আজ যখন প্রাণ বাঁচাতে প্লেনের গায়ে-মাথায় চড়া মানুষকে পোকার মতো টুপটাপ খসে পড়তে দেখি, মানবতার পরাজয়ে গ্লানিতে ডুবে যাই। সমাজমাধ্যমে দেখি যে, সারা পৃথিবীই যেন জানত এত দ্রুত ও অনায়াসে কাবুলের পতন হবে। জানত না শুধু আফগান মেয়েরা এবং আমাদের মতো কিছু ভিন্দেশি হতবুদ্ধি!
আফগানিস্তানের নির্মম, ধর্মান্ধ অতীতে ফেরা দেখে মনে পড়ে প্রতিরোধ জারি রাখা এক কবি ও সমাজকর্মী মেয়ের কথা। দেশ সেই উপদ্রুত পশ্চিম এশিয়া। সীমান্ত পেরোনো সর্বহারা মেয়েদের দেখে মনে পড়ে প্রতিবাদী বলে যাঁর উপর রাষ্ট্রের খড়্গ নেমেছিল, শেষাবধি তাঁর হাতিয়ার থেকেছে কবিতা।
বেজান মাতর (ছবিতে) কুর্দ মেয়ে। বর্তমানে অভিবাসী বেজানের লেখা তুর্কিতে। কুর্দিশ তাঁর দেশে নিষিদ্ধ ভাষা। তাই শৈশবে ভাল ভাবে শিখতে পারেননি। ভূমধ্যসাগরীয় গ্রামে ১৯৬৮-তে সম্পন্ন জনজাতীয় পরিবারে জন্ম। মা রান্নাঘরে যেতে বললেই তুলোচাষি বাবা বলতেন, “ও পড়ছে।” বাবাকে গর্বিত করতেই বেজানের লেখালিখি শুরু। অচিরেই সামাজিক বৈষম্য তাঁর লেখার বিষয় হয়।
আঙ্কারায় আইন পড়তে গেলেন। কুর্দবিরোধী সাদ্দাম হুসেনের সময়। অতি-সচেতন বেজান উনিশেই গ্রেফতার। আটাশ মাসের কারাগারের অন্ধকারে দিনক্ষণের হিসেব গুলিয়ে গিয়েছিল। লিখেছেন, “... চব্বিশ দিনেও ওরা আমাকে ভাঙতে পারেনি... অন্ধকার সেলে আটাশ দিন... জিজ্ঞাসাবাদ চলত... শব্দহীন সঙ্গীতের সাহায্য নিলাম... কাগজ কলম নেই... অন্ধকারের ভিতর শব্দ ও সুর পেলাম... কবিতা আমার প্রাণ বাঁচাল।” এক বছর ধরে মামলা ও মুক্তিপ্রক্রিয়ার পর বাইরে এলেন। পুরনো সব লেখা পুড়িয়ে আনাতোলিয়ার ধ্বংসাবশেষ দেখতে গেলেন। বেজান তাঁর প্রাচীন ধর্ম শামা, ইয়াজ়িদি ও সুফি মিলিয়ে নিজস্ব পৃথিবীর দর্শন তৈরি করেছেন।
সাদ্দাম গেলেও বিপদ যায়নি। জেলের বিচারের বদলে প্রতিবাদী মেয়েদের শায়েস্তার সহজ উপায় এসেছে। ২০১৪-য় আইসিসের হাতে অসংখ্য ইয়াজ়িদি হত্যা, মেয়েদের যৌনদাসী করা, শিশু অপহরণ ও হীন কাজে ব্যবহার— পৃথিবীর খবরের শিরোনামে আসে। আইসিসের পিছু হটার পর অপহৃতাদের কিছু সংখ্যকের পুনর্বাসন হয়। উনিশ বছরের যে মেয়ে ছ’মাস যৌনদাসী ছিল, তার বিপর্যয় তীব্রতর হয়েছিল সেই দৃশ্যে, যেখানে বছর চল্লিশের ঘোষিত ঈশ্বরসেবক দশ বছরের শিশুকন্যায় উপগত। অবোধ বাচ্চাটি মাকে ডেকে চলেছে।
কুর্দ ও ইয়াজ়িদি হওয়ার কারণে বেজানের সম্প্রদায়কে আইসিসরা নির্মম ভাবে নিশ্চিহ্ন করার নেশায় মেতেছে। কিন্তু বেজানেরা হাল ছাড়েননি। তিন হাজার বছরের পুরনো আনাতোলিয়ার এক শহরের ইতিহাস গ্রন্থিত করেন। তাঁর গদ্যের বই লুকিং বিহাইন্ড দ্য মাউন্টেন কুর্দিস্তান ওয়ার্কিং পার্টির গেরিলাদের বিষয়ে লেখা। কান্দিল পাহাড়ে গিয়ে যোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার নেন অসমসাহসী বেজান। বর্তমানে গ্রাম থেকে বিতাড়িত শিশু, অল্পবয়সি বিশেষত মেয়েদের পুনর্বাসনে যুক্ত।
অবতারবাদ ও পুনর্জন্মে বিশ্বাসী বেজান কবিতায় নিজস্ব শামা ধর্মের আবরণ চড়িয়েছেন। তাই তাঁর লেখাকে রহস্যময় বলা হয়। সে সব কবিতার ছত্রে ছত্রে বিলাপ ও আহত অভিমানের সরাসরি প্রতিরোধ। একটি কবিতা ‘যদি এটি বিলাপ হয়’-এ দেখি— “তারা এমন একটি ভূমির কথা বলে যা কখনওই ছিল না/ যার ভাষা কখনওই অস্তিত্বহীন ছিল না...” বেজানের কবিতার শিরোনামগুলিও ইঙ্গিতময়। ‘শিশুদের কবরগুলি’, ‘একটি মৃত সূর্য’, ‘নিষিদ্ধ কথাগুলি আমি জানি’, ‘কারবালার উপরে পূর্ণিমা’, ‘এক ধৈর্যশীল ঈশ্বরের মন্দিরে’ ইত্যাদি।
প্রতিরোধ জারি থাকে। বেজানের পাশে দেখি রেওসানকেও। তিনি কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীত অবলম্বনে কুর্দ সংখ্যাগুরু শহরে, গ্রামে, আর্মেনিয়ার প্রত্যন্ত প্রান্তরে মেয়েদের মুখ থেকে হারিয়ে যেতে বসা বিয়ের গান, ফসল ফলাবার গান সংগ্রহ করেন।
প্রথাগত শিক্ষায় বঞ্চিত যে আফগান পাশতুন মেয়েরা ঘরে বাইরে ধর্মের নিগড়ে বন্দি, তাঁরাও ছদ্মনামে কবিতা লেখেন। সাহসী কবি মেয়েরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে প্রাচীন গীতিধর্মী কবিতার ধারায় নিজেদের উজাড় করে বলেছেন, “আমার শরীর সবুজ হেনা পাতার মতো/ বাইরে সবুজ ভিতরে রক্ত বাদামি, কাঁচা।”
এই সব আফগান মেয়েরা গোপনে কবিতাপ্রেমীর দল তৈরি করেছেন। মৌলবাদীরা পাশতুন মেয়েদের মুখে কপালে ঐতিহ্যের ‘ট্যাটু’র অধিকার কেড়েছে। লেখেন, “আমি আমার প্রেমিকের রক্ত দিয়ে ট্যাটু বানিয়েছি/ উদ্যানের সেরা গোলাপকে টেক্কা মেরেছে সে রং।” তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া পুরুষকে সাহস জোগান, “আমাকে ওই আত্মঘাতী কোমরবন্ধনীতেই জড়িয়ে ধরো, কিন্তু বলো না যে আমি তোমাকে চুম্বন ফেরাইনি।”
এই প্রেম, কোণঠাসা অবস্থায় প্রতিরোধ, আত্মপ্রতিষ্ঠার ইচ্ছা হয়তো আফগান মেয়েদের বাঁচিয়ে রাখবে। চিরকাল তাঁদের সঙ্গে প্রতারণাই হয়ে এসেছে, তাই আশা ছাড়া কী-ই বা করতে পারি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy