Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
New Education Policy

রাষ্ট্রের কাছে কবি বিপজ্জনক

দেশকে ভালবেসে যুদ্ধে গিয়েছেন কবিরাও— সক্রেটিস থেকে সিগফ্রিড সাসুন।

আবির্ভাব ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২১ ০৫:২০
Share: Save:

নয়া শিক্ষানীতি ২০২০-র অধীনে ‘মেন্টরিং যুব’ প্রকল্পের মাধ্যমে ‘প্রাইম মিনিস্টার্স স্কিম ফর মেন্টরিং ইয়ং অথর্স’ শিরোনামে তরুণদের লেখক সত্তাকে প্রকাশের সুযোগ দিতে সারা দেশ থেকে ৭৫ জনকে বেছে নেওয়া হবে। এ জন্য সারা দেশে ত্রিশ বছরের কমবয়সিদের থেকে অসমিয়া, বাংলা, মালয়ালম, মরাঠি, মণিপুরি, নেপালি, ওড়িয়া, পঞ্জাবি, সংস্কৃত, সিন্ধি, তামিল, তেলুগু-সহ ২২টি ভাষার যে কোনওটিতে অনধিক পাঁচ হাজার শব্দের পাণ্ডুলিপি আহ্বান করা হয়েছে। ইংরেজি বা হিন্দি ছাড়া অন্যান্য ভাষায় পাণ্ডুলিপি পাঠালে সঙ্গে ইংরেজি বা হিন্দিতে সারমর্ম পাঠাতে হবে। যথাবিহিত পদ্ধতি মেনে ৭৫ জন মনোনীত হবেন, কর্মশালা ও বই প্রকাশের ব্যবস্থা করা হবে। প্রতি মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে ছ’মাসের বৃত্তিও ঘোষণা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হিসেবে বলা আছে: তরুণ লেখক ও বিশ্বের লেখকদের সঙ্গে এই নবীনদের পরিচয় ঘটানো, তাদের ‘আন্তর্জাতিক নাগরিক’-এর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, ‘বিশ্ব গুরু’ হিসেবে ‘এক ভারত শ্রেষ্ঠ ভারত’-এর সফল ও সার্থক উত্থান ঘটানো।

পাঠানো যাবে ফিকশন, নন-ফিকশন, ভ্রমণ, স্মৃতিকথা, নাটক ইত্যাদি। একটু নীচের দিকে পাওয়া যায় প্রশ্নমালা। বিজ্ঞপ্তি পড়ে মনে হতে পারে, এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর এই অংশে আগে থেকে সাজিয়ে রাখা। প্রশ্নমালার উনিশ নম্বর প্রশ্নটি হল, “কবিতা কি গ্রহণ করা হবে?” উত্তর: না, হবে না। কেন হবে না? কবিতা কি মৌলিক সাহিত্যকর্ম নয়? না কি, কবিতা সবচেয়ে অবহেলিত সাহিত্যকর্ম? কবির সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না? না কি, কবি ঠিক ততখানি জাতীয়তাবাদী নন? অথচ, কবিতা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরনো ফর্ম। বাংলা হোক বা গ্রিক, কবিতাই ভাষার আদি নিদর্শন। যদিও পৃথিবীতে প্রথম কবিতা ভারতে বা গ্রিসে লেখা হয়নি। এই পর্যন্ত আবিষ্কৃত পৃথিবীর প্রথম কবিতাটি—‘গিলগামেশ’ মহাকাব্য— লেখা হয়েছিল মেসোপটেমিয়া সভ্যতায়। একটি ভাষা তার যাবতীয় সম্ভ্রম, পথ চলার ইতিহাস সঞ্চয় করে রাখে তার কবিতায়। বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র আয়োজিত এক আড্ডায় দীপেশ চক্রবর্তী বলেছিলেন, একটি জাতিকে বুঝতে গেলে তার ভাষাকে বুঝতে হবে, একটি ভাষাকে বুঝতে গেলে বুঝতে হবে সেই ভাষার কবিত্ব, কারণ একটি ভাষা সর্বাধিক পরিশ্রম করে তার কবিতায়।

সরকারের এই আয়োজনের থিমগুলির মধ্যে অন্যতম জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের অনাবিষ্কৃত স্থান ও নায়ক। সমস্যা হল, একই দেশ প্রতিটি ভাষায় এক-এক রকম। বাঙালির জাতীয়তাবাদে দেশ ‘বঙ্গমাতা’, ‘ভারতমাতা’। মরাঠি জাতীয়তাবাদে দেশ ‘পিতৃভূমি’। তবে কি এতগুলি ভারতীয় ভাষার আলাদা আলাদা সঞ্চয় প্রকাশ্যে এলে ‘মোনোলিথিক ন্যাশনালিজ়ম’ তৈরিতে সমস্যা হবে ভেবেই ইচ্ছে করে কবিতাকে ব্রাত্য করে রাখা? হ্যাঁ, সমস্যা হওয়ারই কথা। কবি চিরকাল সত্যের, ন্যায়ের পক্ষ নিয়েছেন। তুলে এনেছেন বহুত্ব, বহুমত; প্রাধান্য দিয়েছেন ‘ভিন্ন রুচির অধিকার’কে। কবি আনখশির এক বিপজ্জনক অস্তিত্ব, রাষ্ট্র যাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারে না। উদ্যোক্তারা মনে হয় এই প্রশ্ন-উত্তর সাজিয়ে রেখে তা এক প্রকার মেনে নিয়েছেন। গার্সিয়া লোরকা থেকে অ্যালেন গিন্সবার্গ, সবাই নিজেদের সময়ে বিপজ্জনক, পরে আরও বিপজ্জনক। সমাজ-প্রচলিত নৈতিকতার আদিকল্পে তাঁদের খাপ খাওয়ানো যায় না। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ শাসকের সয় না। তাঁর সমকালেও তিনি বিরুদ্ধমত— স্বদেশি আন্দোলন যখন হিংসার আকার নিচ্ছে, সকলের আবেগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিপরীত অবস্থান নিচ্ছেন।

তবে কি কবিরা কম জাতীয়তাবাদী? দেশকে ভালবেসে যুদ্ধে গিয়েছেন কবিরাও— সক্রেটিস থেকে সিগফ্রিড সাসুন। সক্রেটিস তিন বার আথেন্স ছেড়ে যান, যুদ্ধের জন্যই। স্পার্টার কাছে পরাজয়ের কারণে আথেন্সে যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত পদস্থ ব্যক্তিদের শাস্তিপ্রদানের বিরুদ্ধে সওয়াল করায়, আথেন্সের যুবাদের ‘মস্তিষ্ক চর্বণ’-এর অভিযোগে, বিচারে তাঁর প্রাণদণ্ড হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পর্যন্ত এক মাস সময় পেয়েছিলেন, এই সময় তিনি দেবী আথেনার স্বপ্নাদেশ পান ও জীবনের অবশিষ্ট সময় কবিতা রচনা করেন। অ্যারিস্টটল কবিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তাঁকে নিখুঁত ভাবে দেখতে হবে, কোনও অসঙ্গতি যেন তাঁর দৃষ্টি না এড়ায়। অসঙ্গতি দৃষ্টি এড়ায় না বলেই কবি ‘শাসকের প্রতি’ চোখে চোখ রাখতে পারেন তাঁর লেখায়। কিছু দিন পরেই প্রায়-উন্মাদ এক শাসক ক্ষমতায় আসীন হবেন জেনেও, এক কবিই পারেন প্রবাসে বসে স্পষ্ট প্রতিবাদ কবিতায় লিখে তা প্রকাশ করতে, মধ্যরাতের কবিতাপাঠের আসরে অন্য কবি বন্ধুরাই পারেন তাঁকে সেই কবিতা পড়ে শোনানোর আবদার জানাতে। কবি সব দেখেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বার বার বলেন বিরুদ্ধ তথা ভিন্নমত সহ্য করার কথা, গণতন্ত্রে যা মূল সুর। তাঁর নিঃশব্দ কলমে প্রতিবাদ ঘোষিত হয় বলেই হয়তো ক্ষমতাকে মাইক্রোফোন হাতে তীব্র স্বরে বলতে হয়, “কে এই কবি? আমরা তো এর নাম শুনিনি!”

অন্য বিষয়গুলি:

poet New Education Policy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy