Advertisement
E-Paper

নারীত্বের বহুমুখী সংজ্ঞা

পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, নারীত্বের সংজ্ঞা আজ বহুমুখী। লিঙ্গচিহ্ন আর লিঙ্গপরিচয় এক নয়। শারীরিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে এক জন মানুষের যৌনব্যক্তিত্ব বিচার করা যায় না।

ভাস্কর মজুমদার

শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৫ ০৭:০১
Share
Save

নারীদিবস কেবল নারীত্বের উদ্‌যাপন, বা উৎসবমাত্র নয়। নারীর শ্রমের অধিকার, শ্রমের ন্যায্য মূল্য, এগুলি লিঙ্গসমতা অর্জনের পথ দেখায়। একশো পনেরো বছর আগে পেত্রোগ্রাদের মেয়েরা সমানাধিকারের জন্য যে গণআন্দোলন শুরু করেছিলেন, এত বছরেও মেয়েদের তা মেলেনি। শুধু তা-ই নয়, কর্মক্ষেত্রে নারী আজও হেনস্থা, হিংসা, ভয় ও বৈষম্যের শিকার। পুরুষের সমান বেতন, মজুরি থেকে বঞ্চিত। চাষি-মেয়েদের জমির মালিকানা নেই। নেই কৃষকের মর্যাদা। মজুর-মেয়েরা পুরুষের সমান মজুরি পান না। প্রায় কোনও কর্মস্থলে ক্রেশ নেই। দেশের তথাকথিত উন্নত শহরেও নারীদের জন্য পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। মেয়ে-কর্মীদের যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ আর গার্হস্থ হিংসা ক্রমবর্ধমান। শ্রমজীবী নারীদিবস উপলক্ষে মেয়েদের জমায়েতের প্রয়োজন, অতএব, অপরিসীম।

পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, নারীত্বের সংজ্ঞা আজ বহুমুখী। লিঙ্গচিহ্ন আর লিঙ্গপরিচয় এক নয়। শারীরিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে এক জন মানুষের যৌনব্যক্তিত্ব বিচার করা যায় না। বহু মানুষ যেমন বাঁচেন তাঁর জন্মকালে-ন্যস্ত লিঙ্গচেতনা নিয়ে, তেমনই কোনও কোনও মানুষ নিজের লিঙ্গপরিচয় গড়ে তুলতে পারেন নিজস্ব যৌনচাহিদা অনুযায়ী। শিশ্ন, যোনি, স্তন এমনকি ক্রোমোজ়োম দিয়ে পুরুষ আর নারী পরিচয়ে ভাগ করে দেওয়া যাবে সব মানুষকে, সাদা-কালো ভাগের মতো, এমন কোনও কথা নেই। বুঝতে হবে রূপান্তরকামিতাকে। নারী মানেই তাঁর বিশিষ্ট লিঙ্গচিহ্ন থাকতে হবে, তা নয়। সম্পূর্ণ বিপরীত লিঙ্গচিহ্ন নিয়েও এক জন মানুষ নারী হয়ে উঠতে পারেন। শল্যচিকিৎসার সাহায্য গ্রহণ করুন বা না করুন এক জন রূপান্তরকামী-নারী আসলে নারীই। তাই নারীদিবসের উদ্‌যাপনে রূপান্তরকামী-নারীর অংশগ্রহণ ন্যায্য।

আজ কলকাতা-সহ নানা ছোট-বড় শহরে রূপান্তকামী নারীরাও নারীদিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু সব সময়ে তা ছিল না। বিশ্বের নানা প্রান্তে নারীবাদের অলিন্দে একদা রূপান্তরকামী-বিদ্বেষ ছিল। অনেকেরই ধারণা ছিল নারী হতে চাওয়া পুরুষ আসলে ‘নারী সেজে থাকা পুরুষ’। সমাজ-রাষ্ট্রে পুরুষ হওয়ার সুবিধা নিয়েও তিনি নারী হতে চান। আদপে সত্যি নয় এই ধারণা। নারী হতে চাওয়ার কারণে বহু রূপান্তরকামী পরিবারচ্যুত হন, প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারেন না। চাকরির বাজারে তাঁর নিয়োগযোগ্যতা তলানিতে ঠেকে। অর্থনৈতিক ভাবে প্রান্তিক হয়ে উঠতে বাধ্য হন তিনি। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারীর যদি কিছু সামাজিক সুবিধা থেকেও থাকে, সে সব থেকে বঞ্চিত হন। অপমান, হিংসা-হেনস্থা, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির মধ্যে দিয়ে তাঁকে যেতে হয় নারী হয়ে উঠতে চাওয়ার জন্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-রাষ্ট্রে নারী যদি কোণঠাসা হয়ে থাকেন, তবে নারীতে রূপান্তরিত হতে চাওয়া মানুষদের অবস্থান আরও ভয়াবহ।

শ্রম ও রোজগারের প্রশ্নে নারী বা পুরুষদের চাইতে রূপান্তরকামীরা কোনও অংশে কম নন। কিন্তু সমীক্ষা বলছে সামাজিক বিদ্বেষের জন্য নারীতে রূপান্তরিত হতে চাওয়া মানুষেরা মারাত্মক অত্যাচারিত, এবং অনেক বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ। ভারতীয় সমাজে রূপান্তরকামী-নারীর অবস্থান খানিক ঘোলাটে। হিজড়া পেশার মানুষেরা যে-হেতু নারীতে রূপান্তরিত হতে চান, এবং উপমহাদেশে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক পরিচয়ে হিজড়ারা জারিত, তাই রূপান্তরকামী সব নারীকেই হিজড়া ভাবার প্রবণতা কাজ করে। সেটা অপরিচয়ের জন্যও হতে পারে। কিন্তু দেখা যায়, সরকার ও সমাজ ধরে নেয় যে রূপান্তরকামীরা হিজড়া পেশার মানুষদের গতানুগতিক কাজ করবেন। এতে তাঁদের নিয়োগের ক্ষেত্র অনেক সঙ্কীর্ণ রয়ে যায়। যে রূপান্তরকামীরা সমাজের বেঁধে-দেওয়া সীমাকে অগ্রাহ্য করে নানা ধরনের পেশায় প্রবেশ করেন, তাঁদের মুখোমুখি হতে হয় নানা ধরনের হেনস্থা, হয়রানির।

শ্রমের প্রশ্নে, সংরক্ষণের প্রশ্নে, সরকার ও সমাজ নারী হতে চাওয়া মানুষদের তাঁদের প্রার্থিত সম্মান, অর্থাৎ নারীর সমান সম্মান দেবে, এটাই প্রত্যাশিত। যেমন, সংসদে নারীদের যদি সংরক্ষণ দেওয়া হয়, তাতে নারীতে রূপান্তরিত হতে চাওয়া মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করেই ভাবা হচ্ছে তো? মেয়েদের শৌচাগারের যে দাবি, সেখানে রূপান্তরকামীদের জন্য লিঙ্গ-নিরপেক্ষ টয়লেটের ভাবনা ক‘জনের মাথায় আসছে? শ্লীলতাহানির, হেনস্থা-হিংসা, ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে সব আইনে ভারতীয় নারী নাগরিক সুরক্ষা পেতে পারেন তাতে রূপান্তরকামী-নারীও উপকৃত হবেন তো? মেয়েদের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যত আর্থিক প্রকল্প, সেগুলির উপভোক্তা রূপান্তরকামী বা রূপান্তরিত নারীদের কত জন?

ক্রীড়াক্ষেত্রের প্রসঙ্গটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্ব জুড়েই মেয়েদের খেলাধুলা থেকে রূপান্তরকামী-নারীদের ব্রাত্য করার এক দুঃখজনক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। আমরা ক‘জন তা নিয়ে ভাবি? আন্তর্জাতিক নারীদিবস রূপান্তরকামী-নারীদের অন্তর্ভুক্তি, তাঁদের প্রাত্যহিক সংগ্রামের স্বীকৃতি, লিঙ্গসমতার লড়াইয়ে তাঁদের স্থান নিশ্চিত করারও একটি দিন। নারীদিবসে নারীতে রূপান্তরিত হতে চাওয়া মানুষদের সামাজিক-রাজনৈতিক দাবিগুলি যেন বাদ না পড়ে যায়।

আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে, জমায়েতে রূপান্তরকামীরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ দিয়েছে। দিনের পর দিন রাস্তায় থেকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের এক বিশিষ্ট ভাষ্য তৈরি করেছে। রূপান্তরকামীদের উপর সমাজ-রাষ্ট্রের যে-কোনও অত্যাচারের ঘটনায় সব মেয়ের এগিয়ে আসাও জরুরি। রূপান্তরকামী-নারীদের সামাজিক বর্জন, শিক্ষার অভাব, কর্মসংস্থানের সঙ্কট, অপ্রতুল স্বাস্থ্য পরিষেবার বিষয়ে সুসংহত প্রতিবাদ দরকার। নারীবাদ বলে, কেউই মুক্ত নন, যত ক্ষণ না সবাই মুক্ত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Women Empowerment Domestic Violence Crime Against Women

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}