Advertisement
২৭ অক্টোবর ২০২৪
Israel-Iran War

‘এই ধ্বংসের দায়ভাগে’

পোশাক থেকে শুরু করে দৈনন্দিন ব্যবহারের নানা পণ্যদ্রব্য নিয়মিত সরবরাহ করা হয় প্যালেস্টাইনে। এবং এ সবই হয় সরকারি মদতে।

সমর্থক: আম্মানে লেবানন আর গাজ়ার প্রতি সমর্থনে জড়ো হয়েছেন প্রততিবাদীরা।

সমর্থক: আম্মানে লেবানন আর গাজ়ার প্রতি সমর্থনে জড়ো হয়েছেন প্রততিবাদীরা। ২৭ সেপ্টেম্বর, জর্ডন। ছবি রয়টার্স।

রোহণ কুদ্দস
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:০৯
Share: Save:

পয়লা অক্টোবর রাতে জর্ডনের রাজধানী আম্মানের আকাশে হঠাৎ আতশবাজির সমারোহ। দেখা গেল, মাথার উপর দিয়ে ছুটে চলেছে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, সাধারণ মানুষ পথে নেমে এসেছেন। কেউ কেউ ছাদে উঠে হাত নাড়ছেন উল্কার মতো ধেয়ে যাওয়া মিসাইলের দিকে। তত ক্ষণে নিউজ় চ্যানেলগুলোতেও আপডেট আসা শুরু হয়েছে— তেহরান ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-টু’ শুরু করেছে। আকাশপথে ধেয়ে চলা মিসাইল আর ড্রোনের লক্ষ্য ইজ়রায়েল। চার দিকে খুশির আবহ। গত এক বছর ধরে ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতে জর্ডনের সাধারণ মানুষের চাপা অসন্তোষ কিছুটা হলেও কমল। পর দিন সকালেই সবাইকেই কাজে ছুটতে হবে। তবু কফিশপে, দোকানে, মোড়ের মাথায় মানুষের জটলা অনেক রাতেও। সকলের মুখেই চাপা আনন্দ। হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার হয়ে চলেছে মিসাইল ছুটে যাওয়ার ভিডিয়ো। কেউ অন্তত জবাব দিল ইজ়রায়েলকে।

গত বছর অক্টোবরে ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘাতের শুরুতেই আম্মান এবং জর্ডনের অন্য ছোট শহরগুলোতে ইজ়রায়েলকে সাহায্য করে এমন দেশের (মূলত আমেরিকা) পণ্য বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মানুষজন। অন্তত ত্রিশ লক্ষ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুর বাস জর্ডনে— তাঁরা এ দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২৭%। তাঁরা জর্ডনে এসেছেন গত সাত-আট দশক ধরে। একটা বড় অংশই দেশান্তরি ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম। রাজধানীর বুকে কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস, স্টারবাক্‌স-এর মতো বাণিজ্য-দৈত্যরা জনশূন্য দোকান খুলে বসে আছে মাসের পর মাস। বড় বড় শপিং মলেও পশ্চিম এশিয়ার বা স্থানীয় ব্র্যান্ডের দিকেই মানুষের নজর। ফলে, সফট-ড্রিঙ্ক হোক বা ফাস্ট ফুড, জর্ডনের নিজস্ব পণ্য দারুণ ভাবে বাজার দখল করছে। খাবার অর্ডার দেওয়ার জনপ্রিয় অ্যাপ ‘তালাবাত’ গাজ়াতে ত্রাণ পাঠানোর নানা প্যাকেজের ব্যবস্থা করেছে। খাবার, পোশাক থেকে শুরু করে দৈনন্দিন ব্যবহারের নানা পণ্যদ্রব্য নিয়মিত সরবরাহ করা হয় প্যালেস্টাইনে। এবং এ সবই হয় সরকারি মদতে। প্যালেস্টাইনকে সাহায্য করার কথা প্রকাশ্যেই নানা প্রস্তাবনায় ঘোষণা করেছে জর্ডন সরকার।

কিন্তু, মাথার উপর দিয়ে হাউইয়ের মতো মিসাইল নাহয় উড়ে গেল, তারবাজির ফুলকি এল কোথা থেকে! হোয়াটসঅ্যাপে শেয়ার হওয়া ভিডিয়ো বা নিউজ় চ্যানেলে দেখানো ক্লিপিংসে দেখা যাচ্ছে, মাঝ-আকাশে বহু মিসাইল সেই রাতে ধ্বংস হয়েছিল। পর দিন অর্থাৎ দোসরা অক্টোবর জর্ডন সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল, রয়্যাল জর্ডানিয়ান এয়ারফোর্স এবং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম জর্ডনের আকাশসীমায় ঢুকে হানা দেওয়া বহু মিসাইল এবং ড্রোনকে নষ্ট করেছে। সরকারি মুখপাত্র জানালেন, জর্ডনের অবস্থান পরিষ্কার এবং স্থায়ী— কোনও পক্ষের কোনও সংঘাতের ক্ষেত্র নয় এই দেশ। জর্ডনের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জর্ডনের নাগরিকদের সুরক্ষাই সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব।

কান পাতলেই অবশ্য প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে— পক্ষ যদি না-ই নেওয়া হচ্ছে, তা হলে তেল আভিভের দিকে লক্ষ্য করে ছোড়া মিসাইল ধ্বংস করার কারণ কী? জর্ডনকে লক্ষ্য করে তো কেউ কোনও মিসাইল ছোড়েনি। তা হলে যে লড়াই জর্ডনের নয়, সেটাতে জোর করে অংশগ্রহণ করা কেন! মানুষের করের টাকা নষ্ট করে আগ বাড়িয়ে আর কারও অস্ত্রের সামনে বুক পেতে দেওয়া কেন? ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র যদি জর্ডনের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করে, তা হলে ইরানের উপরে বোমা ফেলতে যাওয়া ইজ়রায়েলি আর আমেরিকান যুদ্ধবিমান জর্ডনের আকাশসীমা ব্যবহার করে কোন যুক্তিতে! সরকার এখনও এ সব প্রশ্নের কোনও জবাব দেয়নি।

যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁরা দু’টি তথ্য সামনে আনছেন। এক, ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত মৌ চুক্তি অনুসারে সাত বছরে ১০.১৫ বিলিয়ন ডলার আমেরিকার তরফে অর্থনৈতিক সাহায্য হিসাবে জর্ডনকে দেওয়া হবে; দুই, ২০১৬-য় স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ইজ়রায়েল জর্ডনকে ১৫ বছর ধরে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করবে। সরকারের সমর্থনকারীরা অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ১৯৯৪-এ আমেরিকার মধ্যস্থতায় জর্ডনের রাজা হুসেন এবং ইজ়রায়েলের ইতঝাক রবিনের মধ্যে যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেই চুক্তির অন্যতম অঙ্গীকারই ছিল যে, এই দুই দেশের কেউই তৃতীয় কোনও শক্তির জন্য তাঁদের দেশকে মহড়াক্ষেত্র হিসাবে উন্মুক্ত করবেন না।

আম্মানে বিতর্ক চলছে। ইজ়রায়েলি দূতাবাসের সামনে চলছে প্রতিবাদও। দারাত আল ফুনুন আর্ট গ্যালারিতে চলছে গাজ়ার শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী। কিন্তু তাতেও খুশি নন বুদ্ধিজীবীদের একাংশ। তাঁদের মতে, এ সবই সরকারের তরফে ‘সেফটি ভাল্‌ভ’। নিজেদের বিবেকের কাছে সৎ থাকার প্রয়াস মাত্র। আসলে কোনও পরিবর্তনই হচ্ছে না। প্যালেস্টাইন নামক একটি দেশকে পরিকল্পিত ভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে হতাশা ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার নেই।

পয়লা অক্টোবর রাতে যখন ইজ়রায়েলের দিকে হামলা শুরু হল, তখন উল্লসিত জনতার ভিড়ে শঙ্কিত মুখও ছিল বইকি। ইরানের মিসাইলের লক্ষ্য ইজ়রায়েল, জর্ডন নয়। সেই কারণে খুশি হওয়ার, বিতর্কে যোগ দেওয়ার, প্রতিবাদ করার ফুরসত পাচ্ছেন জর্ডনের নাগরিক। কিন্তু জর্ডনের রাজধানীতেই বাস করছেন, এমন অনেক মানুষের জন্যেই ইজ়রায়েলকে লক্ষ্য করে পাঠানো ক্ষেপণাস্ত্র দুঃসংবাদ বয়ে এনেছে। যেমন, ডেভিড। গত তিন বছর ধরে জর্ডনে আছেন কর্মসূত্রে। একটি সফটওয়্যার সংস্থায় চাকরি করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, বাড়ি তাঁর লেবাননে— বাবা-মা আত্মীয়স্বজন সকলেই সে দেশে। আকাশে আলোর রোশনাই। বিকট শব্দে ফেটে পড়ছে মিসাইল। নীচে একই মাত্রায় সহর্ষ চিৎকার করে উঠছেন মানুষ। তা হলে ডেভিড চিন্তান্বিত কেন? “এর পর লেবাননের উপরে আক্রমণ আরও জোরদার হবে।” ডেভিডের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেই এখন প্রায় দৈনিক আক্রমণ চলছে লেবাননে। প্যালেস্টাইনের মতোই সেখানেও লক্ষ্য সন্ত্রাসবাদীরা। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের বাসা বাঁচছে কোথায়? গৃহহারা মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

যেমন, আমিন। তিনি জানালেন, লেবানন ছেড়ে আম্মানে আছেন বছর ছয়েক। প্রথমে সালোঁর ব্যবসা, তার পর লন্ড্রির। তাঁর বাবা ঠিক করেছিলেন, তাঁদের দুই ভাইকে লেবানন থেকে অন্যত্র পাঠাবেন। আমিনের ছোট ভাই লেখাপড়া করেছেন ভারতের পুণেতে, এখন চাকরি করেন সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে। আমিন নিজে সে ভাবে লেখাপড়া করতে পারেননি— এখন দিনে বারো থেকে চোদ্দো ঘণ্টা পরিশ্রম করেন। তাঁর স্ত্রীও সাহায্য করেন সংসারের কাজ সামলে যতটুকু ফুরসত পান। তাঁদের একমাত্র সন্তান মহম্মদ পড়ে ক্লাস ফাইভে। আমিন চান তাঁর ভাইয়ের মতোই তাঁর ছেলেও এক দিন ভারতে পড়তে যাবে। তাঁর কাছে ভারত এক স্বপ্নের দেশ, সম্ভাবনার দেশ।

“লেবাননে থাকলে হয় মরবে, না হলে মারবে।” ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলে আমিন, “হিজ়বুল্লাতে কেউ এমনি এমনি নাম লেখায় না। যুদ্ধ আর হামলায় ছোটবেলায় কেউ বাবাকে হারিয়েছে, কেউ মাকে। কেউ পরিবারের প্রায় সবাইকেই। তাদের সামনে কোনও ভবিষ্যৎ নেই। কী করবে তারা! অস্ত্র তুলে নেয়।” এই চক্র থেকে বাঁচার একটাই উপায়— দেশ ছেড়ে পালাও। তা হলে যাঁরা লেবাননে থেকে গেলেন? “ঈশ্বর তাদের সহায় হোন।” আমিন অসহায় গলায় বলেন, “অসাড় হয়ে গেছে তারা। ভয়ডর শেষ হয়ে গেছে।” ডেভিড বা আমিনের মতো যাঁরা লেবানন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন ভাগ্যান্বেষণে, ক্ষেপণাস্ত্রের উৎসবে ফেটে পড়া দেখে তাঁরা আতঙ্কিত হন— স্বদেশে তাঁরা প্রিয়জনদের ছেড়ে এসেছেন। জর্ডনের নিরাপদ এবং স্থিতিশীল পরিবেশও তাঁদের চিন্তামুক্ত করতে পারেনি।

মানবঘাতী, শিশুঘাতী এই সংগ্রামে কিসের বিনিময়ে জয় চাইছে যুযুধান পক্ষগুলো? দীর্ঘ দিন রাষ্ট্রপুঞ্জের সংস্থায় চাকরি করা আম্মানের এক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রৌঢ়— নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক— ত্রাণ নিয়ে গাজ়ায় গিয়েছিলেন। ফেরার পর নিজেকে বাড়িতেই বন্দি রেখেছিলেন। কারও সঙ্গে কথা বিশেষ বলতেন না। সপ্তাহ তিনেক লেগেছিল স্বাভাবিক হতে। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে মাঝেমাঝেই চুপ করে যাচ্ছিলেন। দীর্ঘ বিরতি নিয়ে আবার কথা বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছিলেন। “তোমায় একটা ছবি কল্পনা করতে বলছি। ভাবো, বৃষ্টি হচ্ছে। তাঁবুর মধ্যে পশুর মতো গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছে কিছু মানুষ। আর এক দল মানুষের মাথার উপরে কোনও ছাউনি নেই। তারা খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ভিজছে। তার মধ্যেই দেখো বাবার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটা মেয়ে। তার মাথার উপরে বাবা দু’হাত মেলে ধরে বৃষ্টি আটকানোর চেষ্টা করছে। আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে।”

অন্য বিষয়গুলি:

Jordan Eye Witness gaza
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE