পাঁচ-ছয় দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মানুষের কাছে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একটি ধূসর নামফলক, তাও কিছুটা তাঁর পিতা ‘বাংলার বাঘ’ স্যর আশুতোষের সৌজন্যে। একেবারে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই কলকাতা মহানগরের একটি প্রধান রাজপথ এস পি মুখার্জি রোড ঠিক কার
নামে, তা বলতে পারবে না। বাংলার ইতিহাসে শ্যামাপ্রসাদ অস্পৃশ্য।
অথচ, গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শুরু থেকে পঞ্চাশের দশকের প্রথম কয়েকটি বছরে— যুক্ত বঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দশকে— শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক চরিত্র। ১৯৩২ সালের ব্রিটিশ সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের অঙ্গীভূত হল, বাংলার নির্বাচনে তার প্রয়োগ হতে চলল। বাংলার ৪৫ শতাংশ হিন্দুর জন্য (তফসিলি-সহ) বরাদ্দ হল ৩২ শতাংশ— ৮০টি মাত্র আসন, ২৫০ আসনের আইনসভায়। প্রতিবাদে সরব হল বাঙালি হিন্দু সমাজ। ১৯৩৬-এর ১৪ জুলাই টাউন হলে বিশাল সভায় সভাপতিত্ব করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আহ্বায়কদের মধ্যে ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সরলা দেবী, নীলরতন সরকার প্রমুখ। অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, “বহুকাল পর আজ আমি রাজনৈতিক সভায় যোগদান করিলাম। প্রথমে এই সভায় যোগ দিতে আমি ইতস্ততঃ করিয়াছিলাম; কিন্তু স্বদেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া আমি আপনাদের আহ্বান উপেক্ষা করিতে পারিলাম না...।” ১৯৩৭-এর নির্বাচনে এই সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার আসন ভাগাভাগিতে এবং সর্বভারতীয় কংগ্রেসি নেতাদের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে বাংলায় শাসন ক্ষমতায় আসে মুসলিম লীগের সরকার।
১৯৩৫-এর সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা অসুস্থ অরাজনৈতিক রবীন্দ্রনাথকে রাজনৈতিক সভায় উপস্থিত হতে যেমন বাধ্য করেছিল, তেমনই এর ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি বাধ্য করল বাংলার আর এক বিখ্যাত অরাজনৈতিক পরিবারের অরাজনৈতিক কৃতী ব্যক্তিকে ক্রমশ রাজনৈতিক মঞ্চে ভূমিকা পালনে। শ্যামাপ্রসাদ ১৯২৯-৩০’এ কংগ্রেস বা নির্দল প্রার্থী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে বঙ্গীয় আইনসভায় নির্বাচিত হন, কিন্তু তখনও রাজনৈতিক ভূমিকায় আসেননি। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮— চার বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সময়ই বুঝতে পারছিলেন, সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার ছায়া পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনেও। সুতরাং, তাঁকেও রাজনীতির মঞ্চে নামতে হল। ১৯৩৭ সালে আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত নির্দল সদস্য হলেন বঙ্গীয় আইনসভায় এবং বছর কয়েকের মধ্যেই তিনি বাংলার অন্যতম প্রধান বাঙালি রাজনৈতিক নেতা।
বছর তিনেক ধরে চলা মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক শাসনের ছেদ ঘটালেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তখন তিনি হিন্দু মহাসভার কার্যনির্বাহী সভাপতি। বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও কৃষক প্রজা পার্টির নেতা ফজলুল হক ১৯৪১-এর শেষে মুসলিম লীগ ছেড়ে নতুন মন্ত্রিসভা গড়লেন শ্যামাপ্রসাদ ও কংগ্রেসের একাংশের সাহায্যে। ১৯৪২-এর মাঝামাঝি ব্রিটিশ প্রশাসনের অসহযোগিতা ও মুসলিম লীগ তোষণের কারণে শ্যামাপ্রসাদ পদত্যাগ করলেন। ১৯৪৬-এর কলকাতার ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নোয়াখালির গণহত্যা অখণ্ড ভারতের প্রচারক শ্যামাপ্রসাদকে বাধ্য করল বাঙালি হিন্দুর নিরাপদ বাসস্থান পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টির কথা ভাবতে। পুরো বাংলাটাই পাকিস্তানে যাওয়া ঠেকাতে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, দুই বাংলার হিন্দু ও মুসলমান জন-বিনিময়ের কথা। স্বাধীনতার প্রাক্কালে তৈরি গণ পরিষদে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিনি মনোনীত সদস্য ছিলেন। ১৫ অগস্ট ১৯৪৭-এর প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী। কেন্দ্রে গিয়েও তিনি পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমস্যার কথা ভোলেননি। লোকসভায় এই প্রসঙ্গ বারংবার তুলে এনেছেন। ১৯৫০-এর পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার হিন্দু শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে আসতে শুরু করেন। এই সময় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খানের সঙ্গে কুখ্যাত ‘নেহরু লিয়াকত’ চুক্তি করলেন। এই চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দুরা ফিরে যাবেন এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে যাওয়া মুসলমানরা ফিরে আসবেন। নেহরুর মন্ত্রিসভায় তখন দু’জন বাঙালি মন্ত্রী— শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং কংগ্রেসের ক্ষিতীশচন্দ্র নিয়োগী। এই চুক্তির বিরোধিতায় দু’জনেই পদত্যাগ করলেন, তাঁরা নিশ্চিত জানতেন যে হিন্দুরা আসতেই থাকবেন, কেউ ফিরে যাবেন না। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তাঁরা নির্ভুল ছিলেন। ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনে দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট প্রার্থীদের বিপুল ভোটে পরাজিত করে আবার লোকসভায় নির্বাচিত হলেন শ্যামাপ্রসাদ। তার পর ১৯৫৩-র ২৩ জুন রহস্যময় ভাবে কাশ্মীরে বন্দি অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলেন।
এই শ্যামাপ্রসাদ তার পর দ্রুত বাংলার ইতিহাস রাজনীতির চর্চা থেকে নির্বাসিত হয়ে গেলেন। অবশ্যই এই কাজটি গত পাঁচ দশক ধরে সফল ভাবে সম্পন্ন করেছেন বামপন্থী ও সেকুলার ইতিহাসবিদ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সাহিত্যিকরা। কিন্তু কেন? হিন্দুর অনেক কিছুই তো বাঙালি সেকুলারেরা আত্মস্থ করেছে। বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম, কেউ অস্পৃশ্য নয়, বাম জমানাতেই লোকনাথ অনুকূল মতুয়া ভক্তদের বিরাট প্রসার। তবে শ্যামাপ্রসাদে কেন এত আপত্তি? তিনি যদি স্রেফ এক জন হিন্দু ধর্মীয় নেতা হতেন তা হলে সমস্যা হত না। কিন্তু তিনি ছিলেন এক জন রাজনৈতিক হিন্দু। তাঁর চিন্তা ছিল বাঙালি হিন্দুর ভবিষ্যৎ নিয়ে। রাজনীতিক, সাংসদ বা হিন্দু মহাসভার নেতা হিসেবে তাঁর বক্তব্যের মূল ধারাটিই ছিল হিন্দুদের রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়, যা ভারতীয় সংস্কৃতির অস্তিত্ব ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারে। এটাই তাঁকে নিয়ে আপত্তির মূল কারণ।
গত কয়েক বছরে রাজনৈতিক হিন্দু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আবার পশ্চিমবঙ্গে ফিরেছেন। এই রাজনৈতিক হিন্দুকেই ভয় বাম সেকুলারদের। এই রাজনৈতিক হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী ঠিকানা ফিরে পাবেন, না আবার চলে যাবেন বিস্মৃতির ধূসরতায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy