ভারতে আপাতত তিনটি সমস্যা খুব জটিল— তীব্র বেকারত্ব; খাদ্যপণ্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি; এবং বিপুল আর্থিক অসাম্য। এই বাজেটেই এমন তিন ব্যাধির বিশল্যকরণী খুঁজে পাবেন অর্থমন্ত্রী, সে আশা ছিল না। কিন্তু সমস্যাগুলোকে হেলায় উড়িয়ে দেওয়া কি কাজের কথা হতে পারে? তাঁর বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী সে কাজটিই করলেন।
বলা হচ্ছে যে, ভারতে এখন ‘ডেটা ড্রিভেন গভর্ন্যান্স’ চলছে— অর্থাৎ, সরকারি নীতিমালার প্রণয়ন ও রূপায়ণ হচ্ছে নিখুঁত তথ্যরাজির ভিত্তিতে। এই দাবির পিছনে যে কোনও সত্যতা নেই, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল, এখনও অবধি জনশুমারির কাজ আরম্ভ না করা। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় নমুনার সংখ্যা ছিল ৮.২৫ লক্ষ। পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভেতে ৪.১৯ লক্ষ। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার ৭৮তম রাউন্ডে নমুনার সংখ্যা ছিল ১১.৬৩ লক্ষ। নমুনা সমীক্ষার হিসাবে এই সংখ্যাগুলো যথেষ্ট বড়। কিন্তু তা কোনও ভাবেই ১৪০ কোটি মানুষকে নিয়ে হওয়া জনশুমারির বিকল্প হতে পারে না। তা ছাড়া, করোনাকাল পেরিয়ে এসে যদি ১৩৭টি দেশ জনশুমারি সেরে নিতে পারে, তা হলে আমাদের সমস্যা কোথায়? তথ্যের ঘাটতি তৈরি করেছে বিভ্রম, যার ফলে ভারতীয় অর্থব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনও কথাই আর নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
এই বিভ্রমের মধ্যেই ২০২৪-২৫’এর বাজেটে তাঁর মতো করে একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন তার উত্তর লিখেছেন। শিরোনাম দিয়েছেন ‘বাজেটের অগ্রাধিকার’। যে ন’টি ক্ষেত্রকে বেছে নেওয়া হয়েছে, সেগুলির গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন নেই। তবে খেয়াল রাখা ভাল যে, সেই অগ্রাধিকারের তালিকায় খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি বা অসাম্য নেই। নির্মলার বাজেটের অনেকখানি অংশ জুড়ে রয়েছে রয়েছে ‘কর্মসংস্থান ও দক্ষতার বিকাশ’। এ কথা দীর্ঘ দিন ধরেই আলোচিত যে, ভারতের কাজের বাজারে এখন সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হচ্ছে দক্ষতার অভাব। যুবক-যুবতীরা কলেজপর্ব চুকিয়ে যখন কাজের বাজারে ঢুকতে চান, অন্তত পঞ্চাশ শতাংশই সেখানে প্রত্যাখ্যাত হন, কারণ প্রয়োজনীয় দক্ষতা না-থাকার ফলে তাঁরা যথেষ্ট উৎপাদনশীল নন। সেই বিষয়টিকেই আপাত ভাবে মাথায় রেখে একটু আলাদা গোছের কিছু পরিকল্পনার কথা বাজেটে বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব থেকে বহু দূরের প্রত্যেকটি প্রকল্পের মধ্যেই অ-স্বচ্ছতা ও স্ব-বিরোধ রয়েছে। মনগড়া কিছু লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। যেমন জীবনের প্রথম চাকরিতেই মাসিক এক লক্ষ টাকা অবধি মাইনে পেতে পারেন, এমন বেকার ছেলেমেয়ের সংখ্যা ধরা হয়েছে ২.১০ কোটি। এই সংখ্যার উৎস কী? আর প্রথম মাসটি পেরোলেই যিনি লাখপতি, তাঁর জন্য সরকারের ঘর থেকে কেন পনেরো হাজার টাকা গচ্চা যাবে?
এ রকম অন্য দুটো প্রকল্পে বলা হচ্ছে, শিল্প ক্ষেত্রে নতুন কর্মীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কয়েক মাস বা বছর জুড়ে সরকার দিয়ে দেবে। শুধু তা-ই নয়, কর্মী-প্রতি যে অর্থ নিয়োগকর্তার বাধ্যতামূলক ভাবে ইপিএফও-কে দেওয়ার কথা, সেটাও বছর চারেক সরকার বহন করবে। এতে নাকি ত্রিশ লাখের কর্মসংস্থান হবে। এখানেও প্রশ্ন: ওই ত্রিশ লাখ কোন সূত্রে জানা গেল? এবং, সরকারের এমন অদ্ভুত ধারণা কী করে হল যে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা জোটাতে পারে না বলেই শিল্প মহল কারখানায় কাজের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও চাকরি দিতে পারে না?
গল্পের গরুকে এ বার মগডালে উঠিয়ে বাজেটে এক কোটি ছেলেমেয়ের এক বছরের ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কী করে? আগামী পাঁচ বছরে দেশের পাঁচশোটি শীর্ষ সংস্থায় এক কোটি তরুণ-তরুণী ইন্টার্নশিপ করবে। এক বছরের ইন্টার্নশিপ। প্রতি মাসে শিক্ষানবিশদের পাঁচ হাজার টাকা করে জলপানি দেবে সরকার। এ ছাড়া, শুরুতে এককালীন দেবে আরও ছয় হাজার। সব মিলিয়ে এক জন শিক্ষানবিশ এক বছরে পাবেন মোট ৬৬ হাজার টাকা। এঁদের কাজ শেখাতে এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ যা পড়বে, সংস্থা তা মেটাবে তার কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি তহবিল থেকে।
দেশের সেরা পাঁচশো সংস্থায় এখন চাকরিরত রয়েছেন ৭৩ লাখ কর্মী। এর মধ্যে মাত্র ১৩৭টি সংস্থায় দশ হাজারের বেশি কর্মী রয়েছে। যে সংস্থার নিজের কর্মী-সংখ্যাই দশ হাজারের কম, সেই সংস্থা কী করে পাঁচ বছরে কুড়ি হাজারকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বাজারের জন্য তৈরি করবে? এবং এই বাজে খরচটাই বা করবে কেন? কোনও সংস্থা তার কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কোথায় কোথায় দানখয়রাতি করবে, সরকার কি সেটাও বলে দিতে পারে?
একটা শুভংকরী ফাঁকির নমুনা দিয়ে দাঁড়ি টানি। নির্মলা বলছেন যে, আগামী পাঁচ বছরে মোট ৪.১ কোটি বেকারকে কাজের সুবিধা ও প্রশিক্ষণ বাবদ দুই লক্ষ কোটি টাকা খরচ করবে সরকার। শুধু বর্তমান বছরের জন্যই তিনি বাজেটে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ আর কর্মসংস্থান বাবদ ১.৪৮ লক্ষ কোটি টাকা আলাদা করে রেখেছেন। তার মানে কর্মসংস্থানের সব প্রকল্প চালাতে গিয়ে এক জনের পিছনে তিনি খরচ করতে পারছেন ৪৮,৭৮০ টাকা। কিন্তু, আগেই বলা হয়েছে যে, শুধু ইন্টার্নশিপ প্রকল্পেই মাথাপিছু ব্যয় হচ্ছে ৬৬,০০০ টাকা! তাই, ‘আস্তে কন কত্তা!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy