি সংস্থাগুলির থেকে ব্যাঙ্কের প্রাপ্ত টাকার পরিমাণ মোট ঋণের মাত্র ৩০.৭%। কিছু সংস্থা রয়েছে, যেখানে ব্যাঙ্কগুলি তাদের দেওয়া ঋণের ৮০ শতাংশ বা তার বেশি অর্থ ফেরত পায়নি।
লিকুইডেশনের মাধ্যমে মার্চ ২০২১ অবধি ১২৭৭টি সংস্থার ঋণ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অবস্থা রেজ়োলিউশনের চেয়েও খারাপ। সংস্থাগুলির বকেয়া ব্যাঙ্কের ঋণের পরিমাণ ৬,৪৭,০০০ কোটি টাকা। অথচ, তাদের সমস্ত সম্পদ টুকরো টুকরো করে বেচে দিয়ে মোট পাওয়া গিয়েছে ৪৬,০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ৬ লক্ষ কোটি টাকা স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে।
এখানে অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দু’টি প্রশ্ন ওঠে। প্রথমত, এই সংস্থাগুলির যদি মোট সম্পদের পরিমাণ এত কম হয়, তা হলে তারা এত টাকা ঋণ পেল কী করে? এখানে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, যদি কোনও সংস্থা দেউলিয়া হয়ে যায়, তবে তার সম্পদের দাম দ্রুত হারে কমতে থাকে। অতএব, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সংস্থাগুলির থেকে ঋণ আদায় করা উচিত। অন্য দিকে, দেশে এখন আর্থিক মন্দাবস্থা চলছে। তাই কিছু ক্ষেত্রে এমনিতেই চাহিদার সমস্যা রয়েছে। অতএব, এই সংস্থাগুলিকে বেচার চেষ্টা করলে অবিলম্বে কোনও লাভ হবে না। বরং, এদের আপাতত ঠান্ডাঘরে রাখা যাক— পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এদের বেচা যাবে। রঘুরাম রাজনের মতো অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে, কিছু ডুবতে থাকা সংস্থাকে আরও ঋণ দেওয়া উচিত, যাতে তারা আবার ব্যবসা চালিয়ে সব ঋণ ফেরত দিতে পারে।
কিন্তু রেজ়োলিউশন এবং লিকুইডেশন, দুই প্রক্রিয়াতেই ব্যাঙ্কগুলি তাদের দেওয়া ঋণের সিংহভাগ হারিয়েছে। তা হলে প্রশ্ন উঠবে: যে সংস্থাগুলি ডুবতে পারে, সেই সংস্থাগুলিকে ঋণ দেওয়া হল কেন? রঘুরাম রাজন এবং অন্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিভিন্ন প্রকল্পের ঝুঁকি বুঝতে পারে না, কারণ তাদের সেই বিশেষজ্ঞদের অভাব রয়েছে। কিন্তু ঘটনা হল, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া ব্যাঙ্কের কাজ হওয়াই উচিত নয়। আর্থিক সংস্কারের আগে, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ— যা শিল্প বা পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজে লাগে— তা কম সুদে দেওয়ার জন্য আলাদা উন্নয়নমুখী আর্থিক সংস্থা ছিল। নয়া অর্থনীতির কল্পনায় পরিকাঠামোর উপর জোর বাড়লেও এই বিশেষ আর্থিক সংস্থাগুলিকে হয় তুলে দেওয়া হল, নয়তো সাধারণ ব্যাঙ্কে পরিণত করা হল— উদাহরণ আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক। ফলত, এক দিকে কৃষি ঋণ, ক্ষুদ্র শিল্পের ঋণ, সামাজিক ব্যাঙ্কিং; অন্য দিকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়ার দায় সবটাই এসে পড়ল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ঘাড়ে। বেসরকারি ব্যাঙ্ক এত দায় কেন নেবে? তারা মুনাফামুখী ব্যাঙ্ক ব্যবসা করল। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বাধ্য করল নানা ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ দিতে।
যখন অর্থনৈতিক বৃদ্ধি হচ্ছিল, তাতে সওয়ার করে তৈরি হল এক ঋণের বুদবুদ। যে হেতু আর্থিক বৃদ্ধি হচ্ছে, ব্যাঙ্ক ভাবল যে ঋণ দেওয়া যেতেই পারে, কারণ আর্থিক বৃদ্ধির ফলে তাদের সুদ ও আসল নিশ্চিত ভাবেই ফেরত আসবে। কিন্তু, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলে এই সুদিন আসতে না আসতেই চলে গেল। ইতিমধ্যেই ব্যাঙ্ক বুদবুদে ভর করে এমন অনেক ঋণ দিয়েছে, যার কোনও সারবত্তা নেই। সেগুলি আস্তে আস্তে অনাদায়ি ঋণে পর্যবসিত হল। আবার সরকার ২০০৯ সাল থেকে পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ বাড়ানোর স্বার্থে ব্যাঙ্কগুলিকে ঋণ দিতে বাধ্য করল, যার মধ্যে অনেক প্রকল্পই পরে বিশ বাঁও জলে চলে যায়। সব মিলিয়ে ব্যাঙ্কের অনাদায়ি ঋণের সমস্যা বাড়ল। কিন্তু জনমানসে এমন একটি ধারণা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যেন এই সমস্যাটি শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সমস্যা। তা কিন্তু নয়। বেসরকারি ব্যাঙ্কে, তুলনায় কম হলেও, অনাদায়ি ঋণের সমস্যা রয়েছে।
ইতিমধ্যে, নতুন দেউলিয়া আইন এনে মোদী সরকার ভাবল যে, কেল্লা ফতে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, এই আইনের ফাঁক দিয়ে অধিকাংশ অনাদায়ি ঋণ স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সরকারি অর্থনীতিবিদরা সাফাই দিচ্ছেন যে, এই আইন আগের আইনের তুলনায় বেশি টাকা ঘরে ফেরাচ্ছে। কিন্তু তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে, আমেরিকা, ইংল্যান্ড বা জাপানে সেখানকার দেউলিয়া আইনের মাধ্যমে অনাদায়ি ঋণের ৮০ শতাংশের বেশি ব্যাঙ্কের ঘরে ফেরে। আমাদের দেশে যা ৪০ শতাংশেরও কম।
অনাদায়ি ঋণের সমস্যাকে খলনায়ক করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু যে বাজারের হাত ধরে অনাদায়ি ঋণের ছিটেফোঁটা মাত্র ফেরত এল, যে বেসরকারি ক্ষেত্র ব্যাঙ্কের টাকা ফেরত না দিয়ে এই সমস্যার জন্ম দিল, সেই বাজার এবং বেসরকারি ক্ষেত্রের হাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেচে দিলে এই সমস্যা মিটবে না, বরং নতুন সমস্যার জন্ম দেবে। বিশেষ করে কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসার ঋণ, প্রান্তিক মানুষকে ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়া হোঁচট খাবে। যাঁরা ধনী, যাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ফেরত দেননি, তাঁরা এবং তাঁদের বন্ধুরাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মালিক হয়ে অর্থব্যবস্থায় নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্যকে সুনিশ্চিত করবেন।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy