Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
বারো জনের হাতে তৈরি পুজোর বারোয়ারি গান
Durga Puja 2024

একাকী গায়কের নহে...

আন্তর্জালের কল্যাণে, সমাজমাধ্যমের পাতায় সকলেই আমরা কবি, গায়ক হতে পারি খুব সহজেই। পুজোর মতোই, পুজোর গান আর সাহিত্য দুই-ই এখন আর যেন শুধু জমিদার-বাড়িতে আবদ্ধ নয়; পাড়ার মাঠে, বারোয়ারি হাতে চলে এসেছে।

বাপ্পাদিত্য গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২৪ ০৬:২৪
Share: Save:

পুজো মানেই বাঙালির পাতে চাই নতুন গান, নতুন লেখা। দেবতাদের মন্ত্রিসভায় দেবী সরস্বতী সাহিত্য এবং সঙ্গীত দুটো মন্ত্রকের দায়ভারই একা হাতে সামলান। কিন্তু, এই মর্তে এই দুটো কাজের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। লেখক-সম্পাদক-প্রকাশক সকলের কাজ শেষ হলে তবেই নতুন পূজাবার্ষিকী-সাহিত্য আমাদের হাতে আসে। আর, গীতিকার-সুরকার-গায়ক এক সঙ্গে মিলে নতুন গান তৈরি করে আমাদের শোনান। সৃষ্টিকর্মে এ-হেন যৌথ উদ্যোগ দুই ক্ষেত্রেই আবশ্যিক।

সাহিত্যের কথায় পরে আসছি। আগে গানের কথা বলি। বোদ্ধামাত্রেই জানেন, গান লেখা, গান বাঁধা আর গান গাওয়া তিনটে আলাদা আলাদা কাজ। নতুন গান তৈরিতে তাই গীতিকার, সুরকার আর গায়কের তিন জনের ভূমিকাই সমান গুরুত্বের। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের শতবর্ষপূর্তি সমাগত, সেই মুহূর্তে স্মরণ করতে ভাল লাগে যে গৌরীপ্রসন্ন লিখবেন, রাহুল দেব বর্মণ সুর দেবেন আর আশা ভোঁশলে গাইবেন— এই মডেলেই ষাট-সত্তরের দশকের বাঙালি অভ্যস্ত ছিলেন।

কথাটা স্পষ্ট হওয়া দরকার। এক সঙ্গে অনেকে কাজ করা মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে একই ব্যক্তি একাধিক কাজ করতে পারেন না কিংবা করবেন না। ক্রিকেটের মতো অলরাউন্ডার সঙ্গীতের জগতেও অনেকে এসেছেন, আছেন। দুটো বা তিনটে কাজ এক জনেরই করার সফল উদাহরণ অজস্র। সলিল চৌধুরী গানের কথা ও সুর দুই-ই নিজের হাতেই করতেন; অখ্যাত যুবা-সলিল নাকি নতুন গান বেঁধে হেমন্ত-র দরজায় হত্যে দিতেন; একাধিক বার সলিলকে ফিরিয়ে দিয়ে অবশেষে তিনি রাজি হন “গাঁয়ের বঁধু”-র কথা শুনে। হেমন্ত, শ্যামল মিত্র আবার নিজেরা অনেক গানের ক্ষেত্রেই নিজে সুর দিয়ে নিজেই গেয়েছেন।

‘জীবনমুখী’ গানেতে পৌঁছে সুমন-নচিকেতারা তিনটে কাজই একা হাতে করতে শুরু করলেন— নিজেরাই লেখেন, সুর দেন, গান। পাশ্চাত্য পপসঙ্গীতে চিরকালই এই কাজ তিনটে একা করাই দস্তুর— টেলর সুইফট বা এড শিরন অন্য কাউকে দিয়ে গান লেখানো বা সুর দেওয়ানোর কথা তো ভাবতেই পারেন না; গান মানেই সেখানে গায়কের নিজের মনের কথা, নিজের অন্তরের সুর— সাম্প্রতিক বাংলা বাজারে আজ যা রূপঙ্কর বা অনুপম হামেশাই করেন।

তবু, যিনি যে কাজে বেশি দড় বা যিনি বিশেষজ্ঞ, তাঁকে সেই কাজটা করতে দেওয়াই সমাজের পক্ষে, সঙ্গীতজগতের পক্ষে লাভজনক। আধুনিক অর্থনীতির উৎপাদন ও বাণিজ্যের পরিভাষায় একে বলে ‘কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ’। আমার পারদর্শিতা অনুযায়ী যেটাতে অন্যদের থেকে আমার তুলনায় বেশি ব্যুৎপত্তিগত সুবিধা আছে, সেটা তৈরি করে যাওয়াটাই আমার পক্ষে লাভজনক, এটাই অর্থনীতির যুক্তি। সেই মতে চললে, যিনি গান গাইতে পারেন তাঁর উচিত শুধুই গান গাওয়া; বলিউডে তাঁরই অত্যন্ত সফল হওয়ার কথা।

নতুন গান আর নতুন লেখার মিল কিন্তু এই যৌথ উদ্যোগেই শেষ নয়। সৃষ্ট গান ও সাহিত্যের আধুনিক পরিবেশনায় আর একটা মিল আছে। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের ছোটবেলায় তো বটেই, এমনকি এক দশক আগে অবধিও শুধুমাত্র খ্যাতনামা, দক্ষ শিল্পী-সাহিত্যিকদের কাছ থেকেই আমরা নতুন-নতুন কাজ আশা করতাম, পেতামও। এখন কিন্তু পাঠক-শ্রোতার দরবারে আসার জন্য আর প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা জরুরি নয়। আন্তর্জালের কল্যাণে, সমাজমাধ্যমের পাতায় সকলেই আমরা কবি, গায়ক হতে পারি খুব সহজেই। পুজোর মতোই, পুজোর গান আর সাহিত্য দুই-ই এখন আর যেন শুধু জমিদার-বাড়িতে আবদ্ধ নয়; পাড়ার মাঠে, বারোয়ারি হাতে চলে এসেছে।

জনতার হাতে চলে আসায় গান আর সাহিত্যের মিলের থেকে অমিলটাই আজকাল চোখে পড়ছে বেশি। আগে মিল কোথায় সেটাই দেখা যাক। আজ আমরা সকলেই কবি। পুজোর সময় অজস্র শারদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। অতএব, উঠতি কবিরাও কবিতা লিখে বেশ সহজেই সম্পাদক-প্রকাশক খুঁজে পান। ছাপা না হলেও আন্তর্জালে, ডিজিটাল পত্রিকায় সুযোগের কমতি নেই। নিদেনপক্ষে, নিজে নিজেই সমাজমাধ্যমে নিজের পাতা খুলে নিজের কবিতা প্রকাশ করা যায়। একই ভাবে, আমরা সবাই আজ গায়কও। কোনও সঙ্গীত-কোম্পানি আমার গান প্রকাশ না করতে চাইলেও পরোয়া করি না— আন্তর্জালে নিজের চ্যানেল খুলে নিজের গান পরিবেশন করা যায় খুব সহজেই।

তবে এখানেই কিন্তু কবির সঙ্গে গায়কের, এমনকি গীতিকারের বেশ অমিল। অর্থনীতির ভাষায় বললে, কবি হিসেবে যদি কারও সৃষ্টি হয় তাঁর কবিতা, তা সে যে ভাবে, যে মাধ্যমেই ছাপা হোক না কেন। মাঝখানে সম্পাদক-প্রকাশক থাকলেও পাঠকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ সরাসরি ঘটে। বানান ভুল অথবা কোনও মুদ্রণপ্রমাদ না থাকলে সেই কবিতায় কেউ কলম চালান না।

বিপরীতে, এ বারে ধরা যাক, যিনি গায়ক, কোনও নতুন গান তিনি রেকর্ড করতে চান। এ ক্ষেত্রে, শ্রোতার কাছে পৌঁছনোর আগে আপনাকে বেশ কয়েকটা ধাপ পেরোতে হবে। প্রতিটি ধাপেই অর্থনীতির ‘কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ’ মেনেই কাজ হবে। প্রথমেই গীতিকার হিসেবে কেউ একটা গান লিখে দিতে পারেন; তাঁর কাজ এখানেই শেষ। সেই গানের কথায় সুর দেবেন কোনও সুরকার। সুরটা শুনে, ‘তুলে নিয়ে’ কেউ খালি গলায় গানটা গাইবেন। সুরকারের দায়িত্ব খতম। সেই খসড়া গান এ বারে যাবে যন্ত্রানুষঙ্গ-পরিচালকের কাছে। তাঁর মূল কাজ আপনার গানের স্থায়ী-অন্তরা-সঞ্চারীর মাঝে মাঝে পার্শ্বসঙ্গীত দেওয়া। গীতিকার, সুরকার, গায়কের সঙ্গে কোনও প্রকার আলোচনা ব্যতিরেকে, তিনিই স্থির করবেন গানের মেজাজ এবং পর্যায় কী হবে। কিন্তু, সত্যিকারের কোনও বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হবে না; শুধুমাত্র কম্পিউটারে, কি-বোর্ডে, প্রযুক্তির সাহায্যেই হবে গানের এই আয়োজন— তৈরি হবে গানের ট্র্যাক।

সেই ডিজিটাল ট্র্যাক নিয়ে এ বারে যাওয়া যেতে পারে শহরতলিতে, অসংখ্য ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কোনও এক রেকর্ডিং রুমে। এই ধাপে, গানের রেকর্ডিং-এ, কিন্তু সেখানে পাশে গীতিকার, সুরকার বা পরিচালক থাকবেন না। ট্র্যাক বাজিয়ে নানাবিধ ‘টেক’ নেওয়া হবে— যা আক্ষরিক অর্থে ‘মিক্স’ করে বেরিয়ে আসবে তাঁর নিজস্ব গান। বলা বাহুল্য, এই ‘অডিয়ো-মিক্সিং’-এর কাজ যিনি করছেন তিনি আগের কোনও ধাপের সঙ্গেইজড়িত ছিলেন না; আগের বিষয়গুলো সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানও সীমিত।

কাহিনি এখনও বাকি। ‘মিক্স’ হয়ে যে গান তৈরি হল তা শুধু শ্রবণযোগ্য— তাকে এ বারে ‘দর্শনধারী’ করতে বানাতে হয় গানের ভিডিয়ো। তাতেও একাধিক ধাপ, চিত্র-পরিচালক, ক্যামেরা-চালকের মতো একাধিক দক্ষ কলাকুশলীর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। প্রথমে, গানের ভিডিয়োর কাহিনি তৈরি হবে; সেই প্রেক্ষিতে, গানের ভিডিয়োতে অভিনয় গায়ক নিজেই করতে পারেন অথবা আলাদা অভিনেতার সাহায্য নিতে পারেন। ভিডিয়ো নির্মাণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে গান তৈরির কোনও যোগ নেই। ফলে গীতিকার হিসাবে যাঁকে প্রথমে পাওয়া গিয়েছিল, তাঁর আর কোনও ভূমিকাই থাকে না।

আজকের বারোয়ারি এই গান-শিল্প তাই ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা এক সমষ্টি-জাত বিষয় বা বস্তু। অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলা যেতে পারে ‘ভার্টিক্যালি ইন্টিগ্রেটেড’ প্রোডাক্ট— যেমন ভাবে নানা উপাদানের সমন্বয়ে গাড়ি তৈরি হয়। সাহিত্য সৃষ্টির সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। কবিতা লেখা আর গান লেখা তাই খুব আলাদা রকমের কাজ।

শুনেছি আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগে এক ঘরে বসে গীতিকার-সুরকার-গায়ক একত্রে পুজোর গান তৈরি করতেন। দুই-তিন দশক আগে নতুন বাংলা ব্যান্ডগুলোও সেই নীতিতেই বিশ্বাসী ছিল। আজ আধুনিক অর্থনীতি আমাদের গান-নির্মাণে ‘এফিশিয়েন্ট’ হতে শিখিয়েছে ঠিকই, কিন্তু, এই পথ আবার কেড়ে নিয়েছে গায়ক-শ্রোতার সরাসরি মিলনের সম্ভাবনা।

অন্য বিষয়গুলি:

Songs Music Album
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy