অগ্নি-উপত্যকা: জেকেএলএফ নেতা ইয়াসিন মালিক যাবজ্জীবন সাজা পাওয়ায় তাঁর সমর্থকদের ক্ষোভ প্রকাশ, শ্রীনগর, ২৫ মে। রয়টার্স
বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা ইয়াসিন মালিককে যাবজ্জীবন কারাবাস দেওয়ার পরে কাশ্মীর ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে মে মাসের শেষে। এই উত্তেজনা অবশ্য ক্ষণস্থায়ী, দিন তিনেকের মধ্যে পর্যটকরা ফিরতে শুরু করেন। এই বছরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে লাখে লাখে পর্যটক গিয়েছেন। মার্চের শেষে “রোজ ৩০ থেকে ৪০ হাজার পর্যটক ঢুকেছেন”, জানালেন পর্যটক সমিতি-সমূহের সভাপতি ফারুক কুথু।
গত ২০১৬ সাল থেকে লাগাতার অশান্তি চলেছে কাশ্মীরে। ২০১৬-১৭ সালে স্থানীয় জঙ্গি কমান্ডার বুরহান ওয়ানি এবং সবজর বাটের সংঘর্ষে মৃত্যুর পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ বেগ পেতে হয় ভারতকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বন্দুক এবং শটগান ব্যবহার করতে হয়। ২০১৮-তে কোনও বড় ধরনের গন্ডগোল না হওয়ায়, ২০১৯-এ পর্যটকরা আবার ফেরেন। দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হয়।
ঠিক এই সময়ে, ২০১৯-এর অগস্টে, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করা হয়; কার্ফু জারি হয়, জনশূন্য হয়ে যায় উপত্যকা। পরের দু’বছরে কোভিড-প্রভাবিত লকডাউনের জেরে পর্যটন কার্যত বন্ধ ছিল। আবার এই বছরে পর্যটকরা ফিরেছেন। এক ওষুধ কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত কর্তা আবদুল হামিদের কথায় “এত পর্যটক জীবনে দেখিনি।”
এখানে দু’টি প্রশ্ন করা যেতে পারে। এক, মর্যাদা প্রত্যাহারের পরেও যখন কেউ রাস্তায় নামলেন না এবং পর্যটকরাও ফিরতে শুরু করলেন, তখন কি বলা যায় নীতিনির্ধারকদের একাংশের দাবি ঠিক— কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে? দুই, এর পরের ধাপ কী?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্নও করা যেতে পারে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিরাপত্তা কর্মীর সংখ্যা কমছে না কেন? কাশ্মীরে সব মিলিয়ে কত সেনা, বিভিন্ন আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য, রাজ্য পুলিশ, সাদা পোশাকের খবর সংগ্রাহক রয়েছেন, তার হিসাব পাওয়া যায় না। সিভিল সোসাইটি বা সুশীল সমাজের উপরেও চাপ অক্ষুণ্ণ। জম্মু কাশ্মীর হাই কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাত বারের সাধারণ সম্পাদক জি এন শাহিন জানালেন, গত দুই বছর অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন করতে দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন কর্মী-পেশাদারদের সংগঠন যেমন শিক্ষক, আইনজীবী বা ব্যবসায়ী সমিতির উপরে প্রবল চাপ, যাতে তারা কোনও আন্দোলনে মদত না দেয়। সংগঠনের অনেক কোটিপতি কর্তাই গত দু’বছরে জেলে গিয়েছেন। মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে সক্রিয় খুরম পারভেজকে গ্রেফতার করে দিল্লিতে রাখা হয়েছে। সাংবাদিকদের অবস্থাও শোচনীয়। নিয়মিত তাঁদের গ্রেফতার করে বা না করে আটকে রাখা হচ্ছে, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ নিয়ে নেওয়া হচ্ছে। উর্দু কাগজের এক সম্পাদকের কথায়, “কপি সরকারকে দেখিয়ে ছাড়তে হচ্ছে। জঙ্গির পরিবর্তে সন্ত্রাসবাদী লিখতে বলা হয়েছে।” প্রায় তিন সপ্তাহ কাশ্মীরে থাকাকালীন দেখলাম, প্রতিটি সংবাদপত্রে একই গোত্রের উন্নয়নের খবর বেরোচ্ছে, যা স্পষ্টতই সরকারি বিজ্ঞপ্তি-নির্দেশিত।
কাশ্মীরে সাংবাদিক এখন তিন ধরনের। এক, যাঁরা পুরোপুরি সরকারের হয়ে লিখছেন। দুই, যাঁরা অল্পবয়স্ক এবং ঝুঁকি নিয়ে বিদেশের বা কাশ্মীরের বাইরের পত্রিকায় ফ্রিল্যান্সিং করছেন। এঁরা গ্রেফতার হচ্ছেন। অথবা দিল্লি গিয়ে সাংবাদিকতা করছেন। তিন, যাঁদের বয়স বছর পঞ্চাশ, তাঁরা প্রায় সবাই সাংবাদিকতা ছেড়ে পারিবারিক ব্যবসা বা সংসার সামলাচ্ছেন। সেই রকম এক সাংবাদিকের প্রশ্ন, “পাঁচশো শব্দ লিখে কে পাঁচ বছর জেলে থাকবে?” কাশ্মীর প্রেস ক্লাবও সরকারের দখলে। ফলে কাশ্মীর থেকে দিল্লি হয়ে খবর ভারতের বাইরে আর বেরোচ্ছে না।
সবচেয়ে বড় কথা, কাশ্মীরের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সম্পূর্ণ অকেজো। এই দুই দলের প্রধান কাজ ছিল দিল্লি এবং কাশ্মীরের মধ্যে যোগাযোগ রাখা, ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত করা। গত দু’বছরে দলগুলির সাইনবোর্ডও কার্যত উঠে গিয়েছে। প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রাতারাতি নীতি পরিবর্তন করে ফেলছে। রাজ্য সরকারের খাস জমি বিভিন্ন দফতর বা কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রক ও নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে নিয়মিত তুলে দেওয়া হচ্ছে। এক কথায়, কাশ্মীর এখন পুরোপুরি দিল্লি-নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের অধীন। রাজনীতির ভূমিকা শূন্য।
কাশ্মীরের একাধিক প্রশাসনিক কর্তা গত চার-পাঁচ বছরে বলেছেন, চাপ দিয়ে শান্তি ফেরানো ছাড়া স্থিতাবস্থা বজায় রাখা মুশকিল। কারণ, সুশীল সমাজকে পাকিস্তান অর্থ এবং পরিকাঠামোগত সাহায্য দিচ্ছে। সরকারি অফিসারদের বক্তব্য, ২০১৬-১৭ সালে সংঘাতের যে আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল, তার পিছনে সুশীল সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের, বিশেষত শিক্ষক সংগঠনের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। ছাত্রছাত্রীদের পেলেট-বিদ্ধ মুখের ছবি বিশ্বের প্রায় সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, ধাক্কা খেয়েছিল ভারতের ভাবমূর্তি।
সুতরাং, ব্যবস্থা করা হয়। কোনও ছোটখাটো বিক্ষোভ হলেই, বিক্ষোভকারীদের জেলে পোরা যার একটি। অনেককে একাধিক ধারায়— বিশেষত সন্ত্রাসদমন আইন, পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট-এ— গ্রেফতার করা হয়। এই আইনে জামিন পেতে অন্তত দুই-তিন বছর লাগে। শাহিন সাহেবের কথায়, ১০-১২ হাজারকে এ ভাবেই সারা বছর জেলে রাখা হয়। নয়াদিল্লির দৃষ্টিকোণ থেকে চাপ সৃষ্টির ভাল দিকটা হল ২০১৬-১৭’র মতো সর্বজনীন প্রতিবাদ রুখে দেওয়া, ২০১৯-এর পরে।
আর খারাপ দিকটা হল, কাশ্মীরি পণ্ডিত, কাশ্মীরে কর্মরত হিন্দু ভারতীয় এবং কাশ্মীরি ‘এথনিক’ মুসলিম, যার মধ্যে সাধারণ পুলিশকর্মীও রয়েছেন— এঁদের উপরে ধারাবাহিক হামলা। এঁরা ‘সফট টার্গেট’, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ। এঁদের কে বা কারা মারছে, বোঝা সম্ভব নয়। বস্তুত, কাশ্মীরে কখনওই হত্যাকারী চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু শান্ত কাশ্মীরে অশান্তি যে অব্যাহত, তা সাম্প্রতিক মৃত্যুমিছিল থেকেই স্পষ্ট। কাশ্মীর সমস্যার ‘সমাধান’ করে ফেলতে পারলেও, কেন নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না, তা বোঝা যায়।
সম্প্রতি, ৩১ মে থেকে ২ জুনের মধ্যে, মধ্য কাশ্মীরের কুলগামে দু’জন হিন্দুকে গুলি করে মারা হয়, এক জন কাশ্মীরের, অপর জন রাজস্থানের। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে যে সমস্ত কাশ্মীরি পণ্ডিতকে গত কয়েক বছরে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে, তাঁরা আবার কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। সরকার কথাবার্তা বলছে। এই ধরনের ঘটনা যে কাশ্মীরে ঘটতে পারে তা দিল্লির নীতিনির্ধারকদের একাংশ আঁচ করতে পারছিলেন। যে কারণে চাপ দিয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা ছাড়াও কাশ্মীরকে ঠান্ডা রাখতে একটা ভিন্ন মতও কিন্তু আলোচিত হচ্ছিল দিল্লির দরবারে।
এই মতটিকে বলা হচ্ছে ‘প্রেশার কুকার থিয়োরি’— চাপ বেড়ে গেলে, বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। ফলে কিছু ক্ষেত্রে চাপ কমাতে হবে, যেমন রাজনৈতিক নেতাদের কথা বলার সীমিত স্বাধীনতা দিতে হবে। এই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত বছর কাশ্মীরের নেতানেত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মনে করা হয়, চাপ কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান মেহবুবা মুফতি অবশ্য এর কিছু মাস পরেই বলেন, পাকিস্তানকে আলোচনায় আনতে হবে। ভারতের কট্টরপন্থীরা বলেন, কাশ্মীরের নেতানেত্রীরা আবার সংঘাতের পরিবেশ সৃষ্টি করছেন; যাতে তাঁরা সেটা করতে না পারেন, সেই লক্ষ্যে চাপ বজায় রাখতে হবে। সেটাই চলছে।
কাশ্মীর ফাইলস ছবির প্রচার থেকে মোটামুটি পরিষ্কার, কাশ্মীরি পণ্ডিত-সহ হিন্দুদের উপত্যকায় ফেরানো ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বড় বিষয় হতে চলেছে। সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিজেপি পদক্ষেপ করবে বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। বিষয়টি বরাবরই থেকেছে বিজেপির ইস্তাহারে। কাশ্মীর প্রশ্নে, কাশ্মীরে বা ভারতে কোনও রাজনৈতিক বিরোধিতা না থাকার কারণে, এটা বাস্তবায়িত করাও সহজ।
সে ক্ষেত্রে, ২০১৯-এর নির্বাচনে রামমন্দিরের মতোই, ২০২৪-এ পণ্ডিতদের প্রত্যাবর্তন কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হতে পারে। এতে লাভ পুরোপুরি বিজেপির— কাশ্মীরে যতটা, তার থেকে অনেক বেশি বাকি ভারতে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy