জাতীয় শিশু কন্যা দিবস। কথাটা শুনলেই মনে হয়, নিশ্চয়ই দেশের কন্যাসন্তানদের জন্য রাষ্ট্র আলাদা ভাবে ভাবছে, করণীয় দায়িত্ব পালন করছে। মনে হয়, নিশ্চয়ই আমাদের দেশের ‘বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও’-এর মতো প্রকল্প দেশের মেয়েদের মুখে হাসি ফিরিয়েছে। কিন্তু বাস্তব? সম্প্রতি ২৪ জানুয়ারি, জাতীয় শিশুকন্যা দিবস উপলক্ষে এক অনলাইন আলোচনা সভায় রাজ্যের বিভিন্ন জেলার মেয়েরা নিজেদের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরল। জেলার প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েদের সহজে ধরা যায়নি। সংস্থার দিদিদের দিয়ে বোঝাতে হয়েছে— কী করে জ়ুম মিটিং-এ ঢুকতে হয়। তার পর তো স্মার্টফোন জোগাড়ের ঝক্কি, ইন্টারনেট কানেকশন পাওয়া, নেট-প্যাক ভরানোর ঝামেলা।
সেই ইন্টারনেটের দৌলতেই কলকাতায় বসে শোনা গেল মুর্শিদাবাদের সীমান্তবর্তী গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান, আলিপুরদুয়ারের চা-বাগান শ্রমিকের সন্তান কিংবা কলকাতার যৌনপল্লি এলাকার পড়ুয়া ছাত্রীটির বক্তব্য।
মূলত, ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে জেলার ছাত্রীদের নিয়ে গঠিত ‘উড়ান’ নামের ক্লাবের সদস্য এরা। যাদের কাজ, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে নাবালিকা বিয়ে আটকানো কিংবা বন্ধু মারফত খবর পেয়ে মেয়ে পাচারের খবর ঠিক সময়ে প্রশাসনের কাছ পৌঁছে দেওয়া। সবচেয়ে জরুরি, এলাকার কিশোরী এবং অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতার প্রচার করা এবং নিজেদের কথা বলার একটি মঞ্চ গড়ে তোলা।
কী শোনা গেল তাদের মুখে? আলিপুরদুয়ারের চা-বাগানের দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া কন্যার করুণ আর্তি, “দিদি, স্কুলে শুধু অষ্টম শ্রেণি অবধি মিড-ডে মিল দেয়। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পায় না। আমি বারো ক্লাসে পড়ি, ফলে মিড-ডে মিল নেই। আমাদের কি খিদে পায় না, দিদি?” বক্তা হিসাবে হাজির সাংবাদিক ও স্কুল শিক্ষিকা দিদিরা এর কী উত্তর দেবেন? খিদের প্রশ্নের সামনে এসে লজ্জা পায় ঘটা করে পালন করা জাতীয় শিশুকন্যা দিবস। ।
ফিরে আসে কন্যাভ্রূণ হত্যা, নাবালিকা বিবাহ, নারীপাচার, স্কুলছুট ছাত্রীর সংখ্যাবৃদ্ধির মতো অবধারিত প্রসঙ্গ। এক ছাত্রী জানায় স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার বাস্তব সমস্যার কথা। চা-বাগান শ্রমিকের মেয়ে, নবম শ্রেণির ছাত্রী বলে, “আগে স্কুলে গেলে দুপুরের খাওয়াটা জুটত। পেট ভরে ডাল-ভাত, তরকারি, ডিম বা খিচুড়ি খেতে পেতাম রোজ। করোনার বিধিনিষেধে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল, মিড-ডে মিলের রান্না করা খাবারও আর দেওয়া হয় না। বদলে এখন সরকারি নির্দেশ মেনে প্রত্যেক পড়ুয়ার জন্য নির্দিষ্ট মাপের চাল-ডাল-আলু বাড়িতে দেওয়া হয়। আগে যেটা পুরো খেতে পারতাম, এখন তা বাড়ির সকলের সঙ্গে ভাগ করে খেতে হচ্ছে। ওই খেয়ে পেট ভরছে না, আমাদের পুষ্টিরও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।” অনলাইন ক্লাসরুমের ব্যর্থতার এই অভিযোগ এক অন্য বাস্তব তুলে ধরে।
অবাক হয়ে দেখলাম, নিজেদের না পাওয়া, নিজেদের সামাজিক অবস্থান, শিক্ষার অনিশ্চয়তার কথা কী স্বচ্ছ ভাবনায় মেলে ধরছে ওই মেয়েরা। নিজেরাই নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রান্তিক এলাকার তথাকথিত ‘গ্রাম্য’ মেয়েটি সব সঙ্কোচ কাটিয়ে জ়ুম মিটিং-এ একশো নারী-পুরুষ সদস্যের সামনে বলছে, “পিরিয়ডের সময়ে স্কুল থেকে চেয়েও বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন মেলে না। বাইরে থেকে তিরিশ-চল্লিশ টাকা দিয়ে কিনতে হয় ন্যাপকিনের প্যাকেট, এতে আমাদের ওই সময়ে কাপড় ব্যবহারের চেয়ে অনেক বেশি খরচ পড়ে।” পরিবারের আয়-ব্যয়ে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে মেয়েটি বাধ্য হয় তার মেনস্ট্রুয়াল হাইজিনের সঙ্গে আপস করতে। তাই সে এই আলোচনা সভার মাধ্যমে সরকার এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানায়, বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হোক। এটাই তো ক্ষমতায়ন।
আলোচনায় ফিরে এল, দারিদ্রের কারণে সন্তানদের স্কুলের খরচ জোগাতে না পারা, ছোট বয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার মতো সমস্যার কথা। উঠে এল পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকা থেকে মেয়েদের পাচার হয়ে যাওয়ার কথা। জানা গেল, কখনও পাচার হয়ে পতিতালয়ে পৌঁছে যাওয়া মেয়েটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও, তাকে পুলিশ-প্রশাসন বাড়ি ফিরিয়ে দিলেও মেয়েটির আর কখনও সামাজিক মূলস্রোতে ফেরা হয় না। বাড়ির লোক তাকে গ্রহণ করতে চায় না গ্রামে একঘরে হওয়ার ভয়ে। সামাজিক ধারণা এখনও এখানেই দাঁড়িয়ে।
এই মেয়েদের মূলস্রোতে ফেরাতে যৌথ ভাবে কাজ করে রাজ্য সরকার এবং নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। পাচার-ফেরত মেয়েদের হোমে রেখে নানা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যে মেয়েরা জন্মসূত্রে কলকাতার যৌনপল্লির বাসিন্দা, তাদের মাথায় ছাদ থাকলেও নেই পড়াশোনা করার মতো উপযুক্ত পরিবেশ। করোনাকালে বেড়েছে স্কুলছুটের সমস্যা। অভিভাবকদের রোজগার নেই, বাধ্য হয়ে পেটের ভাত জোগাড়ে পড়ুয়ারা কাজে লেগেছে।
যৌনপল্লির বাসিন্দা এক কলেজ ছাত্রী বলেন, “আমার এলাকাতুতো ভাই-বোনদের বার বার বলি, পড়াশোনা কর, নয়তো কোনও দিন এই জায়গা থেকে বেরোতে পারবি না। কিন্তু দিদি, ওরা পড়তেই চায় না।” তাঁর আরও আক্ষেপ— “আমার বোন ক্লাস এইটে উঠল, কিছুই শিখল না। সরকারি স্কুলে ভাল করে পড়ানো হয় না। দু’বছর ঘরে বসে, ক্লাস না করেই দুই ক্লাস উপরে উঠে গেল। পাশ-ফেল ছিল না এত দিন, এখন উঁচু ক্লাসে কী ভাবে পাশ করবে?”
আসলে কথা বলার সঙ্গে কথা বলতে দেওয়াও খুব জরুরি। এই মেয়েদের নিজেদের কথা নিজেদের মুখে বলা জরুরি। ‘জাতি’র কন্যারা কেমন আছে, একমাত্র তখনই আমরা জানতে পারব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy