কলেজ থেকেই শখ স্কুবা ডাইভিং-এর। রাহুল গান্ধীর (ছবি) এ বারের বিদেশ যাত্রা নাকি ছিল মূলত ‘স্কুবা ডাইভিং ট্রিপ’! ফিরেই তিনি নেপালে বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলেন। কাঠমান্ডুর এক নাইটক্লাবে তাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করতে দেখা গেল। প্রিয় নীল রঙের টি-শার্ট, মসৃণ কামানো গাল, কথা বলতে বলতে হাতে মোবাইল ঘাঁটছেন।
এর পর দেশে ফিরে রাহুল গেলেন তেলঙ্গানায়। মুখে কয়েক দিনের না-কামানো আলসে দাড়ি। কৃষকদের নিয়ে জনসভার আগে পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে দলের নেতাদের কাছে জানতে চাইলেন, “কেয়া বোলনা হ্যায়?”
মোদী সরকারের এক তরুণ মন্ত্রী সে দিন বলছিলেন, রাজনীতিতে এখন ‘অপটিক্স’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিজেকে কী ভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরছেন, তার উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে! রাহুল গান্ধীকে দেখবেন, লোকসভায় চোখের উপর কপালে হাত রেখে বসেন। যেন ক্লান্ত, চিন্তিত। সব সময়ই মোবাইল ঘাঁটছেন। টিভি-তে দেখে লোকে ভাববে, মোবাইলে গেমস খেলছেন!
ঘোরতর কংগ্রেস বিরোধী এই বিজেপি নেতার কথা শুনে বোঝা যায়, তিনিও কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি, বর্তমানে সভাপতি না হয়েও দলের অন্যতম কান্ডারির কাজকর্মে হতাশ। ইটালিতে বৃদ্ধা দিদিমার দেখাশোনা করতে যাওয়া, বান্ধবীর বিয়েতে যাওয়ায় দেশের কিছু নেই। কিন্তু স্কুলের পরীক্ষায় ফেল করে আসা ছাত্র রোজকার মতোই বিকেলে ফুটবল খেলতে গেলে যেমন চোখে লাগে, পাঁচ রাজ্যে হারের পরেও রাহুল গান্ধীর স্কুবা ডাইভিং বা নাইটক্লাবে যাওয়াটা তেমনই অনেক কংগ্রেস নেতার কাছে দৃষ্টিকটু। এমনকি অন্য দলের নেতানেত্রীরাও বিস্মিত— কেন রাহুল গান্ধী এ ভাবে নিজের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতিক’-এর ভাবমূর্তি তৈরি হতে দিচ্ছেন? রাজনীতিকদের ভাবমূর্তি তৈরিতে দক্ষ প্রশান্ত কিশোরও তাই নাইটক্লাবের ঘটনার পরে বলেছেন, ভাগ্যিস আমি ওঁর ভোটকুশলী নই!
এতৎসত্ত্বেও রাহুল গান্ধীকে ছাড়া কংগ্রেসের গতি নেই। শুক্রবার থেকে উদয়পুরে কংগ্রেসের চিন্তন শিবির বসছে। আর কিছু হোক না হোক, একটা বিষয় নিশ্চিত। ফের সমস্বরে রাহুলকে কংগ্রেসের সভাপতি পদে ফেরানোর দাবি উঠবে। কিন্তু সভাপতি হওয়ার পরে কী করবেন? তিন দিন ধরে কংগ্রেসের ৪২২ জন নেতা দলের পুনরুত্থানের রাস্তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা তৈরি করবেন। সকলের পরামর্শ নিয়ে তৈরি হবে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’। প্রশ্ন হল, চিন্তন তো হবে! ‘অ্যাকশন’ কবে হবে?
আসলে সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীরাও জানেন, তাঁদের কাছে পরামর্শের কোনও কমতি নেই। ‘অ্যাকশন প্ল্যান’-এর কোনও অভাব নেই। ঘাটতি শুধু ‘অ্যাকশন’-এ। ১৯৯৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হারের পরে সনিয়া গান্ধী প্রবীণ নেতা এ কে অ্যান্টনির নেতৃত্বে ময়নাতদন্ত কমিটি তৈরি করেছিলেন। ‘অ্যান্টনি কমিটি’ নামে বিখ্যাত সেই গোষ্ঠী কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি-সহ সব স্তরে সাংগঠনিক নির্বাচনের সুপারিশ করেছিল। যে সব রাজ্যে কংগ্রেস দুর্বল, সেখানে বিজেপি বিরোধী দলগুলির সঙ্গে জোট তৈরির মত দিয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনের ছয় মাস ও বিধানসভা ভোটের তিন মাস আগে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে ফেলার কথা বলেছিল। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, মোতিলাল ভোরা-র মতো অ্যান্টনি কমিটির অনেক সদস্যই প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু সেই কমিটির রিপোর্ট কোনও দিনই কার্যকর হয়নি। তার পরে ২০০৭-এও সনিয়া গান্ধী কমিটি তৈরি করেছিলেন। রাহুল নিজে সেই কমিটিতে ছিলেন। সেই কমিটিও সংগঠনের সব স্তরে নির্বাচনের কথা বলেছিল। এখন কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ নেতাদের ‘জি-২৩’ গোষ্ঠীও একই দাবি জানিয়ে সনিয়া গান্ধীকে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি।
এত পরামর্শ ধুলোর আস্তরণের তলায় পড়ে থাকতেও গান্ধী পরিবার ফের কংগ্রেসের পুনরুত্থানের রাস্তা খুঁজতে চিন্তন শিবিরের ডাক দেওয়ার একটাই অর্থ। আসল সমস্যা ধামাচাপা দিয়ে নিজের সুবিধামতো সমাধান খোঁজা। অনেকটা মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সেই গল্পের মতো। নাসিরুদ্দিনকে বাগানে খোঁজাখুঁজি করতে দেখে এক পড়শি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কিসের খোঁজ চলছে! নাসিরুদ্দিন জানালেন, তাঁর চাবিটি হারিয়েছে। কোনখানে ফেলেছিলেন, জানতে চাওয়ায় নাসির বলেন, ঘরের ভিতরে। তা হলে বাগানে খোঁজা কেন? নাসিরুদ্দিনের উত্তর ছিল, ঘরে অন্ধকার। বাগানে আলো রয়েছে। তাই সেখানেই খুঁজছেন।
গান্ধী পরিবারের মতো কংগ্রেসের সব নেতাই জানেন, তাঁদের আর ‘চিন্তন’-এর দরকার নেই। কী করতে হবে, তা সকলেই জানেন। দরকার ‘অ্যাকশন’-এর। কিন্তু ক্ষমতা ভোগ করতে করতে মাঠে-ময়দানে নেমে রাজনীতি করার অভ্যাস কংগ্রেসের সিংহভাগ নেতারই চলে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী অমিত শাহ যোগী আদিত্যনাথরা যে পরিমাণে পরিশ্রম করেন, তার সিকি ভাগও কংগ্রেসের কেউ করেন না। রাহুল বা প্রিয়ঙ্কা হঠাৎ কোনও ঘটনা ঘটলে ছুটে যান। নির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে লেগে থাকা তাঁদের ধাতে নেই। তাঁরা একটা বিষয় নিয়ে কিছু দিন মাতামাতি করে পরে নিজেরাই ভুলে যান।
কংগ্রেসের ইতিহাস বলে, অতীতেও চিন্তন শিবির থেকে বিশেষ কিছু লাভ হয়নি। ১৯৯৮’এ পাঁচমারিতে কংগ্রেসের অধিবেশনের পরে দল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, জোট রাজনীতি নিছক ব্যতিক্রম। স্বল্প সময়ের ঘটনা। একটাই দলের ক্ষমতায় আসা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। পরের বছর বাজপেয়ী সরকার ক্ষমতায় আসে। ২০০২-এর গুজরাত হিংসার পরে ২০০৩-এ কংগ্রেস আবার শিমলা অধিবেশনে জাতীয় স্তরে ধর্মনিরপেক্ষ জোটের পক্ষে অবস্থান নেয়। সেই জোট সরকার গড়েই ২০০৪-এ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ ক্ষমতায় আসে। তার পর ২০১৩-তে ফের জয়পুরে কংগ্রেসের চিন্তন শিবির বসে। জয়পুরি টোটকায় নরেন্দ্র মোদীর ২০১৪-র জয় আটকানো যায়নি। ২০১৮-য় রাহুল গান্ধী কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরে দিল্লিতে প্লেনারি অধিবেশন বাদ দিলে, গত আট বছরে কংগ্রেসের সঙ্কটকালে এই প্রথম চিন্তন শিবির বসছে।
কংগ্রেসের নেতাদের যে চিন্তন শিবিরের কথা বিশেষ মনে পড়ে না, তা হল ১৯৭৪-এ ইন্দিরা গান্ধীর আমলে উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের নরোরায় কংগ্রেসের অধিবেশন। ইন্দিরা তখন দলের মধ্যে চাপের মুখে। চন্দ্রশেখর, হেমবতী নন্দন বহুগুণার মতো নেতারা ক্ষুব্ধ। বাইরে তাঁর বিরুদ্ধে আরএসএস-জনসঙ্ঘ, মার্ক্সবাদী, সমাজবাদীরা হাত মেলাচ্ছে। উঠে আসছেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। এ দিকে অর্থনীতির অধোগতি চলছে। এই প্রেক্ষিতে নরোরায় ইন্দিরা মানুষের মন জিততে দলিত, ভূমিহীন, খেতমজুর, আদিবাসীদের মধ্যে জমি বিলির মতো ১৩ দফা কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সিদ্ধান্ত তো নিলেন। কিন্তু এক বছরের মধ্যে জরুরি অবস্থা জারি করলেন। নিজের রাজনৈতিক কবর নিজেই খুঁড়ে ফেললেন।
ইন্দিরা সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, পরিশ্রমের বিকল্প নেই। ফের ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্যে ইন্দিরা যখন প্রচার শুরু করলেন, তখন তাঁর বয়স বাষট্টি বছর। গোটা দেশ চষে ফেলেছিলেন। কংগ্রেসের প্রাচীন প্রবাদ, প্রচারে ইন্দিরার সঙ্গী ছিলেন এক জন আপ্ত সহায়ক, তিন জন দেহরক্ষী। সঙ্গে থাকত দুটো সুটকেস, দুটো বালিশ, আটটি শাড়ি ও ফুলহাতা ব্লাউজ, একটা কমলা রঙের জাপানি পোর্টেবল আলো আর দুটো ফ্লাস্ক। একটায় গরম জল। অন্যটায় ঠান্ডা দুধ।
শরদ পওয়ার কবে থেকে বলছেন, রাহুল গান্ধীর এ বার ভারত সফরে বেরোনো উচিত। প্রশান্ত কিশোর কংগ্রেস নেতাদের সামনে বলেছেন, কয়েক দশক পেরিয়ে গিয়েছে, কংগ্রেস একটানা এক মাসের বেশি কোনও কর্মসূচি নিতে পারেনি। শেষ দীর্ঘ কর্মসূচি, রাজীব গান্ধীর ‘ভারত যাত্রা’। ইন্দিরা, রাজীব ‘চিন্তন’ করে ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। সংগঠনে মুখ বদলেও নয়। তাঁদের পথে নামতে হয়েছিল। তা-ও তাঁদের সামনে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের মতো প্রতিপক্ষ ছিলেন না। রাহুলকে কী করতে হবে, সেই রাস্তা তাঁর পূর্বসূিররাই দেখিয়ে গিয়েছেন। ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তা খুঁজতে চিন্তন শিবির করে ভাবের ঘরে চুরির প্রয়োজন নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy