এ বছর চারিদিকে যখন আলোচনা চলছে উৎসবে ফেরা উচিত না কি উচিত নয়; যখন চুলচেরা বিশ্লেষণের ভিড় জমছে আনাচে-কানাচে, ‘উৎসব আর পুজো কি এক নাকি?’; যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এই স্বর যে, উৎসবের প্রতিটি দিন হয়ে উঠুক আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদের পরিসর, ন্যায়বিচার দাবির মঞ্চ— তখন একটি ছোট কথা আমরা প্রায়শই ভুলে থাকি। হয়তো সে আমাদের কাছে এতটাই স্বাভাবিক, এত সহজলভ্য যে, আলাদা ভাবে ‘প্রিভিলেজ’-এর তকমা এঁটে তাকে দেখার কথা মনে পড়ে না আমাদের। বিষয়টি এটুকুই যে, যাঁদের বর্তমান দিনকাল এই রকম আলোচনা বা তর্কে ব্যাপৃত, তাঁদের কাছে উৎসবে ফেরার বা না-ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগটুকু অন্তত আছে। সেই অধিকারে বলীয়ান হয়ে আমরা বলতে পারি যে, ‘এ উৎসব আমার নয়’ অথবা ‘ফিরলেই বা কী’। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, আমাদের এই বৃত্তের বাইরে আছেন এমন অসংখ্য মানুষ, যাঁদের উৎসবে ফেরার পথটি বন্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের মতো, তাঁদের ইচ্ছার তোয়াক্কা না করেই।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনার কেন্দ্রে যে নির্যাতিতা ডাক্তার, তাঁদের বাড়িতে শেষ কয়েক বছর দুর্গাপুজো হত। মা আর মেয়েতে মিলে উমাকে ঘরে আনা থেকে বিদায় দেওয়া— সব কাজেই যুক্ত থাকতেন পুরোদমে। ‘অভয়া’র চলে যাওয়ায় সে বাড়ির এখন কেমন অবস্থা পুজোর আগে? উৎসবে তাঁরা ফিরছেন না, ঠিক কথা। কিন্তু আমাদের না-ফেরা ও তাঁদের না-ফেরায় ফারাক অনেকটা। ‘উৎসব’-এর উপলক্ষকে কেন্দ্র করে আমরা সচেতন ভাবে বিচার করে সেই আলো-ঝকমকে উদ্যাপনে শামিল না-হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছি যেখানে, সেখানে অভয়ার পরিবারের কাছে আলোয় না-ফেরার সিদ্ধান্তটুকু নেওয়ার মতো স্বাধীনতাও অবশিষ্ট রাখেনি জীবনের এই আকস্মিক অন্ধকার। যে সন্তানের সঙ্গে গত বছরেও তাঁরা হাতে হাতে এগিয়েছেন পুজোর কাজ, আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আত্মীয়বন্ধুদের বাড়ির উৎসবে, আলোয় সাজিয়েছেন ঘরদালান, এ বছর তাঁর নৃশংস হত্যা সেই পরিবারের আকাশে অন্ধকার প্রতিষ্ঠা করেছে নিরঙ্কুশ। উৎসবের আলো সে বাড়িতে কোনও দিন আসতে পারে কি না, এ প্রশ্নই এখন অবান্তর।
এমন ভাবে জীবনের কিছু আলোর অমোঘ নিবে যাওয়া কেবল অভয়ার পরিবারের জন্যই সত্য নয়। খুঁজলে দেখা যাবে, নিয়তির অসংবেদনশীল, আগ্রাসী পীড়নে জন্ম নিয়েছে একদল ‘অমল’। গভীর বিষাদ, অবসাদ তাঁদের নিত্যসঙ্গী। অসুখী সেই মুখগুলো বন্দি হয়ে গেছে চিরতরে জানলার গরাদের এ পারে। দূর থেকে ভেসে আসা উৎসবের আলো-শব্দ যেন সেই সব অমলের কাছে দইওয়ালার ডাক। বাইরের খবর ইশারা-ইঙ্গিতে এসে পৌঁছয়। এক সময় বাইরের এই উৎসবে শামিল হওয়ার অধিকার তাঁদের ছিল পুরোমাত্রায়। কিন্তু আজ? যে সন্তানকে কেন্দ্র করে উৎসব এসেছিল তাঁদের কারও বাড়িতে, আজ হয়তো সে আর নেই। হয়তো এমনই কোনও দুর্গাষষ্ঠীর দিন তাঁদের কারও বাড়ির ছোট ছেলেটি জলে ডুবে গিয়েছিল মশগুল হয়ে খেলার মাঝে। হয়তো বা কেউ দীর্ঘ কয়েকমাস খেটে-খাওয়া চাকরির শেষে পুজোয় বাড়ি ফিরবেন বলে জানানোয় পাড়ার ছোট্ট ক্লাবঘরটা আলোয় সেজে ওঠার আগেই খুশির বিচ্ছুরিত বিভায় আলোকময় হয়ে উঠেছিল তাঁর বাবা-মায়ের মন। তবু, পঞ্চমীর দিন ফেরার পথে একটা পথ-দুর্ঘটনা, এবং এক মুহূর্তে সব নিকষ অন্ধকার। সেই থেকে এই বাড়িগুলোর বাইরে কেউ আলোর মালা ঝুলিয়ে দিলেও ভিতরের মিশকালো মনগুলো আর আলোয় ফিরতে পারে না। ডাকঘর-এর অমলের মতোই তাঁদের বুকে ভর করে থাকে অনিঃশেষ এক দুঃখী হয়ে-থাকার অসুখ।
১৯৪২ সালে নাৎসি সৈন্যরা যখন পোল্যান্ড থেকে প্রায় দু’শোটি অনাথ শিশুকে ইহুদি হওয়ার ‘অপরাধে’ নিয়ে আসে ট্রেব্লিঙ্কা ক্যাম্পে, সেই কচিকাঁচাদের পিছু ছাড়েননি তাঁদের অভিভাবক জানুস করজ্যাক, নিজে পালানোর সুযোগ পেয়েও। বন্দিদশায় যখন সেই শিশুরা প্রায় কিছু না জেনে-বুঝেই দিন কাটাচ্ছে গ্যাস চেম্বারে ঢোকার অপেক্ষায়, করজ্যাক তাদের পড়ে শুনিয়েছিলেন ডাকঘর-এর অনুবাদ; ওই ক্যাম্পেই নিজেদের মধ্যে বারকয়েক তারা নাটকটি অভিনয়ও করেছিল, শোনা যায়। করজ্যাক সেই প্রতিটি শিশুর মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন এক-এক জন অমলকে, যে অবরুদ্ধ— মৃত্যুর সম্মুখীন। গ্যাস চেম্বারের চার দেওয়ালের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তেও যেন জীবনের প্রতি, মানুষের প্রতি বিশ্বাস না হারায় এই শিশুরা, তা নিশ্চিত করতে করজ্যাক তাদের বলেছিলেন, গ্যাস চেম্বারের ঘুম ভেঙে তারা দেখবে এক নতুন পৃথিবীতে বেঁচে আছে সকলেই; সেখানে আঘাত নেই, ক্ষয় নেই। অমলের রাজার সঙ্গে মিলিত হওয়ায় নিহিত যে উত্তরণ, তাকে করজ্যাক ব্যবহার করেছিলেন সেই নৃশংস ক্যাম্পে তাঁর সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে।
শিশুরা নাহয় মেনে নেয়। মৃত্যুর মুখে, অনিবার্য পরিণতি জেনে, অমল হওয়া হয়তো কিছুটা সহজও। কিন্তু মৃত্যু-আঘাতে জর্জরিত যে-মানুষ ‘অমল’ হয়ে ওঠেন, অথচ যাঁকে আলিঙ্গন করে নিষ্কৃতি দেয় না স্বয়ং মৃত্যুও, তাঁর পরিত্রাণ কিসে? পৃথিবীতে, মানুষের নাতিদীর্ঘ ইতিহাসে ছোট-বড় ঢেউ ওঠে মৃত্যুর। জনসংখ্যার যত বড় বৃত্তই রচিত হোক না কেন মৃত্যু দ্বারা, তারও বাইরে উদ্বৃত্ত মানুষদের জন্য উৎসব ঠিকই থাকে। উদ্যাপনে না-ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে তাঁরা, আমরা স্বাধীন; বা হয়তো এমন অকালমৃত্যুর হাতছানি আজও সরাসরি আমাদের ঘরে এসে পড়েনি বলেই উদ্যাপনের দুরন্ত ঢেউয়ের কাছে নতিস্বীকার করতে আমরা বাধ্য। কিন্তু আজকের ‘অমল’দের জীবন সেই পথটি একেবারে মুছে দিয়ে, কর্কশ যে আগামী উপহার দেয় তাঁদের, তার ব্যাখ্যা কি আমরা দূরাগতরা দিতে পারব?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy