Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
প্রতিবাদী দেশপ্রেম
Qatar World Cup 2022

একটা তৃতীয় পথই কি দেখালেন ইরানের ফুটবলাররা

বিশ্বকাপে খেলোয়াড়দের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্মান, জাতীয় আবেগ ইত্যাদি জড়িয়ে দেওয়া থাকে। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের বিরুদ্ধে এমন ক্ষোভ প্রকাশ— চাইলে একে শাসক ‘দেশদ্রোহ’ নাম দিতেই পারেন।

স্তব্ধ: বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীতের সময়ে নীরব ইরানি ফুটবলাররা, ২১ নভেম্বর, দোহা, কাতার। রয়টার্স

স্তব্ধ: বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ শুরুর আগে জাতীয় সঙ্গীতের সময়ে নীরব ইরানি ফুটবলাররা, ২১ নভেম্বর, দোহা, কাতার। রয়টার্স

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২২ ০৭:০৩
Share: Save:

মনে পড়ছে, আত্মজীবনীতে গান্ধীজি লিখেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একটি অভিজ্ঞতা, কিছু মানুষ মিলে একটি ছোট প্রতিবাদের ঘটনা। নাম দিয়েছিলেন ‘মিনিয়েচার সত্যাগ্রহ’। আত্মজীবনীর ওই অধ্যায়ের নামটিও ছিল একই: মিনিয়েচার সত্যাগ্রহ। যাঁরা ভেবেছিলেন অল্প কয়েক জন বলে সেই প্রতিবাদের জোর কম হবে, তাঁরা যে কত ভুল ভেবেছিলেন, গান্ধীর লেখায় সে বৃত্তান্ত আছে। একটি স্ফুলিঙ্গ কিংবা এক বিন্দু বালুকণাকে কি উপেক্ষা করা যায়, ‘মিনি’ হলেও?

গত সপ্তাহে বিশ্বকাপে নিজেদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠার সময় ইরানের এগারো জন ফুটবলার যখন রীতি (ও নীতি) অনুযায়ী গানে ঠোঁট না মিলিয়ে নীরব হয়ে রইলেন, সামান্য দূরে শূন্য অভিমুখে নিবদ্ধ রইল তাঁদের ক্ষুব্ধ অভিমানী দৃষ্টি— দেখে গায়ে কাঁটা দিল। মনে হল, এ যেন ঠিক অমনি ‘মিনিয়েচার সত্যাগ্রহ’। সেই স্ফুলিঙ্গ, কিংবা সেই বালুকণা— ওর মধ্যে এমন কিছু লুকিয়ে আছে যাকে গুরুত্ব না দিলে বিরাট ভুল হবে।

গুরুত্ব অবশ্য পেয়েছে সে ঘটনা। বিশ্ব জুড়ে কলরোল পড়েছিল সে দিন। দেশবিদেশের হেডলাইনে ঝকঝক করেছিল ইরানি ফুটবলারদের নীরব প্রতিবাদ। তাঁদের দেশে এখন যে মারাত্মক সব ঘটনা ঘটছে, বা ঘটানো হচ্ছে— তার বিরুদ্ধতা করে জাতীয় সঙ্গীত না গাইবার সিদ্ধান্তের পরিণতি কী হতে পারে, বিশ্বব্যাপী দর্শকদের বুঝতে ভুল হয়নি তা-ও। বিশ্বকাপের খেলোয়াড়দের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সম্মান, জাতীয় আবেগ ইত্যাদি জড়িয়ে দেওয়া থাকে। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের বিরুদ্ধে এমন ক্ষোভ প্রকাশ— চাইলে একে শাসক ‘দেশদ্রোহ’ নাম দিতেই পারেন। বিশেষ করে সেই শাসক, যাঁরা মাহসা আমিনি নামে বাইশ বছরের তরুণীটির প্রাণ নিয়েছেন কেবল সে হিজাবটি ‘ঠিক করে’ পরেনি বলে। যে দেশে মাহসার রাষ্ট্রীয় হত্যার প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনের উপর চলছে অমানুষিক দমন, অসংখ্য মানুষকে জেলে ভরা হচ্ছে, নারী-পুরুষ কিশোর-বৃদ্ধ নিরপেক্ষ ভাবে নির্যাতন চলছে— সেখানকার শাসক কি এই ফুটবলাররা দেশে ফিরলে ছেড়ে কথা কইবে? ইরানে ইতিমধ্যেই সরকারি রোষনির্ঘোষ: ‘এত সাহস ওদের?’

‘এত সাহস’ তো ওঁরা পেয়েছেন ওঁদের দেশের মানুষজনের কাছ থেকেই, সোজাসুজি। কী কাণ্ডই করছেন ইরানের সাধারণ মানুষ। এক কন্যার প্রাণ গেল বলে শয়ে শয়ে ইরানি কন্যারা হিজাব খুলে ফেলছেন, চুল কেটে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন। পুরুষরা বেরিয়ে আসছেন রাস্তায়, মেয়েদের অধিকার আর নাগরিকের স্বাধীনতার দাবিতে শাসকের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। ‘স্বৈরতন্ত্রী মুর্দাবাদ’ স্লোগানে ভরিয়ে দিচ্ছেন আকাশবাতাস। এ তো শুধু হিজাবের প্রশ্ন নয়, নারীর প্রতি অমানবিক বৈষম্য দেখানোর সংস্কৃতির বিষয়ও নয়। নারীপুরুষবালবৃদ্ধ নিরপেক্ষ ভাবে নাগরিক সমাজের অবরুদ্ধ যন্ত্রণার কাহিনি, অনেক দীর্ঘ কাহিনি। তাঁদের ধৈর্য আর সহ্যের বাঁধ যেন ভেঙে গিয়েছে। সেই প্রাবল্যের সামনে রাষ্ট্রীয় জলকামানের তোড়ও এঁটে উঠতে পারছে না। অনেকে বলছেন, ১৯৭৮ সালের সেই কাঁপিয়ে-দেওয়া ইরান বিপ্লবের ‘রি-মেক’ যেন। এ বারও শাসককে ধুয়েমুছে নিয়ে যেতে চায় প্রতিবাদের স্রোত: তেহরানের এক অধ্যাপকের ভাষায় ‘কষ্ট আর রাগের আগ্নেয়গিরি উদ্গিরণ’।

ইরানের সরকারও যেন উন্মত্ত হয়ে গিয়েছে। শীতল কঠোর তীব্র দমনে ব্যস্ত আয়াতোল্লা-আশীর্বাদধন্য শাসকরা। অবাধে জেলে পোরা হচ্ছে আন্দোলনকারীদের। আরও কত জেল লাগবে সে দেশে কে জানে, কেননা এখনই জেলগুলিতে তিলধারণের জায়গা নেই। অবর্ণনীয় পরিস্থিতিতে ঠেসেঠুসে রাখা বন্দিরা অনেকে জেলের পাঁচিল বেয়ে পালানোর চেষ্টা করলে পিছন থেকে ধেয়ে আসছে বন্দুকের গুলি। আগুনও লেগেছে জেলের মধ্যে, তার ফলে ভিতরে কী ঘটেছে সে তথ্য এখনও অজানা। নিহতের সংখ্যা প্রতি দিন লাফিয়ে বাড়ছে। অন্যান্য দেশ, বিশেষত আমেরিকা কিংবা ইজ়রায়েল যত বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করছে, দেশের ভিতরে দমনের অমানবিকতার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে ততই।

বিশ্বকাপে ইরানের খেলোয়াড়দের মধ্যে গোড়া থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছিল টেনশন, অস্থিরতা। অধিনায়ক এহাসান হাজসাফি দিনের ম্যাচের আগে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন: “আমাদের দেশের সব অত্যাচারিত পরিবারের জন্য আমাদের বার্তা— তাঁরা যেন জানেন আমরা তাঁদের সঙ্গে আছি, তাঁদের কষ্ট আমরাও বহন করছি।” যখনই খেলোয়াড়রা মাঠে, গ্যালারিতে তাঁদের দেশের মানুষ ও সমর্থকদের কণ্ঠে— গোল বা খেলার দাবির বদলে আমিনি-র নামে স্লোগান। জাতীয় সঙ্গীতের সময় প্রতিবাদের স্বর-সুর ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন অনেকে। এ বার বিশ্বকাপে বহু ইরানি নিজেদের দেশের দলকে আদৌ জয়ী দেখতে চান কি না, সেই ভেবে দ্বন্দ্বে জর্জরিত।

উল্টো দিকটাও কম তীব্র নয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা কঠোর নিন্দা তো করেছেনই, ‘ট্রেটর’ও বলেছেন ফুটবলারদের। শাসকদের সমর্থকরাও চুপ করে নেই। দেশের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র কায়হান, যার প্রধান সম্পাদক সরাসরি আয়াতোল্লা আলি খামেনেই-এর নিজের হাতে নির্বাচিত ও নিযুক্ত। কায়হান-এর হেডলাইন: বাইরের শক্তির প্রভাবের ফলেই খেলোয়াড়রা এমন দেশবিরোধী কাজ করতে পারলেন।

ওই দিনের ম্যাচের পর খেলোয়াড়রা অবশ্য আর বেশি দূর টানেননি ‘বিদ্রোহ’। দিন চারেক বাদে পরের খেলাতেই আরম্ভের জাতীয় সঙ্গীতে তাঁরা গলা মেলালেন। তাতেও আবার অন্য অশান্তি। সরকারবিরোধীদের প্রশ্ন: কেন পরিবর্তন? কেন সরে গেলেন ওঁরা প্রতিবাদ থেকে? আশঙ্কায়? আতঙ্কে?

আশঙ্কা বা আতঙ্ক যদি হয়, দোষ দেওয়া যায় না অবশ্য। খেলোয়াড়ই তো ওঁরা, রাজনীতিক নন, বিদ্রোহী বা বিপ্লবী নন। এর চেয়ে আরও বেশি হয়তো ওঁরা এগোতে চাননি। কঠিন পরিস্থিতি, এঁদের মতো আরও অনেক, অনেকের। এক দিকে নিজের প্রিয়তম ভূমিতে অনাচারী অত্যাচারী শাসক। অন্য দিকে নিজের, পরিবারের, পরিজনের প্রাণের সুরক্ষা, দিনযাপনের নিরাপত্তা। কী বিরাট দ্বন্দ্ব, কী সাংঘাতিক আত্মিক দোলাচল। হয় ন্যায়ের পক্ষে জীবন বাজি রেখে লড়া, নয় চুপ করে সব অন্যায় মেনে নেওয়া— এই দুটোই তো পথ।

না কি, তা নয়? না কি, একটা তৃতীয় পথই দেখিয়ে গেলেন ইরানের ফুটবলাররা? ঘোর অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে, হবেই। চুপ করে থাকা হবে পাপ। তাঁদের যতটা সাধ্য, তাঁদের কাছে যেটুকু অস্ত্র মজুত, সেই ‘নীরবতা’ দিয়েই তাই প্রতিবাদে শামিল হলেন তাঁরা। আবার উল্টো দিকে, শাসকই তো সবটুকু ‘দেশ’ নয়, দেশের মানুষও তো ‘দেশ’। সেই বাকি দেশের দিকে তাকিয়েই পরের দিন গানও গাইলেন। জাতীয় সঙ্গীতকে অবমাননা করা বা পরিত্যাগ করা তো তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁরা তো দেশের হয়েই খেলছেন, দেশের সম্মান উঁচু করার জন্যই তাঁদের এতখানি পরিশ্রম। জাতীয় সঙ্গীত তো প্রতিটি খেলোয়াড়ের কাছে আবেগের বস্তু; নিজের, বড় নিজের সেই আবেগ, স্বদেশ-স্বজনের জন্য আবেগ। জাতীয় পতাকার দিকে তাকিয়ে তাঁরা শরীরের সবটুকু শক্তি নিংড়ে মাঠে ছুটে বেড়ান। জাতীয় সঙ্গীতের সুরে নিজেদের আবেগ-অনুভব মিলিয়ে দিয়ে শরীরের সবটুকু শক্তি, মনের সবটুকু সাহসকে সংহত করে প্রতিপক্ষের সঙ্গে যোঝেন— খেলা তো দেশেরই জন্য।

আর তাই, এ ভাবেও দেখা চলে তাঁদের আচরণের পরম্পরাকে যে, সে দিন তাঁরা সঙ্গীতে গলা না মিলিয়ে যে বার্তাটি দিয়েছেন, তা তো দেশের বিরুদ্ধে নয়— দেশের শাসকের বিরুদ্ধে। মানুষের বিরুদ্ধে নয়, সরকারের বিরুদ্ধে। আর, তার পরের দিন জাতীয় সঙ্গীতে গলা মিলিয়ে তাঁরা যে বার্তাটি দিয়েছেন, সেটা দেশপ্রেমের। মানুষের জন্য। জানিয়ে দিয়েছেন, প্রতিবাদীদের কাছেও জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকাই কিন্তু চরম হাতিয়ার, পরম আশ্রয়। জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকা শাসকের নয়— মানুষের। দেশটাও।

ভাবনাটা সহজ, কিন্তু মাঝেমধ্যেই বড় গুলিয়ে যায়। দেশ আর দেশের শাসক তো এক নয়, হতে পারে না। অথচ শাসকের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে শাসকরা কায়দা করে এমন একটা প্রচার চালান— প্রতিবাদটা যেন দেশেরই বিরুদ্ধে। সমালোচককে তাঁরা দেশদ্রোহী বানিয়ে দেন। গত শনি-রবিবার চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বিরুদ্ধে অকস্মাৎ যাঁরা বিদ্রোহ করে পথে নামলেন, তাঁদেরও নিশ্চয় তা-ই বলা হবে! যত বড় কর্তৃত্ববাদ, যত বড় একনায়ক— তত বেশি দেশদ্রোহের তকমা বিতরণ!

এই পরিবেশে আলাদা করে মনে থাকবে ইরানি ফুটবলারদের কথা। তাঁদের ‘মিনিয়েচার সত্যাগ্রহ’ যেন নিকষ অন্ধকারে হঠাৎ জ্বলে ওঠা একটি বাতি।

অন্য বিষয়গুলি:

Qatar World Cup 2022 Iran Mahsa Amini
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy