পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন” লিখেই তার পরের লাইনে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, “মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে”। রাষ্ট্রপুঞ্জের আইপিসিসি সংগঠনটির অতি সাম্প্রতিক রিপোর্ট পড়ে লাইনগুলো মনে এল। এই রিপোর্ট মনুষ্যকৃত বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি আর জলবায়ু পরিবর্তনের। তবে এই ‘গভীর অসুখ’ তো আজ পৃথিবীর নয়— মানুষেরই। পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন আগেও বহু বার হয়েছে। পাঁচ বার প্রাণের মহাবিলুপ্তি ঘটেছে। কিন্তু পৃথিবী সামলে নিয়েছে। প্রাণ টিকে গেছে। এ বার কিন্তু অসুখ মানুষের। কী অসুখ? একটু কাব্যি করে বা দার্শনিক ভাবে বললে আমার মনে হয় অসুখটা এই: পৃথিবীর কাছে ও অন্য প্রাণীর কাছে মানুষের যে কী এবং কত পরিমাণে ঋণ, মানুষ যেন ভেবেছিল তা সম্পূর্ণ ভুলে মেরে দিয়েও নিজের ক্ষমতা, সুখস্বাচ্ছন্দ্য আর মুনাফা অনির্দিষ্ট ভাবে বাড়িয়ে চলবে। এই সহজ কথাটাও মনে থাকে না, যে অক্সিজেন ব্যতীত আমরা বাঁচতামই না, তাও বাতাসকে জোগান দেয় নানান ‘মনুষ্যেতর’ প্রাণী, এবং এই পৃথিবী গ্রহটির নানান প্রক্রিয়া। এই ভুলে-যাওয়াটার প্রথম শুরু ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দিনগুলোতে, ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার সূচনায়। তার পর সেই পশ্চিম-প্রদর্শিত পথে অন্যান্য দেশের নেতারাও হেঁটেছেন।
অনেক দিন ধরে শিল্প-সভ্যতার সমাজপতি মানুষেরা, তাঁরা শিল্পপতিই হন বা দার্শনিক— মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন মর্তেই স্বর্গরচনার। পন্থা নিয়ে অবশ্যই তর্ক হয়েছে— ধনতন্ত্র না সমাজতন্ত্র, রক্তক্ষয়ী বিপ্লব না শান্তিপূর্ণ পথ, মুক্ত বাজারের অর্থনীতি না কি রাষ্ট্রের মালিকানায় শিল্প, এই সব আলোচনা। যুদ্ধ-বিগ্রহ-বিপ্লবী হিংসা। তবু মানুষ নিজের অবস্থার উন্নতিকেই, কবির ভাষায়, ‘পৃথিবীর ক্রমমুক্তি’ বলে ভুল করেছে। যেন পৃথিবীটা, সেই কবীর সুমনের গানের কথার মতো, “সব আমাদের জন্য, আমাদেরই জন্য।” পৃথিবীতে প্রাণের আয়োজন কিসে বজায় থাকে, বন্যপ্রাণী বা গাছগাছালি না থাকলে মানুষের কী ক্ষতি, সে সব ভুলে শুধু নিজের অবস্থার লাগামছাড়া উন্নতির সাধনায় মানুষ ডেকে এনেছে নিজেরই সর্বনাশ। কৃষিজমি, বাসস্থান, ফসলজাত জ্বালানি, খনিজ পদার্থ ইত্যাদির খোঁজে ক্রমাগত জঙ্গল কেটে ফেলায় আমরা এসে পড়েছি এক অতিমারির যুগে, যখন ঘন ঘন অতিমারির আক্রমণ সম্ভব। আর জঙ্গল কেটে ফেলার সঙ্গে শুধু যে ভাইরাসের কথা বা বন্যপ্রাণীর ঘরছাড়া হওয়ার গল্প জড়িয়ে আছে তা নয়, জড়িয়ে আছে যে সব গ্যাস বাতাসে নির্গত হয়ে পৃথিবীর উপরিভাগের তাপমাত্রা বাড়ায়, সেই সব গ্রিনহাউস গ্যাসেরও গল্প। অর্থাৎ, আজকের অতিমারি আর পৃথিবীর উষ্ণতাবৃদ্ধি, দু’টি আলাদা কাহিনি নয়। আমাদের সার্বিক সঙ্কটেরই দু’টি ভিন্ন প্রকাশ।
খুব সহজ করে বললে, গল্পটা এই রকম দাঁড়ায়। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত, শুধুমাত্র শিকার-নির্ভর, অর্থাৎ কৃষিজীবী নয়, এমন সমাজের কথা বাদ দিলে, অনেক সমাজেই মানুষের জীবন খাদ্যাভাবের কষ্টে কেটেছে। এমনকি সাম্রাজ্য থাকা সত্ত্বেও ইউরোপের বেশির ভাগ মানুষের পেট-ভরা খাবার অনেক সময় মিলত না। সাধারণ মানুষের জীবন ছিল ক্ষুধার রাজ্য, গদ্যময়। গড়পড়তা আয়ুও ছিল কম। এই অবস্থা গত দেড়শো বছরে অকল্পনীয় ভাবে বদলেছে। সত্য বটে মনুষ্যসমাজের শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতা, জাত-বর্ণ ও অন্যান্য বৈষম্য, বিভেদ, অন্যায় আজও দৃষ্টিকটু ভাবে চোখে পড়ে। অতিমারির সময় দরিদ্রের লাঞ্ছনা আরও প্রকট হয়েছে। কিন্তু গত দেড়শো বছরে মানুষের জীবনযাত্রার মানের ও মানুষের সংসারের যে অভাবনীয় বৃদ্ধি হয়েছে তা অনস্বীকার্য। প্রথমত, মানুষের সংখ্যা। আমাদের এই ‘হোমো সেপিয়েন্স’ প্রজাতির বয়স যদি তিন লক্ষ বছর হয়, তা হলে বলা যায় যে, প্রায় এই পুরো সময়টাই মানুষের লেগে গিয়েছিল সংখ্যায় এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটিতে পৌঁছতে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা ছিল দেড়শো কোটির মতো। ২০০০ সালে তা দাঁড়াল ৬০০ কোটিতে, একশো বছরে প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি। এরও বেশির ভাগটাই ১৯৫০-এর পর। ভারতের জনসংখ্যা ১৯৪৭-এর পর চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। শুধু জনসংখ্যা নয়, এই একশো বছরে শহরের মানুষ বাড়ল তেরো গুণ, যন্ত্রশিল্পের উৎপাদন বাড়ল পঁয়ত্রিশ গুণ, শক্তির ব্যবহার বারো গুণ, পেট্রলের ব্যবহার তিনশো গুণ, রাসায়নিক সারের ব্যবহার সাড়ে তিনশো গুণ, মৎস্যশিকার পঁয়ষট্টি গুণ, রাসায়নিক দ্রব্যের উৎপাদন এক হাজার গুণ, আর মোটর গাড়ির সংখ্যা সাত হাজার সাড়ে সাতশো গুণ। মানুষের অর্থনীতির বহর বাড়ল পনেরো গুণ। সেই সঙ্গে শিশুমৃত্যুর হার কমে ও জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি হওয়ায় মানুষের, এমনকি গরিব মানুষেরও, আয়ু বাড়ল গড়পড়তা। গত কুড়ি বছরে এই বৃদ্ধি অব্যাহত। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও প্রজাতি কোনও দিন এত আরামে থাকেনি, এমনকি মানুষও না!
ফ্রিজ, গাড়ি কিনতে পারেন, এমন মানুষের সংখ্যাও যে কী ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তা দেখলে আশ্চর্য লাগে। ২০১৭ সালের একটি রিপোর্টে দেখছি, অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের পর এই রকম ভোগী মানুষের সংখ্যা একশো কোটি হতে সময় লেগেছিল ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত। আর সেই সংখ্যা দু’শো কোটিতে পৌঁছতে লেগেছে মাত্র একুশ বছর (২০০৬), তিনশো কোটি হতে নয় বছর (এর বেশির ভাগই চিনে)। এঁরা আরও বলছেন যে, সংখ্যাটি চারশো কোটিতে দাঁড়াতে লাগবে সাত বছর (২০১৭ থেকে), আর হয়তো পাঁচশো কোটিতে পৌঁছবে ছয় বছরে, ২০২৮-২৯ সাল নাগাদ। এত রমরমার পিছনে আছে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের ব্যবহার ও চাহিদা। বিদ্যুৎ ছাড়া আধুনিক পরিকাঠামো ভাবাই যায় না। আজ যদি বড়লোক দেশ ও গরিব দেশের মধ্যে (বা গরিব এবং বড়লোকের মধ্যে) তফাত কী ভাবতে বসেন, তা হলে দেখবেন একটি মূল তফাত হল মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার। যে দেশে সস্তায় প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ ঘরে ঘরে সরবরাহ করা হয়, সেই দেশে মানুষের শারীরিক আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য ও ‘স্বাধীনতা’ বেশি। সেখানেই সব মানুষ যেতে চায়।
ঐতিহাসিক ভাবে এই বিদ্যুৎ ও শক্তির প্রচুর ও সস্তার জোগান মানুষ খুঁজে পেয়েছে জীবাশ্ম-উদ্ভূত জ্বালানিতে (কয়লা, পেট্রল, প্রাকৃতিক গ্যাস)। এই সব জ্বালানির প্রচুর ব্যবহার না-করলে মানুষের জীবনযাত্রার মান এত উন্নত হত না, জনসংখ্যাও এত বাড়ত না। এইখানেই ওই ‘তবুও মানুষ ঋণী পৃথিবীর কাছে’ কথাটা আসে। মানুষ ধরেই নিয়েছিল যে, পৃথিবী যেন ‘সকলসহা সকলবহা মাতার মাতা’। কিন্তু আজ আমরা জেনেছি যে, পৃথিবী ওই রকম সকলসহা মাতার মাতা নন। ফসিল-জ্বালানি ব্যবহার করলেই গ্রিনহাউস গ্যাস (কার্বন ডাইঅক্সাইড ইত্যাদি) নির্গত হয়ে বাতাসে মিশে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ায়। পৃথিবীতে প্রাণের রক্ষার জন্য বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু তার মাত্রা বেড়ে গেলে মানুষেরই সমস্যা। বাড়তি এই সব গ্যাস পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়াতে থাকে। জঙ্গলে আগুন লাগে, কৃষিক্ষেত্রে খরা। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টিতে বন্যা, ধস। শহরে জনবসতির ও ঘরবাড়ির ঘনত্বের কারণে গরম আরও বেশি মাত্রায় বাড়ে। তখন মানুষ এয়ার কন্ডিশনার লাগিয়ে গাড়ি-বাড়ি ঠান্ডা করতে গিয়ে আরও গ্রিনহাউস গ্যাস ছড়িয়ে শহরের তাপমাত্রা আরও বাড়ায়। সমস্যাটা একটা দুষ্টচক্রের মতো।
ও দিকে সমুদ্রের জল গরম হলে সামুদ্রিক বরফ গলে সমুদ্র ফুলে, ফেঁপে উঠে উপকূলবাসী মানুষের বসতি গিলতে চায়, মিষ্টি জলকে নোনা করে ফেলে। সাইক্লোন আর সুনামির সম্ভাবনা বাড়ে। আর সমুদ্রে মেশা বাড়তি কার্বন ডাইঅক্সাইড জীবজগতেও গোলমাল বাধায়। জলে অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ে। অনেক ছোট ছোট ঝিনুক, শামুক জাতীয় প্রাণী জলে অ্যাসিড বাড়লে বাঁচতে পারে না। তখন আবার তাদের খেয়ে যারা বাঁচে, তাদের খাবার ফুরোয়, ফলে প্রাণধারণের মুশকিল হয়। সমস্যাটা এমনি করে জীবজগতের উপর দিকে উঠে এসে একটা জীববৈচিত্রের তথা জীবনেরই সঙ্কটের জন্ম দেয়। মানুষ এই সঙ্কটের বাইরে নয়।
সভ্যতা নির্মাণের অন্যতম মানুষী শর্তই ছিল মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মানুষকে শিকার করতে পারে এমন প্রাণী থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারা। কিন্তু এই প্রাথমিক শর্তটিই এখন ভেঙে পড়ছে। আমাদের সভ্যতাই জলবায়ু ও অতিমারির সঙ্কট তৈরি করে আমাদের বিপদ ডেকে আনছে। তাই বলছিলাম, মানুষেরই গভীর, গভীরতর অসুখ এখন। বাঁচতে গেলে মানুষকে ভাবতে হবে এই আত্মগ্রাসী, লাগামহীন ধনতান্ত্রিক ‘উন্নতি’র পথ মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য ঠিক কি না। কিন্তু শিল্প-সভ্যতা যে আরামের সন্ধান দিয়েছে অনেক মানুষকে, মানুষ তাকে ছাড়বে কী ভাবে? অনেকে ভাবছেন, মানুষের প্রযুক্তি-উদ্ভাবনী বুদ্ধিই এমন একটা পথ দেখাবে যে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। কিন্তু আজকের জলবায়ুর ঘনীভূত সঙ্কট কি সেই সময় আর সুযোগটা দেবে মানুষকে? আইপিসিসি বলছে, এর উত্তরটা পরিষ্কার জানা নেই। যা-ই করি, উন্নতির যে পন্থাই নিই, মানুষকে স্মরণ রাখতেই হবে ওই কথাটা— ‘তবুও মানুষ ঋণী পৃথিবীরই কাছে’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy