যাত্রী: গঙ্গাসাগরে যাওয়ার পথে বাবুঘাটে বিশ্রাম। পিটিআই
একুশ শতকের বাঙালি যে কতটা অসহায়, সেটা বোঝা যায় গঙ্গাসাগরের সঙ্গে কুম্ভমেলার তুলনা দেখলে। একাধিক বার হরিদ্বার, প্রয়াগ, উজ্জয়িনী এবং গঙ্গাসাগরে রিপোর্টিং করতে গিয়ে বুঝেছি, আকার-আয়তন-জনতার ভিড়ে দুইয়ের কোনও তুলনাই হয় না। সাগর যদি এতটুকু সূচ্যগ্র তিল হয়, কুম্ভ সুবিশাল এক তাল। সাগরের মূল আকর্ষণ মোহনার স্রোতে স্নান করে কপিলমুনির মন্দিরের দিকে হাঁটা। বালিয়াড়ি পেরিয়ে ওই রাস্তাটুকুতেই প্লাস্টিকের খেলনা, অ্যালুমিনিয়ামের বাসন-কোসন, ঝিনুকের গয়নার সম্ভার। রাজ্য পর্যটনের ওয়েবসাইটে পরিষ্কার লেখা, সাগরদ্বীপের আয়তন প্রায় ২২৪ কিমি। কিন্তু মেলার আয়তন কত? পুরো দ্বীপ জুড়ে তো মেলা হয় না, সেখানে মায়া গোয়ালিনির ঘাট থেকে রোজ পান, আনাজ-বোঝাই লঞ্চ মেদিনীপুরের দিকে রওনা হয়। প্রয়াগে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমে মেলাস্থানের আয়তন আর অধুনা প্রয়াগরাজ (সাবেক ইলাহাবাদ) শহরের আয়তন এক? হরিদ্বারে মেলাটা হয় গঙ্গার মূল স্রোত নীলধারার পাশে। শহর থেকে দূরে সেখানেই আখড়ার সন্ন্যাসীরা তাঁবু ফেলেন।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রয়াগরাজ শহরের মাপ ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার। সাত-আটটা সেক্টরে বিভক্ত কুম্ভমেলার মাপ প্রায় ২০ বর্গকিলোমিটার। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির হিসাব, নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যানহাটান অঞ্চলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের সমান এলাকা জুড়ে তাঁবুনগরী, সেখানেই বিস্ময়! গঙ্গাসাগরে এ রকম তাঁবুনগরী হয় না, লোকে স্নান সেরে মন্দির দেখে ভেসেলে চেপে বাড়ি ফিরে যায়। তিন দশক আগের থেকে এখন সাগরদ্বীপের অবস্থা বেশ উন্নত। পরিষ্কার রাস্তা, মোবাইল-সংযোগ ও সারা দিনমান বিদ্যুৎ। কিছু আশ্রমের পাশাপাশি বেসরকারি হোটেল ও লজ। কারণটা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে রাজ্য পর্যটন দফতর— গঙ্গাসাগর সুন্দর পর্যটনস্থল। তীর্থযাত্রী ও অভিযানপ্রিয় সব ভ্রমণার্থীর কাছে সমান আকর্ষণীয়। উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশ— কেউই তাদের কুম্ভস্নানকে এ ভাবে বিপণন করে না। দেবতাদের অমৃতকলস এখানেই উপচে গিয়েছিল জাতীয় পুরাকথার বয়ানটিই সব। এখানে পর্যটন দফতরই দ্বিধায়, সাগরদ্বীপ পর্যটন-স্থল, না তীর্থস্থল?
আক্ষরিক অর্থেই গঙ্গাসাগর তীর্থ নয়, কারণ সেখানে নদীর ঘাট নেই। স্রোতস্বিনী গঙ্গা ২৫১০ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে সমুদ্রে মিশেছে। অথচ, তীর্থ মানে জলের ঘাট। যে জায়গা দিয়ে আমি এ পার থেকে অন্য পারে, এই তুচ্ছ, নশ্বর জীবন থেকে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য পুণ্য জীবনে পৌঁছব, সেটাই তীর্থ। সেই পুণ্য কি আর মন্দিরে গেলে হয়? হিন্দুধর্মে বৈষ্ণব, শাক্ত, সৌর, গাণপত্য অজস্র সম্প্রদায় আছে, প্রত্যেকের উপাস্য এবং মন্দির ভিন্ন। কিন্তু এই ধর্মই আবার বিশ্বাস করে, দেবালয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্নান এবং দানেও সমান পুণ্য। একই তীর্থ বা ঘাটে ব্রাহ্মণ থেকে অন্ত্যজ সকলেই পুণ্যলগ্নে স্নান করে ইষ্টদেবতার আশীর্বাদ লাভ করতে পারে। তাই কুম্ভমেলায় হরিদ্বারে গঙ্গায়, প্রয়াগে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমে, উজ্জয়িনীতে শিপ্রা নদীতে, নাশিকে গোদাবরী নদীতে স্নান করতে হয়। গঙ্গা থেকে গোদাবরী সব নদীই যে সাগরে মেশে, প্রাচীন কাল থেকে লোকে জানে। যা স্বাভাবিক, তা নিয়ে আর ধানাইপানাই কেন? সুতরাং, এই ভারতে গোদাবরী থেকে তাপ্তী— কোনও নদী-মোহনাই হয়নি তীর্থ। তা হলে গঙ্গাসাগর ব্যতিক্রম হবে কী ভাবে?
আসল কথা, কুম্ভে স্নানটাই সব। এমনি দিনে স্নান করতে পারেন, করতে পারেন সাধু-আখড়াগুলির শাহি স্নানের দিনেও। স্নান ছাড়া দেবদেবী সবই তুচ্ছ। তাই হরিদ্বার কুম্ভে কেউ আপনাকে চণ্ডী পাহাড়ে মা চণ্ডী বা প্রয়াগে বিষ্ণুমন্দির, অক্ষয়বট সন্দর্শনে যেতে ঝুলোঝুলি করবে না। উজ্জয়িনীতে স্নানে গেলেও মহাকাল মন্দিরে যাওয়া, না-যাওয়া আপনার ইচ্ছা। যেখানে স্নান সেরে কপিলমুনির মন্দিরে পুজো দিতে যেতে হয়, ঐতিহ্যসম্মত ভাবেই সেটি কুম্ভমেলার সমতুল হতে পারে না। এক দিকে কুম্ভমেলার সঙ্গে তুলনা টেনে সাগরকে জাতীয় মেলার দাবি জানাব, আর এক দিকে সেখানে ঝুলনের মতো নকল তারকেশ্বর, কালীঘাট, জহুরা কালীমন্দির তৈরি করব— শুধু বৈপরীত্যে ভরা নয়, একই সঙ্গে দুদু ও তামাকু খাওয়ার মতো হাস্যকর।
আর, সব কুম্ভই এক নাকি? থাকবন্দি হিন্দু সমাজে চারটি কুম্ভ-শহর সমান মর্যাদা পায়নি। নাশিক এবং উজ্জয়িনীর কুম্ভকে বলা হয়, সিংহস্থ। সূর্য কুম্ভ রাশিতে ঢুকলে নয়, সিংহ রাশিতে ঢুকলে ওই স্নান। মুখ্যত বর্ষাকালে হয় বলে সাধুরা এই দুই মেলাকে অনেক সময় ‘পচা কুম্ভ’ও বলেন। কেন্দ্রের অর্থসাহায্যও সব মেলায় নয় সমান। প্রয়াগ কুম্ভে অর্থসাহায্যের পরিমাণ সিংহস্থ মেলার চেয়ে অনেক বেশি। কারণটা সহজ। হরিদ্বার, উজ্জয়িনী, নাশিক তিন জায়গাতেই শহর আছে। লোকের ভিড় সামাল দিতে মেলা সেই শহরের পরিকাঠামো ব্যবহার করতে পারে। প্রয়াগে সে সব কিছু নেই। নদীর ধারের ধু ধু বালুচরে গড়ে তুলতে হয় বিদ্যুৎসজ্জিত তাঁবুনগরী। সেখানে থানা, হাসপাতাল, দমকল থেকে পয়ঃপ্রণালী, পানীয় জল সবই মজুত। মেলা শেষে নগরীর মৃত্যু, ফের বালুচর। সাংবাদিকেরা কুম্ভমেলা কভার করতে করতেই মেলা-কর্তৃপক্ষের দেওয়া পুস্তিকায় দেখে নেন, এ বার এত কিমি বিদ্যুতের লাইন পাতা হয়েছে। জলের লাইন একত্র জুড়লে দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে অত কিমি।
অসহায় বাঙালি অবশ্য বলতে পারে, সাগরমেলা তো চার দিকে জলবেষ্টিত একটা দ্বীপের মেলা। কিন্তু ওতে চিঁড়ে ভিজবে না। সাগরদ্বীপে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের বাস, থানা থেকে ব্লক অফিস সব কিছু রয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, কুম্ভে শাহি স্নান বলে কয়েকটি তিথি থাকে। সে সব দিনে প্রশাসন তটস্থ, আখড়াগুলির শাহি স্নান যে! মহানির্বাণী, জুনা, নিরঞ্জনীর মতো শৈব এবং রামানন্দী, নির্মোহীর মতো বৈষ্ণব আখড়া আসবে স্নানে। এই শৈব-বৈষ্ণব আখড়াগুলির মধ্যে একদা প্রায় অহি-নকুল সম্পর্ক ছিল। এখনও কুম্ভে এই শৈব আর বৈষ্ণব আখড়াগুলির মধ্যে বেশ ব্যবধান রাখা হয়। কপিলমুনির মন্দিরের মোহন্ত সাধু জ্ঞানদাস একদা সর্বভারতীয় আখড়া পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তিনি জানেন, কে আগে স্নান করবে, তা নিয়ে আখড়া পরিষদের সভায় কী রকম ধুন্ধুমার বাধে! কুম্ভমেলা মানে, শৈব ও বৈষ্ণব আখড়ার শাহি স্নান। গঙ্গাসাগরে এ রকম কোনও তিথি নেই। সেখানে মকরসংক্রান্তির স্নানটিই সব। হরিদ্বার কুম্ভে মকরসংক্রান্তিতে শাহি স্নান থাকে। কিন্তু সাগরে কপিলমুনির মোহন্তরা বৈষ্ণবরামানন্দী আখড়ার। হরিদ্বার, প্রয়াগরাজের শৈব আখড়াগুলি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে স্নান করতে আসবে কোন দুঃখে?
এই রামানন্দী আখড়ার সদর দফতর অযোধ্যায়। রামমন্দির আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন এঁরাই। আজও গঙ্গাসাগরে তীর্থযাত্রীদের দেওয়া প্রণামী, দানের সবটুকুই তাঁরা অযোধ্যার সদর দফতরে পাঠিয়ে দেন। বঙ্গের ভাগ্যে ছিটেফোঁটাও জোটে না। কুম্ভমেলার গল্প কিন্তু অন্য। হরিদ্বার কুম্ভে এক বার বিষ্ণুঘাট থেকে নদীর ও পারে গেলাম সেনাবাহিনীর পাতা, অস্থায়ী পন্টুন ব্রিজে। বারো বছর বাদে আর এক কুম্ভে দেখি, সেখানে যান চলাচলের পাকা সেতু ও রাস্তা। কেন্দ্রীয় সাহায্যের পন্টুন ব্রিজ যেন ছিল খসড়া, পরে একই জায়গায় পাকা সেতুর পূর্ণতা। হরিদ্বার ও প্রয়াগ কুম্ভে অনেক সময় লাইন দিয়ে প্রচুর লোক মুণ্ডিতমস্তক হন। কুম্ভমেলাতেই তাঁরা নাগা সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য দীক্ষা নেন। সাগরে কিছু নাগা সন্ন্যাসী আসেন ঠিকই, কিন্তু সেখানে হয় না কোনও সন্ন্যাসদীক্ষা। শাহি স্নানের পর কুম্ভেই হয় আখড়াগুলির ভোট। কে হবেন মোহন্ত বা প্রধান, কে হবেন কারবারি বা কোষাধ্যক্ষ, সে সব স্থির হয় ভোটে। গঙ্গাসাগর এ বিষয়ে তুশ্চু। বারংবার কুম্ভের সঙ্গে সাগরমেলার তুলনা টেনে পশ্চিমবঙ্গ বোধ হয় নিজেকেই হাস্যাস্পদ করছে। সোজা কথায়, মুখ্যমন্ত্রী সাগরমেলার জন্য কেন্দ্রের কাছে বারংবার যে অর্থসাহায্যের দাবি জানাচ্ছেন, তাতে অযোধ্যায় রামমন্দিরের স্রষ্টা রামানন্দী আখড়ার উপকার হতে পারে। কিন্তু মুড়িগঙ্গার অতলে তলিয়ে যাওয়া লোহাচরা, ক্রমশ সলিলসমাধিতে চলে যাওয়া ঘোড়ামারা বা খোদ সাগরদ্বীপের কী উপকার হবে, তা স্বয়ং কপিলমুনিও জানেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy