সারা বিশ্বেই অতিমারিতে স্কুলশিক্ষার প্রশ্নটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। উত্তর খুঁজতে নানা দেশে বেশ কিছু সমীক্ষা চলছিল, যার ফল এ বারে হাতে আসতে শুরু করেছে। সে ফল আশা জাগায় না। জ়ুমের মতো অ্যাপ-এর সাহায্যে অনলাইন ভিডিয়ো কনফারেন্স-এর ধাঁচে স্কুলের ক্লাস, কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ-এর মতো মেসেজিং অ্যাপ-এর মাধ্যমে পাঠদান বিপুল ভাবে ব্যর্থ হয়েছে ভারত-সহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। ছেলেমেয়েরা যা শিখেছিল তা-ও ভুলে যাচ্ছে। ফোন বা ট্যাবলেটের অভাবে, কিংবা ডেটাপ্যাক কিনতে না পারায় অনলাইন ক্লাসের নাগালই পাচ্ছে না দরিদ্র, নিম্নবর্ণ পড়ুয়াদের এক বড় অংশ, বিশেষ করে ছাত্রীরা। অনেক সরকার অ্যান্ড্রয়েড ফোন বা ট্যাবলেট দিচ্ছে দরিদ্র শিশুদের। কিন্তু পরিকাঠামোর গলদের জন্য তাতেও ডিজিটাল বৈষম্য কমছে না। অন্য দিকে, অতিমারির গোড়ায় যে শিক্ষা-প্রযুক্তি সংস্থা পড়াশোনার জন্য বিনা পয়সায় প্ল্যাটফর্ম, বা পাঠ্যবস্তু দিয়েছিল, তারা আবার ফিরে গিয়েছে ফি-ভিত্তিক মডেলে। অনলাইন শিক্ষা চালানোর টাকা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে বহু পরিবার, স্কুল।
তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, ডিজিটাল মাধ্যমে স্কুলশিক্ষার উন্নতির কোনও সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু সুফল পেতে কী শর্ত পূরণ করতে হবে, বোঝা দরকার। নিম্ন ও মাঝারি আয়ের দেশগুলিতে সমীক্ষা বলছে, ক্লাসঘরের শিক্ষার পাশাপাশি পড়াশোনা শেখার জন্য তৈরি সফটওয়্যার (কম্পিউটার অ্যাসিসটেড লার্নিং) ব্যবহার করলে ছেলেমেয়েরা ভাল করছে। অঙ্ক বেশি রপ্ত হচ্ছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারেও স্বচ্ছন্দ হচ্ছে। একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ডিজিটাল মাধ্যমের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুফল হাই স্কুলে কিংবা কলেজ শিক্ষায় মিলছে বেশি।
ডিজিটাল শিক্ষার প্রসঙ্গ টেনে আনে গোড়ার কথা, রাজনৈতিক মতাদর্শের। সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সকলের কাছে শিক্ষাকে পৌঁছে দেওয়া। তাঁরা শিক্ষাকে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার, বৈষম্যমুক্তির পথ হিসাবে দেখেন। শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংযোগকে তাঁরা শিক্ষার কেন্দ্রে রাখেন, বাণিজ্যিক লেনদেনের অংশ হিসাবে তাকে দেখতে চান না। তাঁদের কাছে তাই ডিজিটাল শিক্ষাকে, তার বর্তমান চেহারায়, গ্রহণ করা কঠিন। ও দিকে নব্য উদারবাদ, যা এখন দেশের নীতি নির্ধারণ করছে, শিক্ষাকে দেখে প্রধানত দক্ষ শ্রমিক তৈরির উপায় হিসাবে। কম খরচে দ্রুত দক্ষ করে তুলতে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে তাঁরাই বেশি আগ্রহী। তাই তাঁরাই ডিজিটাল শিক্ষার প্রধান সমর্থক। এই দু’পক্ষ যে একে অপরকে একেবারে খারিজ করে দেন, এমন নয়। তবে নীতিগত বিতর্কে, যেমন প্রযুক্তি বনাম সাম্যবোধ সংঘাতে, তাঁরা একটা পক্ষ বেছে নেন। তাই ডিজিটাল শিক্ষা নিয়ে উৎসাহ আর অস্বস্তি, দুটোর মধ্যে টানাপড়েনে আটকে গিয়েছে অতিমারি কালের শিক্ষাব্যবস্থা।
কী করে এগোনো সম্ভব? এই মুহূর্তের পরিকাঠামোর অসাম্যের মাঝে শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি আবার অনলাইন হওয়া মানেই বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাবঞ্চনা। কিন্তু এও সত্যি যে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের সক্ষমতা সব শিশুর কাছে পৌঁছনো চাই। বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে নেট পরিষেবার প্রসার দরকার। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, স্কুলের কম্পিউটার ল্যাব বা পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে ডিজিটাল সংযোগ বাড়ানো ভাল। পরিবার অনেক সময় বৈষম্য করে থাকে: মেয়েদের হাতে ফোন দিতে চান না অনেক বাবা-মা।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নাগাল পাওয়া যেন সহজ হয়, বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় যেন তা কাজে লাগানো যায়, পাঠ্যবস্তু যেন শিক্ষার্থীদের বয়স, দক্ষতার উপযোগী হয়, কম দামি ট্যাব বা ফোনেও যাতে তা কাজ করে। অর্থাৎ, ডিজিটাল দক্ষতা আয়ত্তের দায়টা কেবল পড়ুয়ার নয়। বাণিজ্যিকীকরণ আটকাতে, সাম্য গড়ে তুলতে রাষ্ট্র ওপেন সোর্স সফটওয়্যার নির্মাণ করতে পারে, যা প্ল্যাটফর্ম এবং পাঠ্যবস্তু দুয়েরই জোগান দেবে, শিশু সুরক্ষা এবং ডেটা প্রাইভেসি আইন মেনে। শেষ বিচারে রাষ্ট্রের কর্তব্য, যথেষ্ট বিনিয়োগ। কতটা আর্থিক বরাদ্দ দাবি করতে পারে ডিজিটাল শিক্ষা, তা জনপরিসরে বিতর্কের মাধ্যমে স্থির করতে হবে।
ডিজিটাল শিক্ষার প্রসারের চেষ্টার পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের সশরীরে স্কুলে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন শেষ হয়নি। কিছু দিন আগেই ছত্তীসগঢ়ের কিছু উচ্চবর্ণের ছাত্রছাত্রী নিম্নবর্ণের রন্ধনকর্মীর তৈরি খাবার প্রত্যাখ্যান করেছে।
যে যার ঘরে পড়াশোনা করলে সমাজের এই বিকৃতি ধরা পড়ত না, তার প্রতিকারের সুযোগও আমরা পেতাম না। ডিজিটাল মাধ্যমে পড়াশোনা করে যদিও বা পরীক্ষায় ভাল নম্বর ওঠে, সেই নম্বর শিশুদের মেধা বা শিক্ষার একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy