পেট্রল, ডিজ়েল, রান্নার গ্যাস, এমনকি গরিবের কুপির কেরোসিন, কোনওটাতে ভর্তুকি ছাঁটতে দ্বিধা করেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ব্রেক কষলেন চাষির সারে। ডিএপি (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট) সারের দাম যাতে না বাড়ে, তার জন্য সরকারি ভর্তুকি দেড়গুণ বাড়িয়ে দিলেন সম্প্রতি। ফলে চাষি সারের (৫০ কেজি) বস্তা পাবেন ১২০০ টাকায়, যা কুড়ি বছর আগের দাম। সরকার গত বছর প্রতি বস্তায় পাঁচশো টাকা ভর্তুকি দিত, এ বছর থেকে ভর্তুকি দেবে ১২০০ টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে ইউরিয়া সার, যার দামে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দেয় সরকার। সারে মোট ভর্তুকির অঙ্ক এ বছর ১ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
রাজনীতির কারবারিরা বলবেন, এতে আর আশ্চর্য কী? বিজেপির এখন শিয়রে শমন, দুয়ারে আন্দোলন। আগামী বছর সাত রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, তার মধ্যে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ আর পঞ্জাব। কৃষি আইনের প্রত্যাহার চেয়ে চাষিরা ফুঁসছেন। এই সময়ে সারে ভর্তুকি ছাঁটা যেন গরম তেলে জলের ছিটে দেওয়া। তা ছাড়া, আমেরিকা ইউরোপের উন্নত দেশগুলোও চাষে বিপুল ভর্তুকি দেয়; বাজারের জোয়ার-ভাটায় হাত-পা বেঁধে চাষিকে ফেলে দেয়নি। ভারতই বা ফেলে দেবে কেন?
রাষ্ট্রের সহায়তা, রাজকোষের অর্থে চাষিরই অগ্রাধিকার, এ কথা হাজার বার সত্যি। তার পরেও নিন্দুকের প্রশ্নটা মনে রাখতে হবে— “পাখিটাকে দেখেছেন কি?” এই লক্ষ কোটি টাকার যাঁরা লক্ষ্য, সেই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরা তার কতটুকু পাচ্ছেন? সারের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা তীব্র। ইউরিয়া সারের ৯০০ টাকার বস্তা চাষি পান ২৬৮ টাকায়, কিন্তু তার ৪১ শতাংশ চাষের কাজেই লাগে না। তা নানা শিল্পে ব্যবহার হয়, পাচার হয় নেপাল, বাংলাদেশে। আরও ২৪ শতাংশ ব্যবহার করেন ধনী চাষিরা, যাঁরা স্বচ্ছন্দে বাজারের দামে সার কিনতে পারেন। সরকারি তথ্যও বলে যে, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের চাষিরাই সার বেশি ব্যবহার করেন। যাঁদের জন্য সারে ভর্তুকি, সেই ছোট চাষির কাছে তার অর্ধেকও পৌঁছয় না।
ছোট চাষিও অনেক সার নষ্ট করেন। খড়্গপুর আইআইটির কৃষি ও খাদ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ভবানীশঙ্কর দাসের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল পশ্চিমবঙ্গের ১১টি জেলা থেকে মাটির নমুনা পরীক্ষা করেন। তিনি বলছেন, চাষিরা যে পরিমাণ সার দিচ্ছেন, তার অর্ধেক দিলেই যথেষ্ট হত। কিন্তু যত সার তত ফসল, এই হল চাষির ধারণা। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পবিত্র মণি বলেন, “ইউরিয়া দিলেই গাছ গ্রহণ করতে পারবে না, যদি না মাটির ভিতরে উপকারী জীবাণু থাকে, যা ইউরিয়াকে ভেঙে গাছের উপযোগী করবে। মাটিতে যথেষ্ট জৈব পদার্থ (কার্বন) চাই। তাই রাসায়নিক সারের সঙ্গে জৈব সারও দিতে বলা হয় চাষের প্রশিক্ষণে। কিন্তু দিতে বললেই তো হল না, গোবর কোথায়?” গরুপালন কমেছে, সর্ষের বা অন্য তৈলবীজের খোল, কেঁচো সারও সুলভ নয়। অ্যাজ়োলার মতো জৈব সার জনপ্রিয় হয়নি।
বার বার সার দেওয়ার মজুর-খরচ কমাতে অনেক চাষি একেবারে বেশি করে সার দেন। তাতেও সার নষ্ট হয়। একশো কেজি ইউরিয়া দিলে মাটি হয়তো ৩৫ কেজি নিতে পারে। খেতে জল থাকলে তার সঙ্গে মিশে বেরিয়ে যায় ইউরিয়া, মাটি থেকে উবেও যায়। তাই এক বারে সব ইউরিয়া না দিয়ে কয়েক ধাপে দিতে বলা হয়। যেমন ধানের ক্ষেত্রে, বীজ বপনের সময়, পাশকাঠি ছাড়ার সময়, আর ফুল আসার সময়টাতে। কিন্তু এ সব নিয়ম মেনে চাষ করেন ক’জন চাষি? হুগলির সারের ডিলার সুনীল বেরার মতে, বড় জোর ১০ শতাংশ। “বেশি সার দেওয়ার প্রবণতা থেকেই যাচ্ছে।”
অতিরিক্ত সার দেওয়ার ফলে মাটি নষ্ট হয়, মানুষের স্বাস্থ্যের বিপদ আনে, আর খাবারের স্বাদেরও বারোটা বেজে যায়। পালং শাক মুখে দিয়ে মনে হয়, যেন সলিড জল চিবোচ্ছি। “দিশি মুরগি আর পোলট্রির মুরগির যা তফাত, বিনা-ইউরিয়ার আনাজ আর বাজারের আনাজেরও তাই,” বললেন শেফ অমিতাভ চক্রবর্তী।
সার চুরি, অপচয় কমাতে প্রস্তাব উঠেছে, সার কোম্পানিকে টাকা না দিয়ে, ভর্তুকি সরাসরি চাষির অ্যাকাউন্টে যাক। ‘পিএম কিসান’-এর টাকা চাষির কাছে পৌঁছতে পারলে, সারের ভর্তুকিই বা পৌঁছনো যাবে না কেন? পৌঁছনো যেত, কিন্তু ঘাটতি আস্থায়। ‘উজ্জ্বলা’ রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি, প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমার ক্ষতিপূরণের অঙ্ক দেখে মানুষ চটে আছে। ঠিক সময়ে ঠিক অঙ্কের টাকা ঢুকবে, সে ভরসা কই? ক্ষোভ আঁচ করেই হয়তো সংস্কার মুলতুবি রেখেছে কেন্দ্র। বরং, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন গত বছর সার কোম্পানিদের সব বকেয়া মিটিয়ে দিয়েছেন।
সরকার চাষিকে কী দেয়? দেখা যাচ্ছে, সর্বাধিক খরচ হয় চাষিকে তাঁর ফসলের সহায়ক মূল্য দিতে। নির্মলা সংসদে জানিয়েছেন যে, ২০২০-২১ সালে কেবল ধান, গম কিনতেই লেগেছে দু’লক্ষ কোটি টাকার বেশি। এর পরেই আসে সারে ভর্তুকি, ২০২১-২২ সালে যা এক লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তার পর কৃষক অনুদান— ৬৫ হাজার কোটি টাকা যাবে ‘পিএম কিসান’-এ, যা কৃষি মন্ত্রকের মোট বরাদ্দের অর্ধেক। পরের বড় খরচ ফসল ঋণে ভর্তুকি (১৯ হাজার কোটি টাকা), আর ফসল বিমার প্রিমিয়াম (১৬ হাজার কোটি টাকা)। এ শুধু কেন্দ্রের বরাদ্দ। সহায়ক মূল্য-অনুদান-ভর্তুকি বাবদ রাজ্যগুলোও অনেক টাকা খরচ করে।
এ দিকে সবার অলক্ষ্যে কমে আসছে চাষের উন্নতির জন্য খরচ। যেমন, টাকা কমেছে রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায়, যার অধীনে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, কীট নিয়ন্ত্রণ, দুধ ও মাছের উৎপাদনে বৃদ্ধি, আনাজ-ফুল-ফলের চাষে উন্নতি হওয়ার কথা। ২০১৪-১৫ সালে এ সব কাজে খরচ হয়েছিল আট হাজার কোটি টাকা, এ বছর বরাদ্দই তার অর্ধেক। ক্ষুদ্র সেচ, ফসল সংরক্ষণ, বাজার সংস্কার, হিমায়িত পরিবহণ— এ সবেও বরাদ্দ যৎসামান্য। ২০১৯ সালে কৃষি বিষয়ক সংসদীয় কমিটি লিখেছিল, অর্ধেকের বেশি মান্ডিতে ভাল ওজনযন্ত্র নেই। রাজ্যগুলোও একই পথে হাঁটছে। যেমন, গত বছর পশ্চিমবঙ্গ কেবল ফসল বিমার প্রিমিয়াম দিয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা, কিন্তু রাজ্যের ২৯০০ গ্রামীণ হাটের উন্নয়নে দিয়েছে মাত্র ৭৪ লক্ষ টাকা! মানে, হাট-পিছু বছরে আড়াই হাজার টাকা। উন্নয়নের টাকা অনুদানে খাচ্ছে।
চাষির রোজগার বাড়াতে হলে চাষিকে বাজারে ফসল বিক্রি করে লাভ করতে হবে। তার নীতি কোথায়? কৃষি উৎপাদন-বিপণনের পরিকাঠামো, চাষির প্রশিক্ষণ, ফসল সংরক্ষণে যথেষ্ট বিনিয়োগ না করে সরকার ক্রমাগত অনুদান, ভর্তুকি বাড়াচ্ছে। মাটির দফারফা হচ্ছে জেনেও ইউরিয়াতে রাশ টানছে না। জৈব সারে ভর্তুকি না দিয়ে রাসায়নিক সার সস্তা করছে। গরিব চাষিকে সামনে রেখে চুরি, পাচার, অপচয়ের চক্র চলতে দিচ্ছে।
নেতারা ‘চাষিকে টাকা দিয়েছি’ বলে বুক বাজান। বরাদ্দ একটা সিগন্যাল মাত্র। গাড়ি তার লক্ষ্যে না পৌঁছলে সিগন্যাল অর্থহীন, সরকার ব্যর্থ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy