সারা দেশে প্রযুক্তিগত পড়াশোনার রূপরেখা নির্ধারণ করে যারা, সেই অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন (এআইসিটিই) সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, এখন থেকে ইংরেজির পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হবে পাঁচটি দেশীয় ভাষায়— হিন্দি, মরাঠি, তামিল, তেলুগু ও বাংলা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রযুক্তি-শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া বা আর্থিক ভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের সমানাধিকার দিতেই এ পদক্ষেপ।
জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, ভাষার কারণে উচ্চশিক্ষার সুযোগ থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। এআইসিটিই-র তরফে ৮৩,০০০ ছাত্রছাত্রীর উপর করা এক সমীক্ষায় ৪৪% জানিয়েছেন, তাঁরা মাতৃভাষায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চান। প্রসঙ্গত, ২০২০ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা চালু হয়েছে বাংলা, গুজরাতি-সহ তেরোটি প্রাদেশিক ভাষায়। সমীক্ষা বলছে, নিজের ভাষায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ইচ্ছে ৭৫% ছেলের, কিন্তু মাত্র ২৫% মেয়ের। নিজেদের ভাষায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতাংশের শীর্ষে তামিল পড়ুয়ারা, তার পর হিন্দি ও তেলুগু। সংশ্লিষ্ট কমিটি অভিমত প্রকাশ করেছে, আইআইটি, এনআইটি-সহ এআইসিটিই-র অধীনস্থ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আঞ্চলিক বা ভারতীয় ভাষায় পঠনপাঠনের সুযোগ রাখা হোক।
আইআইটিগুলি এখনই এ প্রস্তাবে সাড়া দিতে অপারগ বলে জানিয়েছে, আর ন’টি রাজ্যের চোদ্দোটি কলেজ জানিয়েছে, তারা অন্য ভাষায় পড়াতে প্রস্তুত। এআইসিটিই কিন্তু জানিয়েছে যে, ইংরেজি শেখাও বাধ্যতামূলক। যে ছাত্ররা অন্য ভাষায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন, তাঁদের চার বছর ধরে ইংরেজি ক্লাসও করতে হবে, ইংরেজি পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে প্রথম বর্ষে ‘হিউম্যানিটিজ়’ বলে একটি বিষয় থাকে, এটি আসলে ইংরেজি ক্লাস। উচ্চমাধ্যমিকের ইংরেজি পাশ করে এলে এটা কঠিন লাগা উচিত নয়। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সব বই-ই ইংরেজিতে লেখা, পড়ুয়ারা বহুলাংশই বাংলামাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করে এসেছেন। একটা প্রচলিত ধারণা আছে, বাংলামাধ্যম স্কুলের ছাত্ররা ইংরেজি ভাল শেখেন না। এ ধারণা সর্বাংশে ঠিক নয়। ছাত্রদের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বইয়ের ইংরেজি বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে, বা ইংরেজিতে লিখতে হচ্ছে বলে ঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না, এমনটা দেখা যায় না। মোদ্দা কথা, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেলে যে ইংরেজি জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, তা যথেষ্ট মৌলিক। তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
প্রযুক্তিক্ষেত্রে চাকরি করতে গিয়ে দেখেছি, শুধু বিদেশে নয়, দেশের মধ্যে চাকরিতেও ইংরেজি কত দরকার। ইতিহাস বা পদার্থবিদ্যা নিয়ে উচ্চশিক্ষা করা ছাত্রছাত্রীও কি ইংরেজির গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারবেন? নিজের ভাষায় লেখা পাঠ্যপুস্তক পেলেও, রেফারেন্স বই পাবেন কি? তা হলে এ উদ্যোগ কি দেশের মধ্যে আরও পাঁচিল তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা নয়? কোথাও কি একটা আঞ্চলিকতাবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার রাজনীতি চলছে? চিরকাল শিখে এসেছি আমাদের প্রথম পরিচয় ভারতীয়, তার পরে বাঙালি। কিছু দিন আগে হরিয়ানা সরকার ঘোষণা করেছে, সে রাজ্যে সরকারি চাকরিতে ৭০% সংরক্ষণ হরিয়ানাবাসীর জন্য। এ রকম পদক্ষেপ সব রাজ্য করতে থাকলে মানুষের কাছে এই বার্তাই যাবে— তুমি মূলত তোমার রাজ্যের মানুষ, দেশের পরিচয় পড়ে যাবে পিছনে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের পিছিয়ে পড়া বা আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষের কথা ভেবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে এই ব্যবস্থা। খুবই ভাল কথা। কিন্তু আজ প্রযুক্তিগত শিক্ষার ক্ষেত্রে বাস্তব চিত্রটা কী? সকলেই জানেন, দেশের সব থেকে গৌরবজনক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইআইটিগুলি। সেখানকার পড়ুয়াদের ৯৫% সিবিএসই বা আইসিএসই বোর্ডের স্কুল থেকে আসা। সারা দেশের স্কুলছাত্রের পরিসংখ্যানে এই বোর্ডগুলিতে পড়েন মাত্র ৫% ছাত্রছাত্রী। মানে মাত্র ৫%-এর মধ্যে থেকে আইআইটি-তে আসছে ৯৫% ছাত্রছাত্রী। দরিদ্র বা পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষ খুব একটা সুযোগ পাচ্ছেন, মনে হচ্ছে না। অনেকে বলতে পারেন, সে কারণেই এই উদ্যোগ। কিন্তু শুধু ইংরেজির কল্পিত পাঁচিল তুলে দিলেই এ অবস্থার পরিবর্তন হবে?
আইআইটিগুলিতে পড়ার খরচ চার বছরে প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা। সবার পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা ঋণের ব্যবস্থা আছে, সেও কি সবার নাগালের মধ্যে? তেইশটি আইআইটি ছাড়া দেশে ত্রিশটির উপর এনআইটি আছে। সেখানেও পড়ার খরচ চার বছরে পাঁচ লক্ষের কম নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে ক্রমাগত বরাদ্দ হ্রাসের কারণে খরচ বেড়েই চলেছে। বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার খরচ শুনলেও আঁতকে উঠতে হয়। সরকার এক দিকে খরচ বাড়িয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে ‘অবহেলিত অনগ্রসর ও আর্থিক ভাবে দুর্বল’ মানুষের জন্য ইংরেজির বদলে পাঁচটি আঞ্চলিক ভাষায় পড়ানোর ব্যবস্থা করছে। শুধু পাঁচটি আঞ্চলিক ভাষাকে ছাড়— এটা কি পাঁচ রাজ্যের মানুষের মন পাওয়ার পন্থা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy