Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Government Schools

সরকারি স্কুল বাঁচানোর উপায়

দিল্লির প্রাথমিক স্কুলের ধাঁচে কলকাতা পুরসভা পরিচালিত কিছু স্কুলের পঠনপাঠন থেকে পরিকাঠামোর আমূল সংস্কার হবে।

তূর্য বাইন
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২২ ০৪:৫০
Share: Save:

আলোচনা হচ্ছিল অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মন্তব্য নিয়ে। সরকারি শিক্ষকদের নিয়োগপত্র প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দশ বছর পরে কোনও ছাত্রছাত্রী সরকারি স্কুলে পড়তে চাইবে না। আলোচনায় কিছু তরুণ অভিভাবক উপস্থিত ছিলেন। জানা গেল, সবার সন্তানই বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে। অথচ তাঁরা বিত্তশালী নন, নিজেরা পড়েছেন বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলে।

ছাত্রছাত্রীর অভাবে আমাদের রাজ্য সরকার ৮৯টি স্কুল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কলকাতার কিছু সরকারি স্কুলেও পড়ুয়া সংখ্যা এত কম যে, ভবিষ্যতে হয়তো সেগুলি বন্ধ হয়ে যাবে। আবার, দক্ষিণ দিনাজপুরে পড়ুয়ার অভাবে ছ’টি প্রাইমারি স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, যার একটি পরে চালু হয়েছে, অন্যগুলির শিক্ষকদের বদলি করা হয়েছে। শিক্ষামহলের একাংশের দাবি, এক দিকে বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল গড়ে উঠছে, অপর দিকে কিছু এলাকায় সরকারি স্কুলের সংখ্যাও বেশি। তবে কিছু স্কুলে পরিকাঠামো ভেঙে পড়েছে— শিক্ষকের অভাব, বিদ্যুৎ পরিষেবা নেই, আরও নানা সমস্যা। ফলে জুটছে না পড়ুয়া। তবে সমস্যা শুধু অসম বা পশ্চিমবঙ্গে নয়, দেশের সর্বত্র। ‘ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফর্মেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন’ (ইউডাইস)-এর ২০১৯ সালের তথ্য বলছে, দেশে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ার সংখ্যা প্রায় ২৫ কোটি ১০ লক্ষ। এর মধ্যে প্রায় ১২ কোটি— অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক— বেসরকারি স্কুলের পড়ুয়া।

তবে, অন্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলে পড়ুয়া সংখ্যা অনেক ভাল। বহু স্কুলে পরিকাঠামোগত দুর্বলতা হয়তো রয়েছে, তবু রাজ্যের পড়ুয়াদের সিংহ ভাগ সরকারি স্কুলের উপর নির্ভরশীল। তবে পশ্চিমবঙ্গে প্রাইভেট স্কুলের সংখ্যাও যথেষ্ট কম। প্রশ্ন ওঠে, সরকারি স্কুলের উপর নির্ভরতা কি দায়ে পড়ে, না কি উৎকর্ষের উপর আস্থা রেখে? এই জিজ্ঞাসার কারণ আছে। যথেষ্ট পড়ুয়া থাকা সত্ত্বেও রাজ্যের বহু স্কুল শিক্ষকশূন্যতায় ধুঁকছে। যেখানে ৪০ জন ছাত্রের জন্যে এক জন শিক্ষক থাকার কথা, সেখানে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক প্রতি পড়ুয়া মালদহে ৯৪, জলপাইগুড়িতে ৯২, ঝাড়গ্রামে ৮৮। উচ্চমাধ্যমিক থেকে প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত চিত্রটা মোটামুটি একই। উৎসশ্রী পোর্টালের মাধ্যমে রাজ্য সরকার শিক্ষক বদলির যে সুযোগ তৈরি করেছে, তাতে সমস্যা বেড়েছে। শিক্ষকদের শহরমুখী বদলির জোয়ারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে শিক্ষকের সংখ্যায় ভাটা পড়ছে। অথচ, শহরের তুলনায় গ্রাম-মফস্‌সলে অনেক বেশি পড়ুয়া সরকারি স্কুলের উপর নির্ভরশীল।

তবে শুধু রুগ্ণ পরিকাঠামো বা শিক্ষকের অভাবের জন্যেই অভিভাবকেরা নিখরচার সরকারি স্কুল ছেড়ে ব্যয়বহুল বেসরকারি স্কুলে সন্তানদের পাঠাচ্ছেন, এমন নয়। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, সব অভিভাবকই চাইছেন যে, তাঁদের সন্তান যেন বিশ্বায়িত পৃথিবীতে, পরিবর্তনশীল আর্থসামাজিক পরিমণ্ডলে টিকে থাকার মতো করে গড়ে ওঠে। তাঁদের বিশ্বাস, এর জন্যে ইংরেজি শিক্ষা ও সময়োপযোগী পেশাসহায়ক পাঠ্যক্রম প্রয়োজন। সাধ্যাতীত খরচ সত্ত্বেও প্রাইভেট স্কুলগুলো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পিছনে আছে এই দুই কারণ।

তবে সরকারি স্কুলও যে চাইলে প্রাইভেটকে টেক্কা দিতে পারে, তার প্রমাণ দিল্লি। সেখানে গত কয়েক বছরে বহু পড়ুয়া প্রাইভেট স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এই অসাধ্য সাধনের পিছনে আছে শিক্ষাখাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ বৃদ্ধি, এবং সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো ও পাঠ্যক্রমের বাস্তবমুখী সংস্কার। কলকাতার দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের কেমন করে ফের সরকারি স্কুলমুখী করা যায়, তার সন্ধান করতে কলকাতার মেয়র পারিষদ (শিক্ষা) ও কয়েক জন সরকারি আধিকারিক দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সংবাদে প্রকাশ, দিল্লির প্রাথমিক স্কুলের ধাঁচে কলকাতা পুরসভা পরিচালিত কিছু স্কুলের পঠনপাঠন থেকে পরিকাঠামোর আমূল সংস্কার হবে। ৭১টি পুরসভা স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে পঠনপাঠন চলছে, আগামী পাঁচ বছরে আরও ৮০টি স্কুলে তা হবে, সঙ্গে স্মার্ট ক্লাসরুম, ডিজিটাল ল্যাব, প্লে-জ়োন, ‘ইংলিশ কমিউনিকেশন স্কিল’।

একটা ঘটনা মনে পড়ল। বইমেলায় বাংলা বইয়ের প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন স্কুলজীবনের সহপাঠী, সঙ্গে বালক পুত্র। প্রকাশক কিশোরপাঠ্য বই তাকে দেওয়ার পর দেখলেন, সে অসহায় হয়ে তাতে হাত বোলাচ্ছে। বন্ধুটি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, পড়া দূরে থাক, ও বাংলা অক্ষর পর্যন্ত চেনে না। প্রকাশক মুচকি হেসে একটা বর্ণপরিচয় ছেলেটির হাতে দিয়ে বললেন, পরের বার বইমেলায় এলে বিদ্যাসাগরের আর একটা বই দেব। অনেকে প্রশ্ন করছেন, বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতেও কি দিল্লি মডেল চালু করা যায় না? সমস্ত শিশুই যদি ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে যায়, তা হলে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী হবে? স্কুলের পঠনপাঠন-মাধ্যম নির্বিশেষে এ রাজ্যের শিশুদের হাতে বর্ণপরিচয় তুলে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। অভিভাবকদেরও মনে রাখতে হবে, বাংলা না জানাটা মোটেই গর্বের নয়, বরং অপরিসীম লজ্জার।

অন্য বিষয়গুলি:

Government Schools Private Schools West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy