দিল্লিতে নতুন রাজ্য সরকার এসে ‘আপ’ সরকারের তৈরি প্রায় দু’শো রুগ্ণ মহল্লা ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বিজেপি সরকারের যুক্তি, এই ক্লিনিকগুলি হয় ভাড়া বাড়িতে, নাহয় এমন সব ঝুপড়ির মতো বাড়িতে চালু করা হয়েছে, যেগুলি স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার উপযুক্ত নয়। সত্যিই তো, যে কোনও চিকিৎসার পরিবেশ স্বাস্থ্যকর হওয়া উচিত। কিন্তু নতুন কাঠামো তৈরি না করে পুরনো কাঠামো ভেঙে ফেললে স্থানীয় মানুষ যতটুকু স্বাস্থ্য পরিষেবা পাচ্ছিল, সেটুকু থেকেও তো বঞ্চিত করা হয়! পুরনো মহল্লা ক্লিনিকের জায়গায় নতুন ক্লিনিক চালু করা হবে কি না, তা বোঝা যাচ্ছে না।
দিল্লিতে সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ঝাঁ-চকচকে অট্টালিকা দেখলে মনে হতে পারে, রাজধানীতে চিকিৎসার খামতি নেই। কিন্তু সে সব হাসপাতালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি বিদেশ থেকেও প্রচুর লোক আসেন। তাই গোটা দেশে প্রতি দশ হাজার মানুষ-পিছু গড়ে যত হাসপাতাল শয্যা আছে, দিল্লিতে তার তিন গুণ থাকা সত্ত্বেও, কোভিডের সময়ে শয্যার জন্য হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। বড় বড় হাসপাতাল যতই থাকুক, দিল্লির প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা বেশ নড়বড়ে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে ছোটখাটো অসুখের জন্যও দিল্লির মানুষকে ছুটতে হয় বড় হাসপাতালের বহির্বিভাগে, কিংবা ‘বাঙালি’ (হাতুড়ে) ডাক্তারের কাছে, যাঁদের চিকিৎসার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মেরুদণ্ড। সুচারু ভাবে চললে, চিকিৎসার প্রয়োজনের ৯০ শতাংশ প্রাথমিক স্তরেই মিটিয়ে দেওয়া যায়। তাতে বড় হাসপাতালগুলির উপর চাপ কমে, চিকিৎসার খরচ ও সময় কমে। এ দেশে চিকিৎসাবাবদ যত খরচ করতে হয় এক জনকে, তার প্রায় ৭০ শতাংশই যায় প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। প্রাথমিক পরিষেবা ঘরের কাছে না হলে চিকিৎসায় দেরি হয়, রোগ জটিল হয়, খরচ বাড়ে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ভাল হলে জরুরি চিকিৎসা দ্রুত, অল্প খরচে পৌঁছে দেওয়া যায়। উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্যের খরচ সাধ্যের মধ্যে রাখতে গেলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর জোর দেওয়া দরকার।
সেই উদ্দেশ্যে দিল্লির আম আদমি পার্টির সরকার ২০১৫-তে চালু করে মহল্লা ক্লিনিক। শহরাঞ্চলে জমি পাওয়া কঠিন। তাই রাস্তার ধারে খুব ছোট জায়গায় অস্থায়ী কাঠামো বানিয়ে, এক জন ডাক্তারবাবু আর এক জন সহকারীকে নিয়ে শুরু। দু’বছরের মধ্যে চালু করা হয় ৫৩০টি ক্লিনিক। সময় সকাল সাতটা থেকে দুপুর দুটো, পরে কিছু ক্লিনিক বিকেলেও খোলা হয়। বিনা খরচে কিছু সাধারণ পরীক্ষা ও ওষুধের ব্যবস্থাও থাকে। অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মহল্লা ক্লিনিক। নানা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, উপভোক্তারা অধিকাংশই পরিষেবা নিয়ে সন্তুষ্ট। খরচে সাশ্রয়টাও উল্লেখ করেছেন অনেকে।
বেশ আশা জাগিয়ে শুরু হলেও, অনেক অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতাও রয়ে গিয়েছে। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জোগানে ঘাটতি বড় হয়ে উঠল। দিল্লির সব বাসিন্দাকে প্রাথমিক চিকিৎসার সুযোগ দিতে হলে যত ক্লিনিক খোলার দরকার ছিল তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ খোলা গিয়েছিল। তার উপর ডাক্তারের অভাবে তিনটে ক্লিনিকের একটা প্রায়ই বন্ধ পড়ে থাকত। ছিল ওষুধের অভাবও। লেফটেন্যান্ট গভর্নর ও রাজ্য সরকারের মধ্যে টানাপড়েন, রাজ্য সরকারের ঢিলেমি, বেসরকারি ব্যবস্থার চাপ, এমন নানা কারণে মহল্লা ক্লিনিকগুলো ক্রমশ জৌলুস হারাতে থাকে। বাজেটেও শুরু হয় ভাটার টান।
আর একটা সমস্যা, মহল্লা ক্লিনিকগুলোকে বাকি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে রেফারাল ব্যবস্থার মাধ্যমে সে ভাবে যুক্ত করা যায়নি। প্রাথমিক পরিকাঠামোর সঙ্গে মাধ্যমিক ব্যবস্থার নিবিড় যোগাযোগ থাকা দরকার। যেমন, স্বাভাবিক প্রসব প্রাথমিক স্তরেই হতে পারে। কিন্তু যদি জরুরি ভিত্তিতে প্রসবের জন্য অস্ত্রোপচার করতে হয়, তা হলে প্রসূতিকে চটজলদি বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আবার এমনও হতে পারে, বড় হাসপাতালে অপারেশনের পর প্রতি দিনের ওষুধ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দেওয়া হয়, তাতে রোগীর সুবিধা হয়। কিন্তু উপরের স্তরের হাসপাতালগুলোর সঙ্গে সংযোগের অভাবের ফলে, বিশেষ পরিষেবার প্রয়োজন হলে মহল্লা ক্লিনিক থেকে কোনও নির্দিষ্ট হাসপাতালে বা ডাক্তারের কাছে রোগীকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যায় না।
তবু দু’শো মহল্লা ক্লিনিক যদি পাকাপাকি ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। সীমিত রসদ নিয়ে শুরু করে, নানা দুর্বলতা সত্ত্বেও, মহল্লা ক্লিনিক দিল্লি শহরে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা সকলকে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা অভূতপূর্ব প্রয়াস ছিল। দরকার ছিল আরও অনেক বেশি ক্লিনিক খোলা, সেগুলিতে উন্নততর পরিষেবার ব্যবস্থা করা, ওষুধের জোগান নিয়মিত করা, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক নিয়মিত ভাবে দেওয়া, আরও বেশি সান্ধ্য ক্লিনিক তৈরি করা। জোর দেওয়া দরকার ছিল মহিলাদের স্বাস্থ্যের উপর। সেই সঙ্গে মহল্লা ক্লিনিক, মাধ্যমিক স্তরের হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলোর মধ্যে উভয়মুখী রেফারাল ব্যবস্থা সুচারু ভাবে চালু করা দরকার ছিল। যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি প্রভৃতির নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে মহল্লা ক্লিনিকগুলোর সংযোগ তৈরি করাও দরকার ছিল।
মহল্লা ক্লিনিকের মতো একটা আশা জাগানো কর্মসূচি যদি রাজনৈতিক কূটকচালির বলি হয়, তা হলে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক চেতনার উপর আরও একটা কালো দাগ লেপে যাবে।
সরকার ও জননীতি বিভাগ, ও পি জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)