আমৃত্যু কারাবাস, না কি ফাঁসি, এ বার সেই বিতর্ক আলোড়ন তুলেছে। আর জি কর কাণ্ডের নাগরিক প্রতিবাদ আগাগোড়া ছিল ঐক্যবদ্ধ। দোষীর কঠোরতম শাস্তির দাবি ছিল সর্বজনীন। দেখা যাচ্ছে, শিয়ালদহ কোর্ট মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাদণ্ডের সাজা শোনানোর পরে সমাজ বিভক্ত। যাঁরা এতে খুশি নন, অর্থাৎ যাঁরা ‘ফাঁসিবাদী’, তাঁদের সংখ্যাও কম নয়।
আদালত যখন কোনও রায় দেয়, তার পিছনে আইনের অজস্র খুঁটিনাটি বিবেচনা থাকে। ‘ন্যায়’-এর দাঁড়িপাল্লায় এক চুল এ দিক-ও দিক বিচারদাতার সিদ্ধান্তে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। পাশাপাশি, বিচারদাতার প্রজ্ঞা (উইজ়ডম) হল রায়দানের আর একটি ‘দার্শনিক’ ভিত্তি, যার সংজ্ঞা দেওয়া হয়তো খুব সহজ নয়। সর্বোপরি ‘বেনিফিট অব ডাউট’-এর সুবাদেও বহু ক্ষেত্রে অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ার বা কম শাস্তির নজির বিস্তর। এটাও জানা, নিম্ন আদালতের কোনও রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে গেলে সেখানে পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত আগের রায়কে পূর্ণ মান্যতা দিতেই হয়।
আর জি কর-মামলায় শিয়ালদহ কোর্টের বিচারক অনির্বাণ দাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য ও সিবিআই আলাদা ভাবে হাই কোর্টে গিয়েছে। তার মধ্যে না গিয়ে বলি, বাইরে এক দল যেমন বিচারকের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করছেন, তেমনই আর এক দলকে বলতে শুনছি যে, ওই রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলার অনেক জায়গা আছে। কোর্ট ঘটনাটিকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলেনি কেন, সেই চর্চাও জোরালো। এখানেই, মনে হয়, বিচারকের প্রজ্ঞার বিষয়টি ধর্তব্য। আইনে অজ্ঞ বলে সেই সব প্রসঙ্গে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখাব না।
কিন্তু অনধিক পৌনে দু’শো পাতার রায়ে অন্য যে পরিসরগুলি উন্মোচিত হয়েছে, সাক্ষীদের বক্তব্য, জেরা এবং আদালতে পেশ হওয়া বিভিন্ন নথিপত্রের ভিত্তিতে বিচার করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারকের পর্যবেক্ষণে আরও যা যা ধরা পড়েছে, সেগুলি বেবাক এড়িয়ে গেলে চলবে না। বস্তুত সঞ্জয়ের সাজার মাত্রা নিয়ে বিতর্কের সমান্তরালে বিচারকের অন্য পর্যবেক্ষণগুলি খুব অর্থবহ। কারণ তার পরতে পরতে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আইনরক্ষক ও তদন্তকারীদের তরফে চরম গাফিলতি, নিয়ম-পদ্ধতি লঙ্ঘন, অন্যায়ের সঙ্গে কার্যত আপসের মতো একাধিক বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়। রাজ্য এবং সিবিআই কারও পক্ষেই সেই সব দায় তুড়ি মেরে ঝেড়ে ফেলা কঠিন। সাক্ষীদের একাংশের বয়ান এবং পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়ে আরও বিশদ জেরার সুযোগ ছিল বলেও আদালতের মনে হয়েছে। যেখানে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সিবিআই-এর ভূমিকা আরও বেশি করে প্রশ্নের মুখে পড়ে।
এটা বুঝতে হবে, এই ধরনের কোনও মামলায় এমন সব কীর্তি হলে তার পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য। এমনকি তাতে আইনের ফাঁক গলে ‘প্রকৃত’ দোষীর ‘উপযুক্ত’ শাস্তি না হওয়াও বিচিত্র নয়। উল্লেখ্য, রায় দিতে গিয়ে বিচারক নিজেই জানিয়েছেন, সকল পক্ষের সাক্ষীসাবুদ, জেরা এবং আদালতে পেশ হওয়া নথিপত্রের ভিত্তিতেই তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
ফাঁসি বনাম আমৃত্যু কারাদণ্ডের বিতর্ক বাদ রেখেও তাই বলা যায়, মাননীয় বিচারক অনির্বাণবাবু এই রায়ের ভিতর দিয়ে অন্য কোনও ‘মাছের চোখ’-ও নির্দিষ্ট করে দিতে চেয়েছেন। হতে পারে, সেই মাছ আদতে গভীর জলের কোনও ‘রাঘব বোয়াল’। সংখ্যা এক বা একাধিক জানা নেই। তবে প্রভাবশালী, তাতে সন্দেহ কী!
সবাই জানেন, ৯ অগস্ট ঘটনার পর থেকেই পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের ভূমিকার বিরুদ্ধে এমন কিছু গুরুতর প্রশ্ন উঠেছিল, যা সত্যি হলে নিশ্চিত শাস্তিযোগ্য। উদ্বেগের বিষয়, জেরা ও নথিপত্র খতিয়ে অনেক গরমিলের কথা নিম্ন আদালত রায়ের পাতায় পাতায় বিবরণ-সহ লিখে দিয়েছে। কেউ সেই সব তথ্য এখনও পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করেনি।
ঘটনার ডায়েরি লেখায় অহেতুক বিলম্ব ও কারসাজি, স্থানীয় পুলিশের অসততা, ধর্ষণজনিত খুনের ঘটনাস্থল বলে চিহ্নিত করে দেওয়া স্থানটিকে নিয়ম অনুযায়ী ‘সংরক্ষিত’ না রাখা, শরীরের নমুনা সংগ্রহে যথাযথ নিয়ম না মানা, ময়না তদন্তের প্রক্রিয়ায় গুচ্ছ গুচ্ছ খামতি থেকে শুরু করে আদালতে জেরায় বিভিন্ন জরুরি প্রসঙ্গ কার্যত এড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত অনেক বিষয়ই রায়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
রায়ের অংশবিশেষ পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়, মেয়েটির মৃত্যুর ঘটনা ‘জানাজানি’ হওয়ার পর থেকে পুলিশ যেমন কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন করেনি, তদন্তভার হাতে নিয়ে সিবিআই-ও তেমনই বহু ফাঁকফোকর রেখে কাজ সেরেছে! এই সূত্রেই রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে স্থানীয় টালা থানার তৎকালীন একাধিক দায়িত্বশীলের নাম। এত দিনেও তাঁদের কেউ কোনও আতশকাচের তলায় এসেছেন বলে জানা নেই। কী বা রাজ্য, কী বা সিবিআই— কারও কোনও মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বিচারক অবশ্য পুলিশকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
নেপথ্যে যা-ই থাক, নিম্ন আদালতের ওই পর্যবেক্ষণের পরেও তার ভিত্তিতে উপযুক্ত তদন্ত ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ করা না হলে ‘সুবিচার’ সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। বুঝতে হবে, ঘটনার উৎস এবং বিবিধ সূত্রের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে হাসপাতাল ও থানার এক্তিয়ার। তাই মূল ঘটনা এবং তাকে ঘিরে ওই দুই তল্লাটে পর পর আরও যা যা হয়েছে, তার কোনও কিছুকেই লঘু করে দেখা ঠিক হবে না। সঞ্জয়ের শাস্তি যেমন কাম্য, তেমনই জরুরি তদন্তের মাধ্যমে উৎসমুখে পৌঁছনো।
প্রসঙ্গত স্মরণে থাক, ঘটনার সময় আর জি কর-এর তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের সন্দেহজনক ও নিন্দনীয় নানা পদক্ষেপ প্রকাশ্যে আসে। সিবিআই তদন্তে নেমে তাঁকে গ্রেফতারও করে। কিন্তু তিন মাসেও তারা চার্জশিট দেয়নি। তাই তাঁর জামিন হয়েছে এবং খোদ সিবিআই তাতে কোনও আপত্তি করেনি। যদিও আর্থিক দুর্নীতির অপর মামলায় তিনি জেলেই আছেন। সেটা আলাদা।
একই ভাবে মূল ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশের ভূমিকা আজ আদালতের পর্যবেক্ষণে। অবশ্য আগেই জামিন পেয়ে জেল-মুক্ত হয়েছেন স্থানীয় টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলও। সিবিআই তাঁর বেলাতেও আদালতে জানিয়েছিল, কিছু বলার নেই! ওঁদের বিরুদ্ধে সিবিআই তিন মাসেও চার্জশিট দিতে পারেনি, না কি ‘দেয়নি’, সেই রহস্য এখনও অনাবৃত।
তা হলে আজ পর্যন্ত তদন্তের সারাৎসার হল, শুধু সঞ্জয় রায়ের শাস্তি। ঘটনার পরেই কলকাতা পুলিশের হাতে সে গ্রেফতার হয়েছিল। পরে সিবিআই তদন্তেও সঞ্জয়ই ‘একমাত্র দোষী’ সাব্যস্ত হয়। এতে বাংলার শাসকবর্গ ‘কৃতিত্ব’-এর দাবি করতেই পারেন! বস্তুত এখানকার পুলিশ যে দ্রুত ও ‘সঠিক’ তদন্তে সিবিআই-কে গো-হারা হারাতে সক্ষম, সেই প্রচার রুখবে কে?
তার উপর রাজ্যের পুলিশ সম্প্রতি তিন জেলায় তিনটি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার তদন্ত দু’মাসের মধ্যে শেষ করেছে এবং প্রতিটিতে নিম্ন আদালত দোষীদের ফাঁসির সাজাও শুনিয়েছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাই বলতে পেরেছেন, এখানকার পুলিশের থেকে তদন্তের ভার সরে না গেলে সঞ্জয়ের ফাঁসি-ই হত!
এই রকম বক্তব্যের আইনগত যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। কারণ রাজনীতিতে ‘গ্যালারি-প্লেয়িং’এর বিশেষ মূল্য আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোঝেন, নিম্ন আদালতের রায় তাঁর পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে অধিক স্বস্তিজনক এবং বিজেপির পক্ষে বিড়ম্বনার। সঞ্জয় চরম দণ্ড পেয়ে গেলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রচারের ধার কমত। বিজেপি-শিবিরেও এই নিয়ে গুঞ্জন আছে।
সঞ্জয়ের ফাঁসির দাবি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশেও মমতার সচেতন বার্তা। তবে শিয়ালদহ কোর্টের অন্য পর্যবেক্ষণগুলি নিয়ে ভাবারও এখনই সময়। সেই বল এখন রাজ্যের কোর্টে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy