Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
আজকের শাসকদের মন্ত্র হল ‘এক দেশ, এক সব কিছু’
Government

যুক্তরাষ্ট্র এখন অতীত

জিএসটি ব্যবস্থা চালু করার জন্য রাজ্যগুলি রাজস্ব আদায়ের কিছু ক্ষমতা ছেড়ে দেয়, দেশের অর্থনৈতিক সংহতির স্বার্থে। কিন্তু, জিএসটি কাউন্সিলে কেন্দ্রের হাতেই ভেটো ক্ষমতা রয়েছে।

—প্রতীকী ছবি।

প্রণব বর্ধন
শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:৩৪
Share: Save:

বহু বছর আগে ইতিহাসবিদ ডব্লিউ জে এফ জেনার-এর চিনের উপর লেখা দ্য টিরানি অব হিস্ট্রি: দ্য রুটস অব চায়না’জ় ক্রাইসিস বইটা পড়েছিলাম। তাতে তিনি লিখেছিলেন, চিনের সভ্যতার একটা মৌলিক চরিত্র হল, তারা মনে করে যে, ইউনিফর্মিটি বা এককত্ব বস্তুটি বিশেষ ভাবে কাম্য— দেশের থাকা দরকার একক সাম্রাজ্য, একটাই সংস্কৃতি, একটাই লিপি, একটাই ঐতিহ্য। আমার দৃঢ় ধারণা যে, ভারতীয় ও চৈনিক সভ্যতার মধ্যে ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের ফারাক এখানেই। ভারতে বহুত্ব বিপুল সমারোহে উদ্‌যাপিত হয়, তার ফলস্বরূপ যাবতীয় বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও। আরএসএস-বিজেপি নেতৃত্ব ভারতীয় সভ্যতার এই উত্তরাধিকারকেই অস্বীকার করে। তাদের মন্ত্র হল, ‘এক জাতি, এক সব কিছু’। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের উপর ভিত্তি করে তারা যে কেন্দ্রীভূত জাতি-রাষ্ট্র গঠন করতে চায়, সেই উদ্দেশ্যে তারা বহুবিধ অস্ত্র প্রয়োগ করছে। তার মধ্যে সাম্প্রতিকতমটি হল ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’-এর দাবি।

কিন্তু, এই কেন্দ্রীকরণের ফলে ভারতের মতো বিপুল ও গভীর বৈচিত্রময় দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ফাটল ধরছে, এবং দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের ঐক্যের ক্ষতি করবে। এমনিতেই দুনিয়ার বেশির ভাগ যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশের তুলনায় ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অধিকতর ‘ইউনিটারি’ বা ঐকিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মূলে রয়েছে দেশভাগের সময়কার বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির আশঙ্কা। আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার প্রশ্নে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের অভাব বহু কাল ধরে চলছে। এখন ভারতে মোট সরকারি খরচের ৬৪ শতাংশ করে রাজ্যগুলি, কিন্তু মাত্র ৩৮ শতাংশ রাজস্ব আদায় করে তারা, এবং তাদের ধার করার ক্ষমতাও কেন্দ্রের সম্মতির উপরে নির্ভরশীল।

১৯৮৯ থেকে ২০১৪, এই সিকি শতাব্দীতে দেশে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি তুলনায় শক্তিশালী ছিল, কেন্দ্রেও ছিল জোট সরকার। এই সময়ে ভারতের রাজনীতি এবং রাজস্ব ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজটি কিছু দূর অগ্রসর হয়েছিল, মূলত রাজনৈতিক দর-কষাকষির মাধ্যমে। কিন্তু এই সংশোধনের কাজটি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হয়নি। এখন সেই সংশোধিত ব্যবস্থার বেশির ভাগই বাতিল। কেন্দ্রে এখন এমন একটি দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, যাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর রয়েছে, এবং যারা অতি-কেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী।

গত এক দশকে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বিভিন্ন ভাবে ঘা খেয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দিই।

১) আঞ্চলিক মানুষের মতামতের তোয়াক্কা না করেই যে ভাবে যথেচ্ছ ভঙ্গিতে, এবং কেন্দ্রের একক সিদ্ধান্তে জম্মু ও কাশ্মীর নামক রাজ্যটিকে ভেঙে দেওয়া হল, এবং জবরদস্তি করে কেন্দ্রের শাসন চাপানো হল, বিশ্বের অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশে তা কল্পনারও অতীত।

২) অন্য রাজ্যেও কেন্দ্রের আধিপত্য প্রয়োগের উদাহরণ বিস্তর। অ-বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালরা চলিত প্রথা ভেঙে রাজ্যে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকারকে হেনস্থা করে চলেছে, সরকারের কাজে বিভিন্ন বাধার সৃষ্টি করছে। দিল্লি রাজ্যের ক্ষেত্রে আবার আইন করেই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রশ্নে নির্বাচিত সরকারের হাত থেকে কার্যত যাবতীয় ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হল।

৩) আগে যোজনা কমিশনের হাতে রাজ্যগুলির জন্য কিছু অর্থ মঞ্জুরির দায়িত্ব ছিল। সেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হত সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে। নরেন্দ্র মোদীর আমলে যোজনা কমিশনের অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে, তার সঙ্গে ঘুচে গিয়েছে রাজ্যগুলির আলোচনা করার অধিকারও। এখন ওই অর্থ মঞ্জুরির সিদ্ধান্ত একতরফা ভাবে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের হাতে। অর্থ কমিশনের কাজের বিচার্য বিষয়ের অভিমুখও ঘোরানো হয়েছে আরও বেশি কেন্দ্রীকরণের দিকে। এ ছাড়া বাজেটে সেস বা বাড়তি করের পরিমাণ— যার অংশ রাজ্যগুলিকে দেওয়ার দায় নেই— ক্রমশই বাড়ছে।

৪) জিএসটি ব্যবস্থা চালু করার জন্য রাজ্যগুলি রাজস্ব আদায়ের কিছু ক্ষমতা ছেড়ে দেয়, দেশের অর্থনৈতিক সংহতির স্বার্থে। কিন্তু, জিএসটি কাউন্সিলে কেন্দ্রের হাতেই ভেটো ক্ষমতা রয়েছে। রাজ্যগুলিকে প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রায়শই খুব দেরি হচ্ছে।

৫) বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প চালু করার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে, রাজ্য সরকারকে পাশ কাটিয়ে কেন্দ্রীয় আমলারা প্রায়শই জেলাস্তরের প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, সরাসরি কড়া নির্দেশ দিচ্ছেন। সংবিধানের রাজ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয়, যেমন আইনশৃঙ্খলা, কৃষি ও জনস্বাস্থ্যের মতো ক্ষেত্রেও প্রায়শই একতরফা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিরোধী দলের নেতাদের উপরে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে; সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ অথবা সরকারের বিরোধিতায় সরব নাগরিকদের উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে ইউএপিএ-র মতো বিতর্কিত স্বেচ্ছাচারী আইন; সংসদে বিন্দুমাত্র আলোচনা ব্যতিরেকেই কৃষি আইনের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ আইন চালু করে দেওয়া হয়েছিল; অতিমারির সময়ে কেন্দ্রীয় ডিজ়াস্টার ম্যানেজমেন্ট আইন প্রয়োগ করার সময় কোন রাজ্য কতখানি প্রস্তুত, বা কোন রাজ্যে অতিমারিতে আক্রান্তের সংখ্যা কত, এই প্রশ্নগুলি বিবেচনাই করা হয়নি। শিক্ষা বা শ্রমের মতো যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় আইন রূপায়ণ বা তা চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির সঙ্গে কার্যত কোনও আলোচনাই করা হয়নি।

৬) বহু ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় শাসনবিভাগ ও আইনবিভাগের যাবতীয় কাজ করা হচ্ছে দেশের সংবিধানসম্মত দু’টি সরকারি কাজের ভাষার মধ্যে কেবলমাত্র একটিতে— যে ভাষায় দেশের অধিকাংশ মানুষ কথা বলেন না।

এই বিষয়গুলি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা বোধে আঘাত করে চলেছে; কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নানাবিধ অসন্তোষ ও অবিশ্বাস। এমনকি, অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়া— যার মাধ্যমে দেশের মধ্যে একটি সংযুক্ত বাজার গড়ে তোলার ইতিবাচক কাজটি করা সম্ভব— তারও কিছু নেতিবাচক রাজনৈতিক ফল দেখা যাচ্ছে। যেমন, ভারতীয় রাজনীতিতে নাগরিকের অধিকারের যে ধারণাটি তৈরি হয়েছিল (যেমন, খাদ্যের অধিকার, কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার ইত্যাদি), সেই ধারণাকে মুছে দিয়ে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয়
কল্যাণ নীতিতে গরিবের প্রতি ‘প্রধানমন্ত্রীর উপহার’ হিসাবে প্রচার করে (বহু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছবিসমেত)— এবং, এই প্রকল্পগুলি পরিচালনার কাজ করে রাজ্য স্তরের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে।

১৯৮৯ থেকে ২০১৪ অবধি যে সিকি শতাব্দীর কথা উপরে উল্লেখ করেছিলাম, সে সময় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার চরিত্রটিও গভীর ভাবে আঞ্চলিক হয়ে উঠেছিল। রাজ্যস্তরে বিভিন্ন পুঁজিপতির
উত্থান ঘটেছিল, যাঁরা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এখন ছবিটি পাল্টে গিয়েছে। এখন অতি সীমিতসংখ্যক সর্বভারতীয় বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর রমরমা— বহু ক্ষেত্রেই যা সাঙাততন্ত্রের ফসল। শোনা যায়, এই গোষ্ঠীগুলিই নাকি কেন্দ্রের শাসক দলের প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক, অতি অস্বচ্ছ ইলেক্টরাল বন্ডের মাধ্যমে তারা শাসক দলকে টাকা জোগায়। এর ফলে ভারতে রাজনৈতিক পরিসরে প্রতিযোগিতা কমেছে, এবং অতি অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে উঠে এসেছে অর্থনীতির রাশ, যে অর্থনীতি আবার বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের জন্য প্রতিযোগিতা থেকে সুরক্ষিত করে দেওয়া হয়েছে।

আরএসএস-বিজেপি যে ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের আদলে ভারতকে গড়ে নিতে চায় (অতীতে আরএসএস-এর একাধিক তাত্ত্বিক নেতা জার্মান জাতি-রাষ্ট্রের প্রতি নিজেদের মুগ্ধতা সর্বসমক্ষেই প্রকাশ করতেন), ভারতের বহু গুরুত্বপূর্ণ সমাজচিন্তক তার সুতীব্র বিরোধিতা করেছেন। উদাহরণ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর কথা বলা যায়। তাঁরা বিভিন্ন লেখায়, ভাষণে বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, এক সম্প্রদায়, এক ধর্ম বা এক ভাষার ভিত্তিতে ইউরোপে যে জাতি-রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, তা ভারতের ক্ষেত্রে একেবারেই বেমানান ও ক্ষতিকর। ভারতের মানুষের মধ্যে বৈচিত্র বিপুল, এবং ভারতের সংস্কৃতির একেবারে গোড়ায় রয়েছে তার তৃণমূল স্তরের বহুত্ববাদী লোকসংস্কৃতি, পল্লিগীতি ও লোকাচারে যার প্রতিফলন পদে-পদে দেখা যায়। অনেক শতাব্দী ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই বহুত্ববাদী লোকসংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন ধরনের ভক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে— যে আন্দোলন তৈরি হয়েছিল আধিপত্যকামী ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির বিরোধিতায়, আরএসএস-এর আদর্শগত ভিত্তি যে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি। একটি সভ্যতার ঐতিহ্যকে এমনি এক ধাক্কায় বদলে ফেলা যায় না।

অন্য বিষয়গুলি:

Government Society Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy