অসহায়: নিউটাউনে চিট ফান্ড সংক্রান্ত অভিযোগের নিষ্পত্তি কেন্দ্রের সামনে, ৮ মে, ২০১৩
জনৈক অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসের দিন বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। কোথাও কোথাও পতাকা উত্তোলনও করতে হয় তাঁকে। এই বছর সেই রকমই একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে এক উদ্যোক্তা তাঁকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো’ গানটি গাওয়া হলে কোনও অসুবিধে নেই তো? আমাদের মাস্টারমশাই খানিকটা অবাক হয়ে তাকালে পরে প্রশ্নকর্তা গলা আর একটু নামিয়ে বলেন যে, গানটি যে-হেতু চুরির দায়ে জেলে থাকা মন্ত্রীর আপন মামা শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা, তাই স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে এই বিষয়টা নিয়ে আয়োজকদের মধ্যে একটু দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে।
মাস্টারমশাই একা কেন, আরও অনেকেই নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন যে, ভাগ্নের জাল-জালিয়াতির দায় মামার লেখা দেশাত্মবোধক গানে ছায়া ফেলতে পারে না। কিন্তু ভাগ্নের দুষ্কর্মের দায়ও কি পড়তে পারে মামার উপর? কেউ ভাবতেই পারেন যে, গানটা যদি অধুনা জেলবন্দি ভাগ্নেই লিখে থাকত, তা হলেও কি গাইতে লজ্জা করার কথা কারও? সূর্যের আলো নর্দমায় পড়লে সূর্য নোংরা হয় না তো! সৃষ্টি তবে স্রষ্টাতে লিপ্ত হবে কী করে?
নির্লিপ্ত থেকে যেতে চাওয়া বহু মানুষ যে-কোনও ঘটনার বিচার সেরে ফেলতে চান পলকে। মিডিয়া ট্রায়াল আর সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রোলিং’-এর দৌলতে সে কাজ আজ খানিক সহজও হয়েছে বটে। সমাজকে পাল্টাতে গেলে যে আজীবন বনের না-খেয়ে ঘরের মোষকে খাইয়ে যেতে হয়, সেই বোধ আজ আশা করাই বাতুলতা, এখন লগ-ইন আর লগ-আউট’এর যুগ, যত ক্ষণ ধান্দা তত ক্ষণই বান্দা। সরকারে টুইডল-ডি থাক কিংবা টুইডল-ডম, অবস্থা বিশেষ বদলায় না, কারণ মেগাসিটির দশ তলা কিংবা শহরতলির দোতলায় থাকা কারও পক্ষে বোঝা সম্ভবই হয় না, বস্তিবাসী যে লোকটি বৌ-মেয়ের স্নানের জায়গা ঘিরে দেওয়ার অ্যাসবেস্টস পেয়েছে সে দাতার চরিত্র কিংবা চৌর্যবৃত্তি দেখে না, প্রাপ্ত উপকারের নিক্তিতে লোকটিকে বিচার করে। অতএব, ‘এই রকম দুর্বৃত্তকেও মানুষ ভোটে জেতায়?’ বলে নাক সিঁটকানো সহজ, কিন্তু নিজের বিত্তের সামান্যতম অংশ হদ্দ গরিবের জন্য খরচ করা কঠিন। ‘শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের/ কি যেন হয় গঙ্গারামের’ যুক্তিজাল বিস্তার করে যারা নিজেদের ঝোলা ভরে নেওয়ায় বিশ্বাসী, তারা ভেবেও তল পাবে না কী ভাবে গ্রামের মুদি দোকানে জবকার্ড থাকা লোকটি দু’শো সর্ষের তেল কিংবা এক কিলো আটা ধারে কিনতে পারে, আর যার কার্ড নেই সে পারে না। বৃহৎ পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না কেন বলে তাকে দুষে লাভ নেই, মালদহ-বীরভূম-বাঁকুড়া-মেদিনীপুরের গ্রামে শ্যাম্পুর বোতল নয়, পাউচ বিক্রি হয়। বড় মাপের কিছুই যে পায়নি জীবনে, বড় করে ভাবতে না পারাটা তার লজ্জা হতে পারে না।
গালিভারকে দেখে মানুষ বলে ভাবার ক্ষমতা ছিল না লিলিপুটদের। তাদের যাপনের সমবায় যে আয়নার জন্ম দিয়েছিল সেখানে গালিভার কেবলই এক লেভয়াথান। অনুরূপ দৃশ্য মাঝেমাঝে দেখা যায় আমাদের টিভি-স্ক্রিনেও। অকারণে খুন হয়ে যাওয়া কিশোর কিংবা কিশোরীদের, শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বাবা-মায়েদের একই রকম মুখগুলো ভিন্ন-ভিন্ন নামে প্রায়শই ভেসে ওঠে সেখানে আর বুম ধরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের সামনে তাঁদের কেউ কেউ বলে ফেলেন, “সিপিএমের বাবুরা এসেছিলেন, বিজেপির বাবুরা এসেছিলেন, তৃণমূলের বাবুরা এসেছিলেন।” পার্টির নাম আলাদা হলেও প্রত্যেকটি পার্টিই ‘বাবু’খচিত, যাঁরা আসবেন, সাহস দেবেন, তার পর আবার পরিস্থিতির পাঁকে ফেলে রেখে পথের ধুলো উড়িয়ে বিদায় নেবেন। এ-বার যারা পড়ে থাকবে, তাদের স্থানীয় মুশকিল-আসানের কাছে যেতেই হবে, যে-ভাবে পিতৃঘাতকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল বীরভূমের হৃদয়বাবুর মতো অনেককে। ক্ষমতার মাথায় চড়ে বসা লোকগুলোর মাথায় যখনই অক্সিজেন কম যেতে শুরু করে, তখনই তারা চার পাশের মানুষের লজ্জা, হায়া শুষে প্রশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে; যে ভাবে দ্রৌপদীর শাড়ি ছিনিয়ে নিয়ে দুর্যোধন, দুঃশাসন নিজেদের ক্ষমতা-স্তম্ভ আর অসহ্য দম্ভের অনন্ত নগ্নতাকে ঢাকার চেষ্টা করেছিল। লজ্জা তখন দ্রৌপদীর ছিল, এখন হাথরস কিংবা হাঁসখালির মেয়েটার আছে। পল ভালেরির কথায়, “পাওয়ার উইদাউট অ্যাবিউজ় লুজ়েস ইটস চার্ম।”
সেই ক্ষমতার নির্লজ্জ অপব্যবহার কি কেবল রাজনীতির আঙিনায় থাকা মানুষরাই করেন? বহু মানুষের মৃত্যুর এবং আরও বহু মানুষের সর্বস্বান্ত হওয়ার কারণ যে চিটফান্ড, তার সংবাদপত্রের থেকে চোদ্দো-ষোলো লাখ মাসমাইনে নেওয়ার অপরাধে যদি সাংবাদিক তথা রাজনীতিক সাড়ে তিন বছর জেল খেটে থাকেন, তবে সেই সংস্থা থেকে মাস গেলে দশ-বারো লাখ টাকা মাইনে পাওয়া বরেণ্য অভিনেত্রী তথা পরিচালককেও তো জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত তদন্তকারী সংস্থার। নইলে ‘জাস্টিস’ বলে কিছু থাকে কি! মানুষ মারা চিটফান্ড থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে সিনেমা বানানো পরিচালক এক জন তরুণ সাংবাদিককে শাসক দলের মুখপত্রে চাকরি করতে কেন লজ্জা করে না, জানতে চান শাসানির ঢঙে। আনাজওয়ালা কিংবা অটোচালকের সর্বস্ব লুট করা টাকা নিয়ে যখন তিনি ‘অ্যাকশন’ কিংবা ‘কাট’ বলেছিলেন, তখন তাঁর নিজের লজ্জা করেনি? নেত্রীকে নিয়ে যখন সিনেমা বানান তখন তাঁর সঙ্গে ও ভাবে কথা বলেন? তরুণ সাংবাদিক খেটে-খাওয়া মানুষ বলে যা খুশি শুনতে বাধ্য?
পনেরো বছর আগের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ক্লাসরুমের একটা সার্ভে যদি করা যায়, দেখা যাবে যে জীবনবিজ্ঞান হোক বা বাংলা, প্রতিটা বিষয়ের একটি ব্যাচের অন্তত পনেরো জন সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে পড়ায়, পাঁচ জন সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজে। গত পাঁচ বছরকে ভিত্তি ধরে সেই একই সার্ভে করা গেলে নজরে আসবে, প্রতিটি বিষয়ের ক্লাসের এক থেকে তিন জন সরকারি চাকরি পেয়েছে গড়ে। এ রকম ব্যাচও আছে যার এক জনও পায়নি। কোথায় যাবে তারা? চাকরি না পাওয়ার লজ্জায় আত্মহনন করবে? যে সব সেলেব্রিটিদের অটোগ্রাফ নেয় ওরা, তাঁরা লজ্জিত হবেন না এক বারও? শঙ্খ ঘোষের ‘বাবুদের লজ্জা হল’ কি আপ্তবাক্য হয়েই থেকে যাবে? কবিতাকে ছুটি দিয়ে ক্ষুধার রাজ্যে চোখ মেললে, ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছেলে-মেয়েরা আট হাজার, দশ হাজার টাকা মাইনেয় কন্টেন্ট রাইটিং, প্রুফ-রিডিং’এর কাজ করছে; সেই সময় কেউ চাকরি পেলে বিচার হবে প্রতিষ্ঠানটির ঝোঁক কোন দিকে? সম্ভব তার পক্ষে?
সমর্থন যে যাকে খুশি করতে পারে, সেটা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অধিকার। কিন্তু উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীরা যখন রাস্তায় শুয়ে আছে, তখন সরকারি বাড়ি-গাড়ি ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করছেন যাঁরা, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলোয় আর এক বার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন, “…লোকমান্য টিলক… আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলেন, আমাকে য়ুরোপে যেতে হবে। সে সময়ে নন-কো-অপারেশন আরম্ভ হয়নি বটে কিন্তু পোলিটিকাল আন্দোলনের তুফান বইছে। আমি বললাম, ‘রাষ্ট্রিক আন্দোলনের কাজে যোগ দিয়ে আমি য়ুরোপে যেতে পারব না’। তিনি বলে পাঠালেন, আমি রাষ্ট্রিক চর্চায় থাকি, এ তাঁর অভিপ্রায়-বিরুদ্ধ। ভারতবর্ষের যে বাণী আমি প্রচার করতে পারি সেই বাণী বহন করাই আমার পক্ষে সত্য কাজ, এবং সেই সত্য কাজের দ্বারাই আমি ভারতের সত্য সেবা করতে পারি। আমি জানতুম, জনসাধারণ টিলককে পোলিটিকাল নেতারূপেই বরণ করেছিল এবং সেই কাজেই তাঁকে টাকা দিয়েছিল। এইজন্য আমি তাঁর পঞ্চাশ হাজার টাকা গ্রহণ করতে পারিনি।”
“টাকা থাকলেই দেওয়া যায় না আর টাকা দিলেই নেওয়া যায় না” গুরু তো বলেন, কিন্তু চ্যালায় শোনে কই? দক্ষিণ শহরতলির ভাল ক্রিকেট খেলা একটি ছেলেকে পুলিশ লক-আপ’এ পিটিয়ে মেরে দিয়েছে তাই নিয়ে পথ অবরোধ চলছে। সেই অবরোধ ফাঁকি দিয়ে রিকশা করে গন্তব্যে যাওয়ার পথে সওয়ারি, রিকশাচালকের মুখে শুনলেন, “খুব অন্যায় হয়েছে। কিন্তু যে অফিসার মেরেছে বলে শুনতিছি সে গেল শীতে আমায় একটা সোয়েটার দেছল।”
শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গান, ‘মানুষ মানুষের জন্য’ শুনে অনেকে বলেন, গানের শেষে উনি কেন লিখলেন না, ‘যদি মানুষ কখনও বা হয় দানব’? সুবিধে হত তবে। রিকশায় বসে সে দিনের সওয়ারির কিন্তু মনে হল, একতরফা বিচারের পরিসর নেই আর পৃথিবীতে, প্রতিটি দানব কোনও না কোনও মানবিক কাজ করে গেছে। কে জানে, ইচ্ছে করেই হয়তো শেষ লাইনটা ওপেন-এন্ডেড রেখেছিলেন শিবদাসবাবু। মানুষ দানব হয়ে যাবে এটাই তো সমস্যা নয় কেবল, “যদি দানব কখনও বা হয় মানুষ,/ লজ্জা কি তুমি পাবে না/ ও বন্ধু?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy