বৃহস্পতিবারই কি নতুন শুক্রবার হতে চলেছে ব্রিটেনে? কারণ, স্যর কিয়ের স্টার্মার-এর লেবার সরকার কর্মীদের চার দিনের কর্মসপ্তাহের সুযোগ দিতে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের পথে হাঁটতে চাইছে। স্টার্মার একে বলেছেন, এ প্রজন্মের শ্রমিকদের অধিকারের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন।
জাপানের মতো কাজ-পাগল দেশে কাজের চাপে হার্ট অ্যাটাক-সহ বিবিধ কারণে বছরে মৃত্যু হয় অন্তত ৫৪ জনের। সেখানে কর্ম-প্রকরণে উদ্ভাবনী প্রয়াসের অঙ্গ হিসাবে ২০২১ থেকে সরকার সে দেশের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলিকে এবং নাগরিকদের উৎসাহ দিয়ে চলেছে চার দিনের কর্মসপ্তাহ গ্রহণের জন্য। ভারতের প্রস্তাবিত নতুন শ্রমনীতিতেও কিন্তু আছে চার দিনের কর্মসপ্তাহের কথা। অবশ্য সেটা পাঁচ দিনের কর্মসময় চার দিনের মধ্যে ঢুকিয়ে কি না, সে বিষয়ে অস্পষ্টতাও রয়েছে।
চার দিনের কর্মসপ্তাহের ধারণাটি নতুন নয়। ব্রিটেনই এ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করেছে ২০২২ সালে। ছ’মাস ব্যাপী ট্রায়ালে যোগ দেয় সে দেশের বহু সংস্থা। কর্মীদের সুবিধা, তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে প্রভাব, সংস্থার উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি নানান দিক রয়েছে এ-হেন একটি সিদ্ধান্তের। সব মিলিয়ে ফলাফল এবং প্রতিক্রিয়া হয়তো মিশ্রই। টাইলার গ্র্যাঞ্জ-এর মতো পরিবেশ-বিষয়ক পরামর্শদাতা সংস্থা যেমন সেই ২০২২ সাল থেকেই বজায় রেখেছে চার দিনের কর্মসপ্তাহ। আবার প্রকৌশল এবং শিল্প সরবরাহ সংস্থা অলক্যাপ-এর ক্ষেত্রে আদৌ কার্যকর হয়নি এটা। সুপারমার্কেট চেন মরিসন এবং অ্যাসডা চার দিনের কর্মসপ্তাহের সম্ভাবনাকেই খারিজ করেছে।
কাজের সময়সীমা বাড়লেই কি কাজ ভাল হয়, বেশি হয়? ১৯৫৫-তে দি ইকনমিস্ট পত্রিকায় এক মজার প্রবন্ধ লেখেন সিরিল পারকিনসন, যেখানে তিনি বলেন যে, বেশি সময় দিলেও কাজ ফুলে-ফেঁপে দখল করে নেয় পুরোটা সময়। সেই থেকে এর নামই হয় ‘পারকিনসন’স ল’। উদাহরণ হিসেবে এক মহিলার গল্প বলেন তিনি, যাঁর সমস্ত দিনের কাজ একটি পোস্টকার্ড পাঠানো, যা করা সম্ভব মিনিট তিনেকেই। কিন্তু হাতে প্রচুর সময় থাকার জন্য মহিলাটি এক ঘণ্টা ধরে খুঁজে বার করেন কার্ডটি, আধঘণ্টা ধরে চশমা খোঁজেন, কার্ডটি লেখেন দেড় ঘণ্টা ধরে, ২০ মিনিট ভাবেন ছাতা নিয়ে বেরোবেন কি না, আর এমনি করেই কাটিয়ে দেন পুরোটা দিন! তা হলে কি কম সময় কাজ করাই শ্রেয়? রাটগার ব্রেগম্যান ২০১৬ সালে একটি প্রবন্ধ লেখেন দ্য গার্ডিয়ান কাগজে, শিরোনাম ‘দ্য সলিউশন টু (নিয়ারলি) এভরিথিং: ওয়ার্কিং লেস’। ব্রেগম্যান সেখানে বলছেন, কর্মসময় হ্রাস ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, পরিবেশগত সমস্যা, কঠিন চাপ, অসাম্য, সুখ এবং বেকারত্বের ক্ষেত্রে।
এমনিতেই মানুষের কাজের সময় কমছে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে। শিল্পবিপ্লবের আগে মানুষকে কাজ করতে হত দৈনিক পনেরো-ষোলো ঘণ্টা। প্রযুক্তি আর যান্ত্রিক সভ্যতা অবসর বাড়িয়েছে, মানুষকে অবকাশ দিয়েছে পেশাগত কাজ বাদে অন্য দিকে তাকানোর। তবে দৈনিক কর্মকাল কমলেও কাজের দিনসংখ্যা কমেনি চট করে। সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, সপ্তাহে পাঁচ দিনের কর্মসংস্কৃতি চালু হয়েছে এক শতক আগে— ১৯২৬ সালে, হেনরি ফোর্ডের হাত ধরে। সিদ্ধান্তটা যদিও ১৯২২ সালের। হেনরির ছেলে এবং সংস্থার প্রেসিডেন্ট এডসেল ফোর্ড মনে করেছিলেন, প্রত্যেকেরই সপ্তাহে এক দিনের বেশি অবসর প্রয়োজন। তার পর শতাব্দী পেরিয়েছে। প্রযুক্তি এগিয়েছে গুণোত্তর প্রগতিতে। জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্লাবন এনেছে আমাদের জীবনশৈলীতে। তবু এখনও কর্মদিবস চার দিন না পাঁচ দিন হওয়া উচিত, তা নিয়ে চলে বিস্তর কাটাছেঁড়া।
১৯৩০-এ লেখা এক প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেন্স ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, একশো বছর পরে, অর্থাৎ ২০৩০ নাগাদ উৎপাদনশীলতা বাড়বে প্রভূত পরিমাণে, এবং মানুষকে সপ্তাহে ১৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হবে না। এবং সেটুকুও মানুষ করবে নিজেদের সন্তুষ্টির জন্য। তবু, দিনের সংখ্যার প্রেক্ষিতে কেন্স কিন্তু পাঁচ দিনের কম কর্মসপ্তাহের কথা ভাবতে পারেননি। চার দিনের কাজই যে যথেষ্ট হতে পারে, এই ধারণাটা আসতেই সময় লেগেছিল অনেকটা। কেন্সের প্রবন্ধটির প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে, ১৯৭৯ সালে, প্রথম সার্বিক ভাবে চার দিনের কর্মসপ্তাহের কথা বললেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। তার পরেও পার হতে চলল শতাব্দীর আধখানা। গত দশ-বিশ বছরে অবশ্য এ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে।
যেমন, ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত এক সামাজিক পরীক্ষা চলেছে আইসল্যান্ডে, বিভিন্ন পেশার প্রায় ২,৫০০ জনকে নিয়ে। এর সাফল্যের ফলে সে দেশের ৮৬% আজ মানুষই অধিকার পেয়েছেন কম সময় কাজ করার। কিন্তু আইসল্যান্ডের মতো একটা অতি কম জনসংখ্যার দেশে যা সহজসিদ্ধ, আমাদের মতো জনবহুল দেশে তা কতটা সুপ্রযুক্ত, সে প্রশ্ন উঠবেই। আবার মাইক্রোসফট জাপান তাদের কর্মীদের উপর চার দিনের কর্মসপ্তাহের এক পরীক্ষা চালায় ২০১৯ সালে। তাতে দেখা যায় যে, বিদ্যুতের খরচ কমেছে ২৩%, কিন্তু কর্মী-পিছু বিক্রি বেড়েছে ৪০%।
২০২০ সালে স্টেফানি জোন্সের সঙ্গে একযোগে দ্য ফোর ডে উইক নামে একটি বই লেখেন নিউ জ়িল্যান্ড-ভিত্তিক উদ্যোগপতি অ্যান্ড্রু বার্নস, যিনি চার দিনের কর্মসপ্তাহ তৈরির প্রচেষ্টায় নেতৃস্থানীয়। চার দিনের কর্মসপ্তাহকে বার্নস মনে করেছেন একুশ শতকের বৈশ্বিক অর্থনীতির নানাবিধ অসুস্থতা নিরাময়ের উপায়। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বার্নস-এর সংস্থা কর্মীদের প্রস্তাব দেয় পূর্ণ বেতনে প্রতি সপ্তাহে চার দিনের কর্মদিবসের— অতিরিক্ত কোনও কর্মঘণ্টা ছাড়াই। দেখা গেল, তাতে কর্মীদের সন্তুষ্টি বাড়ল, তাঁরা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সমৃদ্ধ হলেন, ব্যক্তিগত জীবনে খরচ করতে পারলেন খানিকটা বেশি সময়, এবং সেই সঙ্গে অফিসেও হলেন আরও মনোযোগী এবং উৎপাদনশীল।
কাজের সময় কমানোর ফল অবশ্য সর্ব ক্ষেত্রে ইতিবাচক না-ও হতে পারে। মরিসন কিংবা অ্যাসডা ছাড়াও রয়েছে উদাহরণ। ২০১৯ সালে জার্নাল অব পাবলিক ইকনমিকস-এর এক গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার ওরেগনে সপ্তাহে চার দিনের ক্লাসের ফলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রদের রিডিং আর অঙ্কের নম্বর কমেছে।
চার দিনই বা কেন, কেমন হয় যদি কর্মসপ্তাহ হয় তিন দিনের? এটা কোনও নতুন চিন্তা নয় কিন্তু। ২০১৮ সালে বিশ্ব জুড়ে এক সমীক্ষা চালায় আমেরিকান সংস্থা ক্রোনস। তাতে ৩৪% উত্তরদাতা সপ্তাহে চার দিন কাজের পক্ষে মত দেন; ২০% চান তিন দিনের কর্মসপ্তাহ, অবশ্যই মাইনে এক রেখে। ২০১৯-এর অগস্টে শাংহাইতে ওয়ার্ল্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কনফারেন্সে চিনা ধনকুবের জ্যাক মা বললেন, প্রযুক্তির উন্নতির ফলে দশ-বিশ বছরের মধ্যেই মানুষের হয়তো সপ্তাহে তিন দিন চার ঘণ্টা করে কাজ করলেই চলবে। তিন দিনের কর্মসপ্তাহও কিন্তু দেখেছে দুনিয়া— ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৭৪-এ। ব্রিটেনেই। সে সময় কয়লাখনির শ্রমিকদের সমস্যার জন্য বাধাপ্রাপ্ত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন। বিদ্যুৎ বাঁচাতে সপ্তাহে তিন দিন কাজের নিয়ম চালু করেন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। সেই তিন দিনের কর্মসপ্তাহকে তাই হয়তো আদর্শ পরিস্থিতি বলা যাবে না। আবার কাজের দিন কমালে প্রশস্ত অবসরের সময় কিছু মানুষ যে অতিরিক্ত রোজগারের জন্য মুনলাইটিংয়ের পিছনে ছুটবে না, তারও নিশ্চয়তা নেই।
অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ছাড়াই চার দিনের কর্মসপ্তাহের সাফল্যের গল্পের অন্তর্নিহিত রসায়ন সম্পর্কিত অ্যান্ড্রু বার্নসের একটি বক্তৃতা রয়েছে ইউটিউবে। সেখানে বার্নস বলেছেন, মানুষ অতিরিক্ত এক দিনের ছুটিকে ‘উপহার’ হিসাবেই নিয়েছে। কিন্তু চার দিনের কর্মদিবস যদি নিয়মে পর্যবসিত হয়, তবে কি বিষয়টা আর ‘উপহার’ থাকবে? কৃতজ্ঞ-চিত্তে অফিসে আরও মনোযোগী এবং উৎপাদনশীল থাকার চেষ্টা করবে মানুষ? না কি, তাকে ‘অধিকার’ হিসাবে ভেবে ফেললে হারিয়ে যাবে এই বিষয়গুলি? তর্ক জারি থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy