সোমবার নিউ টাউনে বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টারে শুরু হল তিন দিনের জি২০ বৈঠক। ছবি: পিটিআই।
এ এক অদ্ভুত সমাপতন। ১৯৯৭ সালে এশিয়ার আর্থিক বাজারের বুদবুদ ফেটে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি টলে যায়। সমস্যার শুরু হয় তাইল্যান্ড থেকে। বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার শূন্য হয়ে যাওয়ায় তাইল্যান্ডের টাকা (যাকে বাহট বা আমাদের উচ্চারণে ভাট বলে) ধসে যায়। তাইল্যান্ড থেকে বাণিজ্য গোটাতে শুরু করে বিদেশি সংস্থারা আর কেঁপে যায় বিশ্বের বাজার। এশিয়া জুড়ে এর প্রভাবে মন্দা ঘনিয়ে আসে। ইন্দোনেশিয়ায় বন্ধ হয়ে যায় একাধিক সংস্থা। কোরিয়ার প্রায় সব সংস্থা সঙ্কটে পড়ে যায়। এতটাই যে, ১৯৯৮ থেকে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও কোরিয়ার ডেয়ুর মতো বড় সংস্থাও ১৯৯৯ সালে দেউলিয়া হয়ে যায়।
ঢেউ আছড়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গেও। সমস্যায় পড়ে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের ভগীরথ বলে অভিহিত হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসও। বিনিয়োগের যে অংশটি বাজারে শেয়ার বেচে আসার কথা ছিল, বাজার তলানিতে থাকায় প্রকল্প নির্মাণে সেই রাস্তায় হাঁটতে পারেনি সংস্থাটি। আরও ঋণের রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হওয়ায়, উত্তরকালে তার একটা বড় মূল্য চোকাতে হয়েছিল এই সংস্থাটিকে।
আর সেই ১৯৯৯ সালেই শুরু জি২০ গোষ্ঠীর যাত্রা। যে গোষ্ঠীর শুরুই হয়েছিল ১৯৯৭ সালে এশিয়ার সেই মহা আর্থিক সঙ্কটের প্রেক্ষাপটেই। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্যই ছিল আর্থিক বাজারে এই ধরনের সঙ্কট এড়াতে আন্তর্জাতিক স্তরে সহযোগিতার মাধ্যমে মোকাবিলার রাস্তা তৈরি করা। প্রাথমিক ভাবে জি৭ গোষ্ঠী ছিল এর আঁতুড়। কিন্তু পরে ১৯টি রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের যোগদানে এর পরিসর বাড়ে। এবং বাড়ে গুরুত্বও। অর্থমন্ত্রীদের মঞ্চ থেকে আজ এর গুরুত্ব বেড়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের মঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়ে এখন পরিবেশও এর অংশ হয়ে উঠেছে। এর বৈঠকগুলি ঘুরেফিরে বিভিন্ন সদস্য দেশের পৌরহিত্যে হয়। এই বছর পৌরহিত্যের দায় পড়েছে ভারতের উপর।
সোমবার কলকাতাতেই শুরু হয়েছে সহযোগিতার প্রথম বৈঠক। বিষয়, সংগঠিত অর্থবাজারকে সর্বজনীন করার কৌশল বা ফিনান্সিয়াল ইনক্লুসন। এ-ও এক অদ্ভুত সমাপতন। আজ যে ডিজিটাল প্রযুক্তির উপর ভর করে বিশ্বের প্রতিটি নাগরিককে সংগঠিত অর্থবাজারের অংশীদার করে তোলার আলোচনা হচ্ছে, সেই প্রযুক্তির পিছনেও কিন্তু কলকাতার একটা বড় অবদান রয়েছে। কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের তিন গবেষক-শিক্ষকের গবেষণার ফল বিসিএইচ কোড। যার উপর ভিত্তি করেই ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ গড়ে উঠেছে। আমরা অনেকেই জানি না মোবাইল যোগাযোগ ব্যবস্থায় কলকাতার এই অবদানের কথা।
মাথায় রাখতে হবে যে, দেশে আজ প্রায় ৮০ শতাংশ নাগরিকের কাছে সংগঠিত আর্থিক বাজার পৌঁছে গিয়েছে বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দাবি, আমাদের সেই দেশে কিন্তু চলতি শতাব্দীর গোড়াতেও এই অনুপাত ৩০ শতাংশের একটু উপরে ছিল। দেশের একটা বড় অংশের নাগরিকই বলি হতেন সুদখোর অসংগঠিত কুসীদজীবীদের হাতে। আর এর অন্যতম কারণই ছিল প্রথাগত ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার সমস্যা। প্রথাগত ব্যবস্থার অন্যতম সমস্যা ছিল গ্রাহককে ব্যাঙ্কের কাছে আসার শর্ত। সেই সময়কার প্রযুক্তি অনুযায়ী এ ছাড়া অন্য বিশেষ উপায় ছিল না। ব্যাঙ্কের শাখা প্রত্যন্ত গ্রামে খোলারও সমস্যা ছিল। তাই ব্যাঙ্কের সুবিধা নিতে হলে বহু মানুষকেই দিনের কাজ ফেলে ব্যাঙ্কের সময় অনুযায়ী হাজির হতে হত নিকটস্থ শাখায়।আর এই কারণেই সংগঠিত ঋণ-বাজারের সুযোগ হারিয়ে সুদখোরদের কাছে চিরকালীন দেনায় ডুবে থাকতে হত সাধারণ মানুষকে।
উন্নয়নের এই চ্যালেঞ্জ যে শুধু আমাদেরই ছিল তা নয়। গোটা অনুন্নত দুনিয়াই ভুগত এই সমস্যায়। এই সমস্যা সমাধানের প্রথম আলো দেখা যায় আফ্রিকায়। মোবাইলকেই হাতিয়ার করে টাকা লেনদেনের উপায় হিসাবে আসে এমপেসা ওয়ালেট। আর এই রাস্তাতে কী ভাবে হাঁটা যায়, সংগঠিত ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে কী ভাবে মোবাইল ফোনকে ধরে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে যায়।
ভারতও পিছিয়ে না থেকে ভাবতে শুরু করে, এই রাস্তায় হেঁটে কী ভাবে মোবাইল নির্ভর লেনদেন চালু করা যায়। এই শতকের গোড়ার দশকেই এই ভাবনা থেকে আধার এবং ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস বা ইউপিআই-এর জন্ম। আজ যা আমাদের মুঠোয়। একটা বড় অংশের কাছে নগদ টাকার বদলে ফোন থেকেই বাজার করে টাকা মেটানোর অন্যতম উপায়। ব্যাঙ্কের শাখায় পা না রেখেও ব্যাঙ্কের কাজ সারার মাধ্যমও হয়ে উঠেছে সেই মোবাইল ফোনই। যা চলছে কলকাতাতেই উদ্ভাবিত সেই বিসিএইচ কোডের উপর নির্ভর করেই।
মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা হল ব্যাঙ্ক যেখানেই থাকুক না কেন, আপনার মোবাইলের সঙ্গে এর যোগাযোগ থাকলেই আপনি তার সুবিধা নিতে পারছেন। আর এই সুবিধার সুযোগ নিয়ে আর্থিক বাজার ব্যবহার করার নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে। এখন তো মোবাইল ফোন ব্যবহার করে শুধু ব্যাঙ্কের কাজই নয়, আমরা চাইলে শেয়ার বাজারেও লেনদেন করতে পারছি। এসে গিয়েছে ই-টাকাও। পকেটে আর কিছুদিনের মধ্যে নোট রাখারও প্রয়োজন পড়বে না। পাড়ার দোকানদারকেও দিনের শেষে নোট গুছিয়ে নিয়ে তা চোরের হাত থেকে বাঁচাতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে না।
কিন্তু প্রযুক্তি থাকলেই হবে না। প্রযুক্তির সঙ্গে পা মিলিয়ে নীতিরও পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রথাগত ব্যাঙ্কিং যে ভাবে পরিচালিত হত, আজ মোবাইল নির্ভর ডিজিটাল ব্যাঙ্কিং সেই নীতি মেনেই চলতে পারে না। তার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন নতুন নীতির। নতুন নীতি-ব্যবস্থার। আর ভারতের পৌরহিত্যে এ বার জি২০ গোষ্ঠী যে সব বিষয়ে আলোচনা করবে, তার মধ্যে অন্যতম হবে বিশ্বের ডিজিটাল একাত্মতার নীতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy