দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সত্যিই দ্রুতগতি সম্পন্ন কি না, বিচার করতে বসলে স্পষ্ট দেখা যাবে যে ভারত এই মুহূর্তে সবক’টি শর্ত পূরণ করতে পারছে না। — ফাইল চিত্র।
গত চার দশক বা তার চেয়ে বেশি সময়ে ভারতীয় অর্থনীতির পরিকাঠামো নাটকীয় ভাবে বদলে গিয়েছে। ১৯৮০-’৮১ সালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, অর্থনীতির কৃষিজ উৎপাদনের অংশ ৩৮ শতাংশ থেকে কমে ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্য দিকে পরিষেবা সংক্রান্ত অংশ ৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। শিল্পোৎপাদনের অংশ (নির্মাণশিল্প সমেত) কিন্তু ২৬ শতাংশে মোটামুটি অপরিবর্তিতই থেকেছে। সুতরাং, অর্থনীতির সব থেকে ধীরগতির ক্ষেত্র কৃষির অন্যদের তুলনায় অবনমনই ঘটেছে বলা যায়। আর এই সময়ের মধ্যে পরিষেবাই (সব চেয়ে দ্রুতগতির) অর্থনীতির প্রধানতম ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
অর্থনীতির সার্বিক বৃদ্ধির দিক থেকে দেখলে এই পরিকাঠামোগত পরিবর্তন কোন দিকে ইঙ্গিত দেয়? ক্ষেত্রভিত্তিক বৃদ্ধির হার অপরিবর্তিত রয়েছে ধরে নিলে পরিষেবা ক্ষেত্রের দ্রুত বৃদ্ধি অর্থনীতির সার্বিক বিকাশকেই বোঝায়। তিনটি ক্ষেত্রের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা মাথায় রেখেই দেখা যায়, আশির দশকের বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৫ শতাংশ আর এখন সেই হার দাঁড়িয়েছে ৬.৩ শতাংশ।
এখন অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। যেমন আয়ুসীমা। ১৯৮০-র দশকে যা ছিল ৫৪ বছর, এই মুহূর্তে তা ৭০ বছরে দাঁড়িয়েছে। অন্য দিক থেকে ভাবলে গড় হিসেবে প্রায় কোনও ভারতীয়ই আর কর্মরত বয়সে মারা যান না। সে কারণে উৎপাদনশীলতারও বাড়ার কথা। সেই সঙ্গে শিক্ষার বিস্তারও দ্রুতগতিসম্পন্ন হওয়ার কথা। স্কুলগুলিতে নথিভুক্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা সত্যিই দ্রুত বেড়েছে। অবশ্য শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গিয়েছে। এ সবের পাশাপাশি স্থায়ী আমানতে লগ্নির হারেও বৃদ্ধি লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে (১৯৮০-’৮১ সালে যা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি-র ১৯.৭ শতাংশ ছিল, তা অতিমারির আগে ২৮.৬ হয়ে দাঁড়ায়)। একই সঙ্গে ডিজিটালাইজেশনের মতো দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও জোয়ার এসেছে।
এই সব বিষয়ের কয়েকটি অর্থনীতির ক্ষেত্রগত বৃদ্ধির পিছনে কাজ করে থাকতে পারে। সে কথা মাথায় রেখেই কেউ যুক্তিসমত ভাবে প্রশ্ন তুলতে পারেন, ভারতীয় অর্থনীতির সম্ভাব্য বার্ষিক বৃদ্ধি অন্তত ৭ শতাংশ হওয়া উচিত। যে পরিসংখ্যান থেকে কোনও দেশের অর্থনীতি সত্যিই দ্রুত গতি পাচ্ছে কি না তা বোঝা যায়। অতিমারির আগের দু’দশকে ভারতের অর্থনীতি বেশ কিছু চড়াই-উতরাই পার হলেও দেশের গড় বার্ষিক বৃদ্ধির হার এই ‘ম্যাজিক নম্বর’ থেকে খুব পিছিয়ে ছিল না।
সুতরাং এটি লক্ষণীয় (হয়তো খানিক বিস্ময়করও) যে, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার বা আইএমএফ মনে করে, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভারতের সম্ভাবনা কিছুটা অতিমারি এবং বাকিটা অন্যান্য কারণে মার খাচ্ছে। আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়ের অলিভার গোরনিকাস গত মাসে বিশ্ব অর্থনীতির বৃদ্ধির বিষয়ে বলতে গিয়ে দেখিয়েছেন যে, চলতি বছরে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি (আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী ৫.৯ শতাংশ) তার ক্ষমতার খুবই নিকটবর্তী। ফলে প্রকৃত এবং সম্ভাব্য বৃদ্ধির মধ্যেকার ‘আউটপুট গ্যাপ’ আর নেই। গোরনিকাসের বক্তব্যকে অবশ্যই বেদবাক্য হিসেবে ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে, প্রকৃতপক্ষে কি এটি ৬ শতাংশ? অর্থাৎ, গত দু’দশকে যেখানে পৌঁছনো গিয়েছিল, তার চেয়ে লক্ষণীয় ভাবে কম?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে অর্থনীতির উপর কোভিড অতিমারির মাঝারি মাপের প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। যার ফল হিসাবে বহু মানুষকেই জীবনধারণের জন্য অর্থনীতির অপেক্ষাকৃত দুর্বল ক্ষেত্র কৃষিতে ফিরে যেতে হয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার সঙ্গে আনুপাতিক হিসাবে শ্রমজীবী জনসংখ্যা কমেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি মাপের উদ্যোগগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবং এই সমস্ত কিছু থেকে ভোগ এবং বিনিয়োগের চাহিদায় পতন দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের সরকারি ঋণের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ব্যক্তিগত ব্যয়ের ক্ষেত্রে হ্রাস ঘটায় সরকার অর্থনীতির সেই ঘাটতিকে ঋণ দিয়ে পূরণ করতে চাইছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের গতি শ্লথ হয়ে পড়ার বিষয়টিকেও এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণকে। পাশাপাশি, পরিবহণ পরিকাঠামোয় বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন মেটাতে পুঁজিনিবিড় চরিত্রের লগ্নির বিষয়টিকেও ধরতে হবে। এর সঙ্গে যোগ করা দরকার ভ্রান্ত নীতি গ্রহণের (যেমন আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি থেকে দূরে থাকার নীতি) ফলে তৈরি সমস্যা এবং অবশ্যই যুদ্ধ ও তার ফল হিসাবে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিষয়গুলিকেও।
এই সমস্ত কিছু বিবেচনা করেই দেশের অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। ভারত যে এখন বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলির মধ্যে দ্রুততম বৃদ্ধির দেশ, তা অবশ্যই গর্বের ব্যাপার। কিন্তু এই ‘গতি’-র বিষয়টি একান্ত ভাবেই আপেক্ষিক। প্রকৃত অর্থেই তার অর্থনৈতিক বৃদ্ধি দ্রুতগতি সম্পন্ন কি না, বিচার করতে বসলে স্পষ্ট দেখা যাবে যে ভারত এই মুহূর্তে সবক’টি শর্ত পূরণ করতে পারছে না। ৭ শতাংশের কম বা ৬ শতাংশের বেশি— দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির এই মাপকাঠি বজায় রাখলে সরকারের আশু কর্তব্য বলে যা মনে হয়, তা হল দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মনিযুক্তির ক্ষমতাকেও বাড়িয়ে তোলা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy