সোনার কৌলীন্য ছটায় রুপো চিরকালই ম্লান। আমরা হামলে পড়ি সোনা দেখলে, রুপোর দিকে তাকাই আড়চোখে, এমনই আমাদের প্রকৃতি। সুবর্ণগোলকের আধিপত্য মোটেও কমবে না বটে, তবে বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিয়োরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) সম্প্রতি সিলভার ফান্ডের অনুমতি দেওয়ায়, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলির মধ্যে খানিক হিড়িক পড়েছে রুপোভিত্তিক ফান্ডের অনুমোদন চাওয়ার। গোল্ড ফান্ড তো এমনিতেই আছে। ইদানীং এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডের রমরমায় সোনায় বিনিয়োগ প্রভূত পরিমাণে বাড়ছে। রুপোতেও যে তেমন হতে পারে না, বলার কোনও কারণ নেই।
ঐতিহাসিক ভাবে, রুপোয় লগ্নি নিয়ে কখনও খুব উদ্দীপনা ছিল না। যা হয়েছে, তার প্রায় সবই বিশিষ্টতাবর্জিত এবং গতানুগতিক। উৎসবের মরসুমে কেউ কেউ কিনেছেন, এই পর্যন্তই। আজকাল সুদৃশ্য রৌপ্যালঙ্কার নিয়ে অনেকে মাতামাতি করেন বটে, তবে রুপোর অন্যতম কদর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বস্তু হয়ে থাকার দৌলতে। ঠাকুমার বিয়ের রুপোর পানের বাটা পারিবারিক সম্পত্তি হিসাবে এক প্রজন্ম দিয়ে যায় পরেরটিকে। বাঙালির কাছে রুপো কাব্যেও উপেক্ষিত। সোনার তুলনায় কবি-গল্পকাররা তাকে ব্রাত্য করেই রেখেছেন। জমিদার গিন্নি স্বামীর কাছে আবদার করেন সোনার মহার্ঘ সাতনরির— সেখানে রজকিনি হয়তো সামান্য রুপোর বাউটি পেয়েই খুশি। চাঁদির সঙ্গে মিলিয়ে চাঁদ এবং সুবর্ণের সঙ্গে সূর্য, উপমাগুলির ব্যঞ্জনাও ভিন্ন।
বাঙালির ব্যবহারিক জীবনেও তাই। প্রিয়জনের বিয়েতে সোনার গহনা উপহার দেওয়া নিয়ে কত আলোড়ন, সাংসারিক রঙ্গমঞ্চে কত কৌতুক-বিতণ্ডা। সেই নাটকে রুপো সাধারণত ব্রাত্য, কুশীলবগণ তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না। এ ভাবেই চলে আসছে বহু কাল ধরে, প্রথা ভাঙার রাস্তায় প্রায় কেউই হাঁটেন না। সেখানে আমাদের তাগিদ বা তাড়না, কিছুই নেই। সামাজিকতার দাসত্বই করি বা আনুষ্ঠানিক দায়-দায়িত্ব পালন, সোনাই শ্রেষ্ঠ। কেন, সেই প্রশ্নটি থেকেই যায়।
থেকে যায়, আর ঠেকেও যায় সোনার দামে, তার মূল্যর অস্বাভাবিকতায় ও আরও বৃদ্ধির প্রত্যাশায়। মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ার হিসাবে ‘হেজ এগেনস্ট ইনফ্লেশন’ নামক সনাতন অস্ত্ররূপে। বুদ্ধিমান লগ্নিকারী সোনাকে তাঁর সম্পদ বণ্টনের অন্যতম অনুষঙ্গ করে নেন। অবশ্য এ কালের বিনিয়োগ আর সোনার দোকানে গিয়ে হয় না, হোল্ডিং স্টেটমেন্ট তার ইলেকট্রনিক উপস্থিতি কেবল কয়েকটি সংখ্যা হিসাবে দেখায়। রিস্ক প্রোফাইলে বদল বা ঝুঁকির ধারণার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি বাড়ে-কমে মাত্র। ফান্ডের মাধ্যমে সোনা কেনা আজ খুব সহজ এক পদ্ধতি, আর সভারেন গোল্ড বন্ড ব্যাঙ্কেই নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী পাওয়া যায়। আর রুপোয় বিনিয়োগ? কমোডিটি এক্সচেঞ্জ আছে বটে, এবং সেখানে লেনদেনের নিয়ম-কানুনও অতীব স্পষ্ট, তবে আম আদমি সে দিকে চট করে পা বাড়ান না। সাধারণ বাঙালির রজতদর্শন হয় পণ্যশালায় উপহারসামগ্রী কেনার মুহূর্তে, বছরের দু’একটি বিশেষ সময়।
ভারতে রুপোর বাজার কিন্তু যথেষ্ট তাগড়া, আমরা ‘নেট আমদানিকারী’। রুপোর সমস্ত চাহিদা মেটানোর মতো উৎপাদন এ দেশে হয় না। নির্মাণশিল্পে ব্যবহার, ইলেকট্রনিক্স-সহ বিভিন্ন শিল্পের ক্ষেত্রে রুপোর প্রয়োগ, আমদানি হিসাবে একে আরও জেল্লা দিয়েছে। তবে ইদানীং সময়বিশেষে দেখা গিয়েছে যে, আমদানি কিঞ্চিৎ কমের দিকে— তা দেশের অভ্যন্তরীণ জোগান বেড়েছে বলেই।
আর এখানেই ঘুরেফিরে আসে আধুনিক যুগের, সদ্য-অনুমোদন পাওয়া সিলভার ফান্ডের কথা। এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড হলে তা অনায়াসে স্টক এক্সচেঞ্জে ব্রোকারের মাধ্যমে বেচাকেনা করা যাবে, আর পাঁচটা শেয়ারের মতো। সিলভার ফান্ডের হাত ধরেই হয়তো এ ক্ষেত্রে বৃহত্তর লগ্নি আসবে, মানুষের মনে উত্তরণ হবে এই ধাতুটির।
ইলেকট্রনিক্স পণ্যে বা সোলার প্যানেলে (যা অপ্রচলিত শক্তির বাজারে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক ক্ষেত্র হয়ে উঠবে অচিরেই) ব্যবহারের জন্যই কেবল নয়, যত দিন না ভাল লগ্নি হিসাবে (স্রেফ গয়না নয়) মর্যাদা পাচ্ছে, রুপোর অগ্রগতি অধরাই থেকে যাবে। গহনা শিল্প যা ভেবেছে এত দিন, লগ্নির বাজারও তা-ই ভাবতে চায়। যেখানে হালকা রুপোর গহনার চলন ভালই, সেখানে বিনিয়োগের পোর্টফোলিয়ো কেন বঞ্চিত? মনে রাখতে হবে যে, গহনা শিল্পের সঙ্গে বহু মানুষের রুটিরুজি জড়িত, তাই সে দিকটি মোটেও উপেক্ষা করার মতো নয়। তবে লগ্নি এলে সম্পদ সৃষ্টির সম্ভাবনাও ফেলনা নয়। আভরণ রূপে রুপোর অস্বীকৃতি নেই বটে, তবে লগ্নিতে অস্মিতার যে বিলক্ষণ অভাব, সে কথা আগেই বলেছি।
সে অভাব না মিটলে এই ধাতুর যথাযথ মূল্যায়ন হবে না। সাধারণ লগ্নিকারী, ব্যবসায়ী ও কারিগর, কেউই হয়তো পূর্ণ সন্তুষ্টি পাবেন না। এত বছর ধরে চলা একটি বাণিজ্য, একটি সুদীর্ঘ সাপ্লাই চেন ও সম্পদ-গঠনের সুযোগ, দুর্বল হয়েই থাকবে। ‘পুয়োর ম্যান’স গোল্ড’ হিসাবে রয়ে যাবে, তথাকথিত প্রেশাস মেটাল হওয়া সত্ত্বেও। শৃঙ্খলমুক্তির সুযোগ আজ এসেছে— এই বার কি রুপো গুরুত্ব পাবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy