গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
যাদবপুরে প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যুর অন্যতম কারণ র্যাগিং। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কমিটির রিপোর্টে এমনই তথ্য উঠে এসেছে। ওই পড়ুয়ার অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর থেকেই তাঁর বাড়ির লোকজন এই র্যাগিয়ের অভিযোগই তুলেছিলেন। সেই মর্মে পুলিশের কাছে অভিযোগও করেন। শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কমিটির রিপোর্টও সেই অভিযোগকেই মান্যতা দিয়েছে। তবে ওই পড়ুয়ার মৃত্যু কী ভাবে হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনও দিশা দেখাতে পারেনি অভ্যন্তরীণ কমিটির ওই রিপোর্ট।
পুলিশ দাবি করেছে, ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় র্যাগিংয়ের প্রমাণ মিলেছে। লালবাজার সূত্রে খবর, হস্টেলের ৭০ নম্বর ঘরে ওই ছাত্রকে বিবস্ত্র করানো হয়েছিল। তার পর তাঁকে বারান্দায় হাঁটানো হয়। কী ভাবে র্যাগিং হয়েছে, তার নথি গত মঙ্গলবার আলিপুর আদালতে জমা করেছে পুলিশ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে জানানো হয়েছে, ঘটনার আগে বেশ কিছুটা চাপে ছিলেন ওই পড়ুয়া। সূত্রের খবর, এর আগেও মেন হস্টেলে একাধিক র্যাগিংয়ের অভিযোগ সামনে এসেছে বলে উল্লেখ রয়েছে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে। তাতে কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক ব্যর্থতাও তদন্ত কমিটি খুঁজে পেয়েছে বলে খবর। পাশাপাশি এ-ও জানা গিয়েছে, তদন্তে নেমে এ পর্যন্ত ১০০-র বেশি জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে কমিটি। আগামী সপ্তাহে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে।
অন্য দিকে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ামৃত্যুর ঘটনায় ১৩ জন ধৃতের মধ্যে অন্যতম সৌরভ চৌধুরীকে শুক্রবার আদালতে হাজির করানো হয়। বিচারক তাঁকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। শুনানিতে সৌরভের আইনজীবীর সঙ্গে সরকার পক্ষের আইনজীবীর সওয়াল-জবাব চলে। সৌরভের আইনজীবীর দাবি, তদন্তে তাঁর মক্কেলের ভূমিকা সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি। কিন্তু পুলিশের দাবি, এই মামলা এগিয়েছে অনেকটা। সৌরভের সঙ্গে যাদবপুরকাণ্ডের যোগ রয়েছে বলে দাবি করা হয়। এমনকি, গোটা ঘটনার জন্য তাঁকে ‘কিংপিন’ (মাথা) বলেছেন সরকারি আইনজীবী। যদিও সৌরভ আগাগোড়া নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন। সৌরভের জেল হেফাজতের নির্দেশ শোনার পর তাঁর আইনজীবী শুক্রবার বিচারককে অনুরোধ করেন, ‘‘দাগী বন্দিদের সঙ্গে যেন জেলে সৌরভকে না রাখা হয়।’’ অন্য দিকে সরকার পক্ষের আইনজীবী জানান, অন্যদের বেলায় যা নিয়ম, সেটাই মেনে চলা উচিত। সৌরভের আইনজীবী বলেন, ‘‘পিক অ্যান্ড চুজ় করা হচ্ছে।’’ প্রত্যুত্তরে সরকারি আইনজীবী বলেন, ‘‘পিক অ্যান্ড চুজ় করে দল বেঁধে মারা হয়েছে।’’ পাল্টা সৌরভের আইনজীবী বলেন, ‘‘এটা এখনই কী করে বলছেন?’’
কী আছে অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে
ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় শুক্রবার অভ্যন্তরীণ কমিটির রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউকে। সূত্রের খবর, তাতে বলা হয়েছে, ছাত্রমৃত্যুর নেপথ্যে র্যাগিংয়ের ভূমিকা রয়েছে বলে ‘মনে করা হচ্ছে’। প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। কিন্তু তার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্তে স্পষ্ট নয় যে, গত ৯ অগস্ট রাতে কী ভাবে হস্টেলের বারান্দা থেকে পড়ে গিয়েছিলেন বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ওই ছাত্র। রিপোর্টে শুধু বলা হয়েছে, কী ভাবে ওই ছাত্র ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন, তা জানা যায়নি। তবে র্যাগিংয়ের ঘটনায় যাঁরা অভিযুক্ত বলে কমিটি মনে করেছে, তাঁদের অনেকেই এখন পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।
আদালতে সৌরভ
যাদবপুরকাণ্ডে সৌরভ চৌধুরীকে ‘কিংপিন’ বলে দাবি করেছেন সরকার পক্ষের আইনজীবী। ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় তাঁকেই প্রথম গ্রেফতার করে পুলিশ। যাদবপুরের ওই প্রাক্তনীকে শুক্রবার আলিপুর আদালতে তোলা হলে আগামী ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাঁকে জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। আদালত জানায়, এই সময়ের মধ্যে চাইলে সৌরভকে জেলে গিয়ে জেরা করতে পারবে পুলিশ। আদালতে সরকারি আইনজীবী গোপাল হালদার দাবি করেন, ‘‘পিক অ্যান্ড চুজ় করে ছাত্রকে মারা হয়েছে।’’ তাঁর মন্তব্যের ঘোর বিরোধিতা করেন সৌরভের আইনজীবী। এই ‘পিক অ্যান্ড চুজ়’ কী? সরকারি আইনজীবী জানান, একটি গামছা উদ্ধার হয়। যেটা দিয়ে মৃত ছাত্রের মুখে চাপা দেওয়া হয়েছিল। সেই রক্ত মাখা গামছা এবং ২টো ফোন বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ফোনে একটি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপও তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে মেসেজ চালাচালি হত। সরকারি আইনজীবীর দাবি, সেখানে তদন্ত প্রভাবিত করার প্রমাণ হাতে পেয়েছেন তদন্তকারীরা। ফোনে ‘জেইউএমএইচ’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল। সৌরভ সেই গ্রুপে ‘ইনস্ট্রাকশন’ (নির্দেশ) দিতেন । মাঝেমধ্যে সেই গ্রুপে অ্যাক্টিভ হতেন শুধুমাত্র ‘নির্দেশ’ দেওয়ার জন্য। সরকারি আইনজীবীর কথায়, “ছাত্রমৃত্যুর পর সৌরভ চৌধুরীকে বাঁচাতে অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র হয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে ওই ষড়যন্ত্র হয়েছিল।” তিনি জানান, হস্টেলে সৌরভ থাকেন কি না, সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তদন্তকারীদের কী বলা হবে, তা সবই সেই গ্রুপে লেখা হত। পরে প্রমাণ লোপাটের ক্ষেত্রে সেই গ্রুপ ডিলিট করে দেওয়া হয়।
আদালতে সরকারি কৌঁসুলি এ-ও জানিয়েছেন, চার জনকে নিয়ে যে হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ তৈরি করেছিলেন সৌরভ, তাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘মা অসুস্থ হলে আমি আসি। না হলে হস্টেলে আসি না।’’ যাঁদের মেসেজ পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের এক জনের মোবাইল থেকে এই তথ্য পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। সরকারি কৌঁসুলির দাবি, পুলিশকে বিভ্রান্ত করতেই এই কথা লেখা হয়েছিল।
বিজেপির মিছিল
যাদবপুরে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে কয়েক দিন আগেই সভা করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। শুক্রবার বিজেপির যুব মোর্চার মিছিলেরও নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। র্যাগিংমুক্ত যাদবপুর ক্যাম্পাসের দাবিতে বিজেপির যুবমোর্চা এবং এবিভিপির ওই মিছিল ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায়। গোলপার্ক থেকে যাদবপুরের ৮বি বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত মিছিল কর্মসূচি ছিল গেরুয়া শিবিরের। মিছিলে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। কয়েক জনকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। বেশ কয়েক জন এবিভিপি সমর্থককে প্রিজ়ন ভ্যানে তোলা হয়। অন্য দিকে, ওই মিছিল থেকে জুতো দেখানোর অভিযোগও উঠেছে। তাতে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়। মিছিল শেষে শুভেন্দু বলেন, ‘‘ভয়ে এ সব করছে। কারণ, ওরা বুঝতে পারছে, এই ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যর্থ। পুলিশমন্ত্রীর ব্যর্থতা সামনে এসে যাবে, তাই গণতান্ত্রিক শক্তি ও বাক্স্বাধীনতা হরণ করার জন্য এ সব করা হয়েছে।’’ পাশাপাশি তিনি অভিযোগের সুরে বলেন,‘‘আমরা রাষ্ট্রবাদের পক্ষে। মাওবাদ, নকশালবাদ এবং দেশবিরোধী শক্তিকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছি। আমরা কোর্টের অনুমতি নিয়েই মিছিল করেছি। দায়িত্ব (শান্তিশৃঙ্খলা বজায়ের) পুলিশ প্রশাসনের।’’
যাদবপুরের রেজিস্ট্রারকে ডাক
বুধবার সকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কেন্দ্র অরবিন্দ ভবনের ভিতরে ঢুকতে দেখা যায় ২০ জনকে। তাঁদের পরনে ছিল সেনার পোশাক। তাঁরা কারা? বৃহস্পতিবার এ নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। পুলিশ সূত্রে আগেই জানা গিয়েছিল যে, এই মামলায় লালবাজারে তলব করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসুকে। শুক্রবার লালবাজার সূত্রে জানা যায়, শুধু রেজিস্ট্রারই নন, ওই ঘটনায় ডিন অফ স্টুডেন্টস রজত রায়কেও তলব করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য বুদ্ধদেব সাউকে সংশ্লিষ্ট মামলায় নোটিস দিতে চলেছে লালবাজার। পুলিশ সূত্রে খবর এমনই। বস্তুত, যাদবপুরের হস্টেল থেকে এক ছাত্রের পড়ে যাওয়ার ঘটনার পরই হস্টেলের নিরাপত্তা নিয়ে সরব হয় বিজেপি। গেরুয়া শিবির থেকে এমনও দাবি উঠে আসে যে, অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিকদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হোক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জুও জানিয়েছিলেন যে, অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মীদের ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা যায় কি না, সে ব্যাপারে আলোচনা করা হবে। তার পর ওই দিন সকালেই ক্যাম্পাসে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় জলপাই রঙের পোশাক পরা কয়েক জনকে উর্দিধারীকে। তাঁরা কি সেনকর্মী? আধাসেনা? এই কৌতূহলের মধ্যে রেজিস্ট্রারকে নোটিস পাঠানো হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy