নতুন ফসলে, টাটকা আনাজে, ক্ষণস্থায়ী ঠান্ডায়, আরামের রোদ্দুরে হেমন্ত থেকে বসন্তের আগমনী অবধি এক বাড়তি খুশিয়ালি বাংলার মনকে ভরে রাখে। আজ নয়, চিরকাল।
ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২০। প্রতি বছরের মতো হাততালি দিয়ে যখন বইমেলা শেষ হচ্ছে, তখনও কারও জানা ছিল না তার দেড় মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তালি আর থালি দিয়ে জনতা কার্ফু পালন করতে বলবেন। এটাও জানা ছিল না, তালি-থালি-অকাল দীপাবলিকে ডাহা ফেল করিয়ে কোভিডের সঙ্গে আমাদের সহবাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলবে। এতটাই যে, ২০২১-এর শীত কেটে যাবে কলকাতা বইমেলা ছাড়াই। এ বার ২০২২-এ বইমেলার দিনক্ষণ ঘোষণা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওমিক্রনের নিত্য চোখরাঙানি নিশ্চিন্ত থাকতে দিচ্ছে না এক মুহূর্তও। কলকাতায় ফের লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। বইমেলা হবে? হতে পারবে? বইমেলায় যাওয়ার মতো মন থাকবে? এই দুরুদুরু সংশয় বুকে নিয়েই নতুন বছরে পা দেওয়া গেল।
অথচ এই ক’দিন আগেও মনে হচ্ছিল, আতঙ্কের গুমোট একটু হলেও কাটতে চলেছে। ২০২০-র পুজো আর ২০২১-এর পুজোর মধ্যে জনতার মেজাজে তফাত ছিল বিস্তর। ভিআইপি রোডের বাঁধভাঙা ভিড় তার প্রমাণ। পুলিশ কেন আরও আগেই সক্রিয় হল না, এ নিয়ে তর্কবিতর্ক কম হয়নি। কিন্তু সে সবের পালা চুকিয়ে সংক্রমণের তেমন বড় মাপের ঢেউ যে আছড়ে পড়েনি, সেটাই ছিল স্বস্তির জায়গা। বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট সেই সাহস নিয়েই ভিড় টেনেছিল। কিন্তু কোভিড-দানবের মতিগতি তত দিনে আবার বদলে গেছে। বছর শেষ হল বিশ্ব জুড়ে তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা আর সাবধানবাণী ললাটে লিখে। কোভিড যেন সেই হিংসুটে ভাইরাস, মানুষকে একটু ছন্দে ফিরতে দেখলেই যার গায়ে জ্বালা ধরে। যে কোনও রকম সামাজিকতার সঙ্গে তার জন্মশত্রুতা। সে এমন একটা পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে, সেখানে একত্র মেলার বাসনাই বিলীন। মানুষের জমায়েত মানুষের কাছে বিপদের বার্তা, সান্নিধ্যের ওম-স্পর্শের তাপ বিষবৎ পরিত্যাজ্য।
প্রায় দু’বছর ধরে কখনও গৃহবন্দি, কখনও বিচ্ছিন্ন, বড়জোর অতি সন্তর্পণে বর্মাচ্ছাদিত হয়ে ছোঁয়া এবং ছায়া বাঁচিয়ে শুচিবায়ুগ্রস্ত প্রাণধারণে অভ্যস্ত জীবনেতর যে জীবন, একটা বইমেলা কি একটা পৌষমেলাই পারে হ্যাঁচকা টান মেরে সেই গর্ত থেকে আমাদের বার করে আনতে। ভাইরাসের পুনঃপুনঃ আবির্ভাব বার বার সেই সুযোগ ভেস্তে দিতে চাইছে। সারা দুনিয়া জুড়ে বেশ কিছু দিন যাবৎ সমাজ ও রাজনীতিতে যে পরিমাণ বিদ্বেষের চাষ হয়ে চলেছে, কোভিড যেন তারই যুগোপযোগী। ওই দেখো ও মাস্ক পরেনি, এই দেখো এর ব্যাগে হাতশুদ্ধির বোতল নেই—‘সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে’। এক অনন্ত পুলিশি আর প্রাতিষ্ঠানিক খবরদারিতে নিমজ্জিত হয়ে ক্লিষ্ট হৃদয়ের ধুকপুকি একা একা শুনবে বলে বেঁচে থাকে। বন্ধু-পড়শি-সহযাত্রী-পথচলতি জনতা সকলের একটাই পরিচয়পত্র— ভাইরাসের সম্ভাব্য বাহক। রাষ্ট্র যেমন যে কোনও পড়ে থাকা ব্যাগকে বোমা বলে সন্দেহ করতে শেখায়, বিরোধী স্বরকে বিপজ্জনক জ্ঞান করতে শেখায় শাসক, তেমনই অতিমারি আমাদের শিখিয়েছে দূরত্বকে সুরক্ষা আর নৈকট্যকে ব্যাধি বলে মানতে।
“পরীতলার ঠান্ডা কনকনে জলে বড়রা অনেকে স্নান করতেন। গান হত, উপাসনা হত, কত রকমের দৌড়ঝাঁপ খেলা হত, বড় বড় হাঁড়ায় খিচুড়ি লাবড়া বাঁধাকপির ঘণ্ট রান্না হত। ঢালু জমির শুকনো ঘাসের উপর বসে কলাপাতায় খাওয়া হত। মাথার উপরে গাঢ় নীল আকাশ রোদে ভরে থাকত, সিরসিরে উত্তুরে হাওয়া দিত, ঢালু জমিতে আমাদের কলাপাতা থেকে পাতলা দই ঘাসের উপর জমা হত...।”
মাঘোৎসবের চড়ুইভাতির বর্ণনা দিচ্ছেন লীলা মজুমদার। পড়তে পড়তে মনে হয় রোদে ভরা নীল আকাশ, শিরশিরে উত্তুরে হাওয়ায় তো কমতি হয়নি গেল বার। প্রকৃতি অকৃপণ ছিল না কোথাও। শুধু আমরাই সাজিনি রঙিন সোয়েটারে। আমাদের জন্য ছিল না মেলামাঠের হাতছানি বা পিকনিকের হইচই। এ বারে সবেমাত্র মনে হচ্ছিল, চেনা আমেজ খানিকটা হলেও ফিরছে। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ যতই অনড় থাকুন, বিকল্প পৌষমেলা হয়েছে। কোভিড বিধি মেনে জয়দেবের মেলা হবে। পসরা না থাকলেও বাউলের আখড়া থাকবে। কলকাতায় সঙ্গীত মেলা, পৌষ উৎসব, সরস মেলা, খাদি মেলার আসর বসছে। চতুর্দশ পার্বণ বইমেলার জন্য দিন গোনা শুরু হয়েছে। তার মধ্যে আবার ত্রাসের সঞ্চার কেন করছ কোভিড?
পালা-পার্বণ-মেলা-মোচ্ছবে বাংলা ক্যালেন্ডারটি এমনিতে সারা বছরই ভরপুর হয়ে থাকে, এ কথা ঠিক। এমন ঋতু খুঁজে পাওয়া ভার, যার ঝুলিতে কোনও না কোনও উৎসব নেই। গ্রাম-শহর মিলিয়ে এলাকাভিত্তিক হরেক মেলাও কি কম? এ বাংলার পুজো-পার্বণ আর মেলার বিবরণী নচেৎ চার খণ্ডে পরিব্যাপ্ত হয় কী করে? (পশ্চিমবঙ্গের পুজো-পার্বণ ও মেলা, অশোক মিত্র)। তবু তারই মধ্যে নতুন ফসলে, টাটকা আনাজে, ক্ষণস্থায়ী ঠান্ডায়, আরামের রোদ্দুরে হেমন্ত থেকে বসন্তের আগমনী অবধি এক বাড়তি খুশিয়ালি বাংলার মনকে ভরে রাখে। আজ নয়, চিরকাল। এক সময় পৌষ মাস পড়লেই গ্রামবাংলায় শুরু হয়ে যেত বনভোজনের পালা। তাকে বলা হত ‘পোষলা’। দীনেন্দ্রকুমার রায় তার বর্ণনায় লিখছেন, “পৌষ মাস পড়িবামাত্র ছোট ছোট ছেলেরা পর্যন্ত পোষলার আয়োজন করে। পাঠশালায় গুরুমহাশয় আসিবার পূর্বে, স্কুলে টিফিনের অবকাশে, বৈকালে খেলা করিবার মাঠে, এমন কি রাত্রে আহারাদির পর বিছানায় শুইয়াও এই গুরুতর বিষয়ের পরামর্শ চলে। দিন স্থির করিতে তত বাদানুবাদ হয় না, কিন্তু স্থান স্থির করিতে তাহারা যে আন্দোলন উপস্থিত করে, লাট সভার বাজেটের বক্তৃতাও তাহার তুলনায় নিতান্ত সংক্ষিপ্ত। প্রথমে কেহ হয়তো গ্রামের সন্নিকটবর্তী কোন মাঠের নাম করিল। আর তিন জন তাহার প্রতিবাদ করিয়া বলিল, ও রকম জল-টানা মাঠে কি পোষলা করা চলে? তখন হয়তো আর একটা মাঠের নাম হইল। তাহার নিকটে জলাশয় আছে বটে, কিন্তু সেখানে নিবিড়বৃক্ষছায়াসমাসন্ন নেপথ্যের বড় অভাব। মধ্যাহ্নকালে রন্ধন ও আহারাদি ফাঁকা জমিতে চলিতে পারে না।”
শান্তিনিকেতনে ৭ পৌষের প্রস্তুতি আবার শুরু হয়ে যেত আরও আগেই। প্রমথনাথ বিশীর লেখায় দেখছি, সে আমলে অঘ্রানের শেষ থেকেই মেলামাঠে আতশবাজির কারিগরেরা ভিড় জমাতেন। “হাউই, তুবড়ী কত কী বাজি? কিন্তু সবচেয়ে যা আমাদের মনোহরণ করিত তা হইতেছে একটা কাগজের জাহাজ ও একটা কাগজের কেল্লা। অন্য সব বাজি পোড়ানো শেষ হইয়া গেলে এই দুটি গোলা ছোঁড়াছুঁড়ি যুদ্ধ করিয়া ভস্ম হইয়া যাইত।” মেলা শুরুর পরে মাঠটা যেন আর চেনা যেত না। “...কত রকমের দোকান! সন্দেশ, লোহার বাসন, কাটা কাপড়, তেলে-ভাজা, খেলনা, এমনকি শিউড়ি হইতে কয়েকখানা মোরব্বার দোকানও আসিয়াছে। মাঝখানে পাল খাটানো হইয়াছে, যাত্রাগান হইবে। এক দিকে নাগরদোলা ইতিমধ্যেই আরোহী লইয়া বন বন শব্দে পাক খাইতেছে আর মেলার শত রকমের কোলাহলকে ছাপাইয়া ধ্বনিত হইতেছে রসুন চৌকির হরিষে বিষাদের হরগৌরী রাগিণী।”
মকর সংক্রান্তি, উত্তরায়ণ, মাঘী পূর্ণিমা—বাংলা জুড়ে মেলা বসানোর উপলক্ষের কি অভাব আছে শীতে? বরং মেলার বহরে অনেক দিন অবধি পিছিয়ে ছিল কলকাতাই। আশির দশকের আগে পর্যন্ত কলকাতার শীত শাসন করত মেলা নয়, গানবাজনার আসর আর সার্কাস। নিখিল ভারত এবং নিখিল বঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলন, তানসেন সঙ্গীত সম্মেলন, সদারঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলন, ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন, মুরারি সঙ্গীত সম্মেলন— সবই তো শীতে। সুর আর প্রেমের মরসুম। কলকাতার যুবক-যুবতীদের জন্য বাড়ির বাইরে নিশিযাপনের বিরল মুহূর্ত। নবনীতা দেব সেনের স্মৃতিলিখন বলছে, “মনে রাখা দরকার তখন পুজোর সময়ে এই, ‘লে হালুয়া পইসাপুয়া’ স্টাইলের ছেলেমেয়েদের হোল নাইট ঘোরাঘুরির চল হয়নি। এমত পারমিসিভ সমাজের টিকিটিও দৃশ্যমান হয়নি তখন। হায়! এই মিউজিক কনফারেন্সগুলোতেই ছিল নিশীথরাতে চেনা অচেনা তরুণ তরুণীর মেলামেশার যৎসামান্য সুযোগ। একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি।”
নতুন বইয়ের গন্ধ, প্রেমের ঠিকানা, বন্ধুতার আলিঙ্গন আর পাঠচর্চার এক বিশাল জানলা খুলে দিয়ে এ শহরের বুকে বইমেলা এল ১৯৭৬-এ। সে বার অবশ্য মেলা বসেছিল মার্চ মাসে। ১৯৮৫ সাল থেকে জানুয়ারির ক্যালেন্ডারে ঢুকল সে শীতকালের কমলালেবুর মতোই অপরিহার্য হয়ে। ১৯৮৬-র শীত দেখেছিল এক আশ্চর্য ট্র্যাজেডির সমাপতন। ২৭ জানুয়ারি একই দিনে প্রয়াত হলেন নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এ এল ব্যাশাম। তার তিন দিন আগে ডোভার লেনে শেষ দরবারি কানাড়া বাজিয়েছিলেন নিখিল। আর ২৭-এর দু’দিন পরে ২৯ জানুয়ারি কলকাতা বইমেলা উদ্বোধন করার কথা ছিল ভারততত্ত্ববিদ ব্যাশামের।
ডোভার লেন আর বইমেলার যুগলবন্দি শীত-শহরে তোমার কী কাজ কোভিড? অনেক দিন বন্দি থেকেছি আমরা। নতুন বছরে তুমি নিজে কোয়রান্টিনে যেতে পারো না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy