হিসাব বলছে, গুজরাতের কেভারিয়ায় সর্দার সরোবর বাঁধের জলভান্ডারটি ২১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা মহারাষ্ট্রের ৩৩, গুজরাতের ১৯ আর মধ্যপ্রদেশের ১৯৩টি গ্রাম ডুবিয়েছে। এর মধ্যে ১০০-র বেশি পার্বত্য আদিবাসী গ্রাম। এই জলমগ্ন বা ডুবগ্রামগুলি প্রায় সব ক’টি নন্দুরবার, খরগোন, বডবানি, আলিরাজপুর জেলায়। ফুল রিজ়ার্ভার লেভেল বা এফআরএল গ্রামের মানুষজন আগেই চলে গেছেন রিহ্যাবিলিটেশন সাইট বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে। ২০১৯-এ জলাধার টইটম্বুর হলে যাঁরা পুনর্বাসন না পেয়ে যেতে চাননি, তাঁদের তুলে দেওয়া হয়েছে বিপুল প্রশাসনিক বন্দোবস্তে। সেই পথ ধরে চলেছি আমরা, পাশে পাশে নর্মদার ধারা।
দু’দিন আগে অমরকণ্টকে দেখেছি নর্মদার উৎস স্থল। কুণ্ডের পর নদীর ধারাকে বইয়ে দেওয়া হয়েছে ছোট স্পিলওয়ে গেট করে। কিন্তু আরও হাজার কিলোমিটারের কাছাকাছি পথ চলে পশ্চিমবাহিনী নদী রীতিমতো অতিকায়। খরগোন জেলার মহেশ্বর, বডবানি এই ছোট শহরগুলি হল মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণ সীমান্ত জুড়ে নর্মদার যাত্রাপথ। বডবানির নর্মদা ব্রিজ পেরোনোর সময় চোখে পড়ে জলের প্রান্তে ডোবা গ্রামের ছবি। নদীতেই মিশে গেছে গ্রামের অতীত জীবনের চিহ্ন সব। নর্মদার খলঘাট হয়ে বডবানি আসতে বোরলাই পুনর্বাসন গ্রামের মধ্যে অসন্তুষ্ট জনতার মুখোমুখি হলাম। খলঘাটে ১৯৯০ সালে ১০ হাজার আদিবাসী কৃষক ২৮ ঘণ্টা বন্ধ করে রেখেছিল ন্যাশনাল হাইওয়ে। বোরলাই পাটীদারদের গ্রাম। ২০১৭-র সুপ্রিম কোর্টের আদেশে জমির বদলে ৬৫ লক্ষ টাকা পেয়ে বাহারি বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে।
ভাগ্য ভাল, পুরো গ্রাম ভাগ না হয়ে এক বসতে উঠে এসেছে। কিন্তু তিন বছর হয়ে গেল পানীয় জলের সাপ্লাই নেই। জল আসে ট্যাঙ্কার-বাহিত হয়ে। তাতে কুলোয় না। নর্মদা ভ্যালি ডেভলপমেন্ট অথরিটি মাটির তলা দিয়ে পানীয় জলের পাইপ নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এঁদের তা জানানো হয়নি। ফলে, ঘরের ভিত উঠেছে পাইপের উপর দিয়ে।
আরও এক সমস্যা। পাকা নালাগুলিও ঘর তৈরির আগে বানানো হয়ে গিয়েছিল। এখন নিকাশের বোঝা বইতে না পেরে গ্রামের ভিতর জল। ইঞ্জিনিয়াররা অসন্তুষ্ট। বললেন, লোকে নিকাশি পথের জন্য সামান্যতম জমিও ছাড়তে রাজি নয়। যাঁরা পুনর্বাসন সাহায্য নিয়ে অন্যত্র উঠে গেছেন, তাঁদের সঙ্গে নর্মদা উন্নয়ন অথরিটির বোঝাপড়ার অভাব। ঘর নিজেরা বানিয়েছেন, কিন্তু পরিকাঠামো, যেমন জলের ব্যবস্থা, নালা, পাইপ, স্কুল তৈরি হতে সময় লাগছে। অধৈর্য হয়ে পড়ছে দু’পক্ষ। পুনর্বাসন পেয়েও লোক খুশি নয়। “আমরা খুশি নই। কেন হব?” যে কোনও বিবাদ বিসম্বাদে সেই এক কথা ফিরে আসে, ‘ফিরিয়ে দাও আমাদের পুরনো গ্রাম’।
যেখানে পুরনো গ্রাম ভাগ হয়ে দু’টি কি তিনটি পুনর্বাস কলোনিতে ভাগ হয়ে গেছে, সেখানে যন্ত্রণা আরও বেশি। কাছের মানুষ দূরে চলে যাওয়া। টুকরো টুকরো সামাজিক জীবন নিয়ে বাঁচা। নর্মদা উন্নয়ন অথরিটি-র খাতায় নতুন বসাহত আর গ্রাম হয় না। এদের নাম, রিহ্যাবিলিটেশন সাইট। মালকানগিরির বাঙালি উদ্বাস্তুদের যেমন আশি বছর পরেও গ্রাম হয়নি। এমভি ২২৭, এমভি ১৫০ এমন সব নাম। এমভি হল মালকানগিরি ভিলেজ। আরও অনেকটা এগিয়ে চিখলদা গ্রাম খণ্ডহর হয়ে আছে। নদীর খুব কাছেই। কাজেই ডুবগ্রাম তো বটেই। পুরনো মন্দিরের জীর্ণদশা। পাথরের সিঁড়ি ভাঙতে লেগেছে। ওখানে বসে এক বৃদ্ধ মহিষ চরাচ্ছেন। গ্রাম যেখানে উঠে গেছে, সেখানে গোচারণ ভূমি নেই। অনেক পুনর্বাস সাইটেই নেই। সবচেয়ে মুশকিল হল, চাষের জমি ৬-৭ কিলোমিটার দূরে রয়ে গেছে। নতুন বসতবাড়ি থেকে চাষের খেতে যাওয়ার পথ নেই। সাইকেলে, পায়ে হেঁটে, কাদা ভেঙে যাওয়া। “ও সব পথ আমরা বানাব না। কেন? যা ডুবে নষ্ট হয়েছে, তাই বানাব আমরা।” পঞ্চায়েতও সংযোগকারী রাস্তা বানাতে তৈরি নয়। কারণ, ওই সব পুনর্বাস সাইট পঞ্চায়েতকে হস্তান্তর করা হয়নি।
আসলে মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। ১৯৮৫ সালে মহারাষ্ট্রের মণিবেলিতে সত্যাগ্রহ হয়েছিল। জলভান্ডারের ঠিক উল্টো দিকে নন্দুরবার জেলার মণিবেলি। তাদের জমি দেওয়া হচ্ছিল গুজরাতে। প্রতিবাদ করে মণিবেলির ভিল পরিবারগুলি জল আঁকড়ে পড়ে রইল। এখনও তারা জলভান্ডারের মধ্যে একটি কাছিমের পিঠের মতো বসে। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন ৩৭ বছর ধরে জেলায়, গ্রামে তাদের সংগঠন গড়ে তুলেছে। গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে তারা। ভিড়ের মধ্যে যদি কোনও উপরে তোলা হাত বলে ওঠে ‘জিন্দাবাদ’— বুঝতে হবে, ইনিই আন্দোলনকর্মী। ৩৭ বছর ধরে প্রথমে বড়বাঁধ-বিরোধী, পরে পুনর্বাসন চেয়ে আন্দোলন চলেছে। মেধা পাটকর, বাবা আমটের মতো নেতারা কোর্টে, দেশেবিদেশে আন্দোলনের মুখ। কিন্তু অসংখ্য সাধারণ কর্মী, বিশেষত স্থানীয় ভিল, ভিলালা, বসাবা জনজাতির মানুষ আন্দোলনের শিখা বাঁচিয়ে রেখেছে এত বছর ধরে। ‘নর্মদা বচাও আন্দোলন’কে প্রতিপক্ষ বলেই ধরেছে সর্দার সরোবরের প্রবক্তারা। পুনর্বাসন নিয়ে তোলা অভিযোগের কারণে বিশ্বব্যাঙ্ক সর্দার সরোবর প্রজেক্ট-এ পিছু হটে। লড়াই চলেছে, কারণ পুনর্বাসন প্রক্রিয়া জটিল ও মন্থর হয়ে পড়ছে। নর্মদা কন্ট্রোল অথরিটি, ট্রাইবুনাল, এবং অভিযোগ সমাধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার নির্দেশ অনুপালনে নানা ফাঁক রয়ে যাচ্ছিল। মেধা পাটকর ও সহযোগীদের বার বার হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের কাছে যেতে হয়েছে। ডুবগ্রামের লোকেদের কোনও মতে কলোনি বানিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়াই নয়, আদিবাসী ও মৎস্যজীবীদের সার্বিক জীবিকা সংরক্ষণের বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়নি। আদিবাসী গ্রামের স্বনির্ধারণের অধিকার সংরক্ষিত হয়নি। কিছু কিছু গ্রাম জলযান নির্ভর হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে।
বড় মাপের পুনর্বাসনের টাকা আসার পর অভিযোগ এসেছে বড় মাপের দুর্নীতির। জাল দলিলের মাধ্যমে অসৎ দালালের হাতে পড়ে টাকা ও জমি দুই খুইয়েছেন বহু দরিদ্র, অল্প-শিক্ষিত। তাই নিয়ে আবার কোর্টের কাছে যেতে হয়েছে ‘নর্মদা বচাও আন্দোলন’কে।
‘এক উপত্যকার নিমজ্জন— এক সভ্যতার বিনাশ’। ২০১৫-তেও কেন্দ্রীয় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম-কে এই মর্মে আবেদন করেছেন আন্দোলনকারীরা। পাটীদার আর আদিবাসী দলিতদের মধ্যে বিরাট বৈষম্য সৃষ্টি করেছে পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও। যাঁরা চাপে পড়ে, এবং বাঁধের কাছে থাকায় তড়িঘড়ি উঠে গিয়েছিলেন, তাঁরা অনেক কম টাকা পেয়েছেন। যাঁদের গ্রাম আঁকড়ে পড়ে থাকার ক্ষমতা বেশি, সেই পাটীদাররা পেয়েছেন অনেক বেশি টাকার পুনর্বাসন। ৬৫০ পাটীদারের রঙিন পাকা বাড়ি বিজলির আলোয় সাজানো নিসারপুর বসাহত যেন এক মায়ানগরী। গত শতকের শেষ থেকে সর্দার সরোবরকে বিপ্লব বলে এগিয়ে নিয়ে গেছে গুজরাত সরকার। গুজরাত খরাগ্রস্ত, তাই জলের নীচে কারা ডুবল, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
২০১৪ সালে নতুন কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতায় আসার পর, কোনও সরেজমিন তদন্ত ছাড়াই বাঁধের উচ্চতা বেড়ে হল ১৩৮.৬ মিটার। নর্মদা কন্ট্রোল অথরিটিকে এই মর্মে নির্দেশ দিল ভারত সরকার। জলমগ্ন ক্ষেত্র বেড়ে গেল এর ফলে। পুনর্বাসনের কোনও হিসাব হল না। অসম্পূর্ণ পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার মধ্যেই জল ঢুকে এল নতুন সব ডুবগ্রামে। ওই সব গ্রামের পথ দিয়ে যেতে মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি এত জল দরকার ছিল গুজরাতের? তা হলে কেন আমদাবাদের হাইরাইজ়-গুলোতে নর্মদার জল সরবরাহ করা হয়? কেন শুষ্ক সাবরমতীর বুক ভরা হয় নর্মদার জলে? ‘টেল-এন্ড ক্যানাল’-কে চাপ থেকে বাঁচানোর জন্য সেচের জল বইয়ে দেওয়া হচ্ছে কচ্ছের রন— এই লবণের জমির উপর দিয়ে।
তা হলে উচ্ছিন্ন মানুষকে জল ও জীবনের হিসাব দেওয়ার দায় কার?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy