Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
বেহাল প্রাথমিক শিক্ষার হাল আমরা ফেরাতেই পারি, যদি চাই
Primary Education

আবাদ করলে ফলবে সোনা

সমাজের মাথাব্যথা নেই বলেই রাজনীতিক এবং শাসক-প্রশাসকদের উপরেও কোনও চাপ নেই, শিক্ষার এই ভয়াবহ অবস্থার প্রতিকারে কুটোটি না নেড়েও তাঁরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৩ ০৭:২৮
Share: Save:

বছর দুয়েক আগে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল একটি সমীক্ষার রিপোর্ট: লার্নিং টুগেদার: দি অপারচুনিটিজ় টু অ্যাচিভ ইউনিভার্সাল এডুকেশন। কোভিড অতিমারির সময় রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষার বহুবিধ সমস্যা ও তার মোকাবিলার নানা উদ্যোগ বিষয়ে সমীক্ষাটি করেছিলেন ‘শিক্ষা আলোচনা’ নামক সরকারি ও সরকার-পোষিত প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের সংগঠনটির সদস্য ও সহযোগীরা। এই রিপোর্টের মুখবন্ধ লিখেছিলেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ সুকান্ত চৌধুরী। তার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটির বাংলা তর্জমা করা যাক। সেখানে অধ্যাপক চৌধুরী বলেছিলেন, “স্কুল খুললেই সমস্যা মিটবে না; সত্যি বলতে কি, তখনই তার পুরো চেহারাটা প্রকট হবে। পঠনপাঠনের প্রচলিত ব্যবস্থায় সঙ্কটের সমাধান করা যাবে না, বিশেষত অনেক স্কুলেই যখন সামর্থ্যের ঘাটতি আছে, যথেষ্ট শিক্ষকও নেই। একটি বিশেষ কর্মসূচি তৈরি করা দরকার, এবং অতিমারির প্রকোপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমাগত তার প্রয়োজনীয় সংশোধন করে চলা আবশ্যক। এই কর্মসূচি রূপায়ণ করতে হবে একটা ‘মিশন মোড’-এ (অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত কিছু সুফল অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখে)। আপাতত বেশ কিছু কাল স্কুলগুলির সামর্থ্যের ঘাটতি থাকবেই, তাই গোটা উদ্যোগটাতে স্কুলের পাশাপাশি কমিউনিটি বা সমাজেরও সক্রিয় ভাবে যোগ দেওয়া দরকার।”

দু’বছর পরে এই কথাগুলো পড়তে পড়তে হতাশা অসঙ্গত নয়, ক্ষোভ আরও সঙ্গত। কোভিডের পরে শিক্ষার সমস্যাগুলো বাস্তবিকই আরও প্রকট হয়েছে, কিন্তু হাল ফেরানোর সর্বাত্মক চেষ্টা? মিশন মোড? সঙ্কটকে সুযোগে রূপান্তরিত করে যথার্থ সর্বশিক্ষার আয়োজন? কিছুই হয়নি। ঘটনা হল, আমাদের রাজ্যে শিক্ষার কাঠামোয় অনেক দিন ধরেই ঘুণ ধরেছে, সেই দুর্বল শরীরে অতিমারির ধাক্কায় ক্ষয় এবং ক্ষতি, দুটোই ঘটেছে অতিমাত্রায়। বিপদের মোকাবিলায় সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্ত হাতে হাল ধরার সবচেয়ে বড় দায় ছিল সরকারি ক্ষমতার অধীশ্বর ও অধীশ্বরীদেরই। কিন্তু সেই দায় তাঁরা স্বীকারই করেননি, বরং প্রগাঢ় ঔদাসীন্য আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সহকারে গোটা শিক্ষার ব্যবস্থাটাকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছেন। লেখাপড়া নিয়ে এ রাজ্যের শাসকদের যে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, বিশেষত স্কুলের পঠনপাঠন বিষয়ে চিন্তাভাবনার কোনও দরকার আছে বলেই যে তাঁরা মনে করেন না, তা অনেক আগেই বোঝা গিয়েছিল, কোভিড এসে সেই বোধহীনতার দীর্ঘমেয়াদি এবং মজ্জাগত ব্যাধিটিকে বহুগুণ প্রকট করে দিয়েছে।

কিন্তু ব্যাধির প্রকোপ কেবল শাসকের ঘরেই সীমিত নয়। তা না হলে, আজও কেন রাজ্য রাজনীতির ময়দানে, জোরদার আন্দোলন দূরে থাকুক, এমন একটা বড় আকারের সমাবেশও দেখা গেল না, যার দাবি: যে ভাবে হোক শিক্ষার হাল ফেরাতেই হবে, বিশেষত স্কুলশিক্ষার বনিয়াদটাকে কিছুতেই এ-ভাবে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং মামলার মিছিল যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, তা কখনওই শিক্ষার দাবিতে একটা সামগ্রিক আন্দোলনের বিকল্প হতে পারে না। কিন্তু এই রাজ্যে বিরোধী শিবিরের রাজনীতিকরাও এ বিষয়ে চিন্তিত নন, অন্তত চিন্তার কোনও প্রমাণ আজও মেলেনি। আর কমিউনিটি? কিংবা, সমাজ? যে ঔদাসীন্যের ব্যাধি রাজনীতির সর্বাঙ্গে, সমাজের বিবিধ পরিসরেও তো তার সংক্রমণ প্রকট। নিজের পরিমণ্ডলের বাইরে বৃহত্তর সমাজের, বিশেষত দরিদ্র শ্রমজীবী বর্গের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখল কি শিখল না, তা নিয়ে কতটুকু মাথাব্যথা এই সমাজে চোখে পড়ে? বস্তুত, সমাজের মাথাব্যথা নেই বলেই রাজনীতিক এবং শাসক-প্রশাসকদের উপরেও কোনও চাপ নেই, শিক্ষার এই ভয়াবহ অবস্থার প্রতিকারে কুটোটি না নেড়েও তাঁরা পার পেয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু সেই বাস্তবই আবার বলে দেয়, নাগরিকরা যদি সচল, সক্রিয় এবং সরব হতে পারেন, তা হলে রাজনীতিকরাও নড়াচড়া করতে বাধ্য হবেন। আর এখানেই শেষ পর্যন্ত ভরসার একটি সূত্র মেলে। অনেকে মিলে চেষ্টা করে আরও অনেককে জাগিয়ে তোলার ভরসা। গত তিন বছরে, অতিমারির কাল থেকেই, স্কুলের শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরের শিশুদের শিক্ষা-বিপর্যয় রুখতে ইতস্তত কিছু মানুষ বা গোষ্ঠীর প্রাণপণ লড়াইয়ের কথা এবং লড়াইটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরও অনেকের আন্তরিক তাগিদ আর চেষ্টার কথা জেনে সেই ভরসা নিজেকে কেবল বাঁচিয়ে রাখেনি, কিছুটা জোরও পেয়েছে।

সম্প্রতি সেই জোর আর একটু বাড়ল দীর্ঘ তিন ঘণ্টার এক ‘ভার্চুয়াল’ সমাবেশে বেশ কিছু মানুষের কথা শুনে। পশ্চিমবঙ্গের অনেকগুলি জেলার প্রাথমিক ও কিছু উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের— এবং কলেজেরও— শিক্ষক ছিলেন সেই সভায়; ছিলেন কয়েক জন শিক্ষাব্রতী নাগরিক, যাঁরা স্কুলে-পড়া, না-পড়া কিংবা পড়েও-না-পড়া শিশুদের বনিয়াদি শিক্ষার ঘাটতি পূরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছেন। অনেকেই নিজেদের সমস্যার কথা বললেন, জানালেন সমস্যার মোকাবিলায় নানা উদ্যোগের কথাও, প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে, হাজারটা মুশকিল আসান করে সেই সব উদ্যোগ কী ভাবে এগিয়েছে, সেই সাফল্যের কথা। সাফল্য সচরাচর সীমিত এবং অসম্পূর্ণ, কখনও বা সাময়িক, কিন্তু বিস্তর বাধাবিপত্তি এবং অল্প সামর্থ্যের বাস্তবকে দাঁড়িপাল্লায় রেখে বিচার করলে দেখা যাবে সেই সাফল্যের তাৎপর্য বিরাট, কারণ তা এক অমিত সম্ভাবনাকে চিনিয়ে দেয়। কিছু মানুষ কিছু এলাকায় যা পেরেছেন, পারছেন, আরও অনেক মানুষ আরও অনেক এলাকায় তা পারবেন— এই সম্ভাবনা। এ-ভরসা নিছক সদিচ্ছাপ্রসূত নয়, তার ভিত্তিতে আছে রাজ্যের নানা অঞ্চলে কাজ করে চলা সুনাগরিকদের বাস্তব অভিজ্ঞতা।

সেই অভিজ্ঞতার আলোচনা থেকে, অনেক দরকারি কথার মধ্যে, বিশেষ করে স্পষ্ট হয়ে উঠল দু’টি কথা। কথাগুলো নতুন নয়, কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে নতুন করে ভাববার মতো। এক নম্বর কথা হল, অন্তত প্রাথমিক স্তরে লেখাপড়ার ঘাটতি পূরণ করে শিশুদের শিক্ষার ভিত গড়ে দেওয়ার কাজটিতে বহু মানুষ নিজের স্বাভাবিক বিদ্যাবুদ্ধিকে রসদ করেই, হয়তো ছোটদের পড়ানোর কিছু পদ্ধতি ও প্রকরণ বুঝে নিয়ে, স্বচ্ছন্দে যোগ দিতে পারেন, দরকার কেবল আন্তরিকতা এবং উদ্যম। ঢাকঢোল কাড়ানাকাড়ার কোনও প্রয়োজন নেই, দরকার যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকেই কাজটা শুরু করা, পরস্পর কথা বলা, হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করা, কার কোথায় কী প্রয়োজন সেটা জানা এবং সাধ্যমতো সেই প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা, আর এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই ক্রমশ আরও আরও অনেককে শামিল করা। দলে শামিল করা নয়, কাজে শামিল করা। কাজ একটা নয়, অনেক। প্রাথমিক শিক্ষার ভিতটাকে গড়ে তোলা তার অন্যতম। এবং অন্যতম প্রধান।

দ্বিতীয় কথা, এই কাজে বড় সহায় হতে পারেন শিশুদের পরিবারের মানুষজন। লেখাপড়া শেখানোর গোটা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে নিতে হবে অভিভাবকদের, বিশেষ করে মায়েদের। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন এক প্রবীণ শিক্ষাব্রতী, তিনি জানালেন, “আমরা মায়েদের কাছে প্রমাণ করেছি, তাঁরা লেখাপড়া জানেন, কিন্তু তাঁরা যে জানেন সেটা তাঁরা জানতেন না। আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি।” তাঁর সংযত কণ্ঠে যে গভীর প্রত্যয়, তা দীর্ঘ ও প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা থেকেই সঞ্জাত। এ কোনও বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত তো নয়— এটাই বরাবর জেনে এসেছি যে, শিক্ষক যখন যেখানে মায়েদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছেন, সুফল মিলেছে। সে-দিনও জানা গেল এক সাম্প্রতিক কাহিনি: নিরক্ষর জননী শিক্ষকের কথা শুনতে শুনতে সন্তানের পড়াশোনার শরিক হয়ে গিয়েছেন, ‘দ’ দিয়ে কী কী শব্দ তৈরি হতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন চার পাশের পরিবেশে, আবিষ্কার করেছেন ‘দরজা’ কিংবা কানের ‘দুল’, আনন্দে উজ্জ্বল হয়েছে জননীর মুখ, তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে ছেলেমেয়েদের মুখে, আক্ষরিক অর্থে সর্বশিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দরজা খুলে গিয়েছে। এরই নাম মানবজমিন, আবাদ করলে এখনও সোনা ফলবে।

আবাদ করতে হলে মাঠে নামা চাই। শিক্ষক, শিক্ষাব্রতী, স্বেচ্ছাসেবী, ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, সবাই মিলে একে অন্যকে মাঠে নামানোর উদ্যোগ করা চাই। মিশন মোড-এ। সেটাই বোধ করি কমিউনিটি নির্মাণেরও পথ। আগে থেকে বা বাইরে থেকে তৈরি করা কমিউনিটি দিয়ে দলতন্ত্রশাসিত এই সমাজে আরও অনেক দল পাকানো যাবে, এইমাত্র। সত্যিকারের কমিউনিটি তৈরি হতে পারে সরাসরি কাজের মধ্য দিয়েই।

অন্য বিষয়গুলি:

Primary Education Education West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy