আধো তন্দ্রায় বুঝতে পারছিলাম, আমার মেয়ে হয়ে সবাই নজর রাখছেন ওঁরা। প্রতীকী ছবি
হাসপাতালে স্বর্গসুখ। এই লেখার এমন শিরোনাম হতেই পারত। কিন্তু না। তা হলে আপনারা পড়বেন কেন? আচ্ছা, আপনাদের কারও কখনও এমন হয়েছে, যে আকাশ ভাঙা বৃষ্টির সময় একটা ছাতা এনে মাথায় ধরেছে কেউ? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয় তবে পড়ে দেখবেন আমার এই নরক ভেবে স্বর্গে যাওয়ার কাহিনি।
সুগার, প্রেসার, ট্রাইগ্লিসারাইড, হাই কোলেস্টেরল। এরা সকলেই আমার নিত্যসঙ্গী। এ সবের সঙ্গে যখন করোনাও এল তখন কেমন আর কতটা ভয় পেয়েছিলাম সেটা সারাজীবন মনে থাকার কথা। কিন্তু নেই। আমায় ভুলিয়ে দিয়েছে অন্য অভিজ্ঞতা। অসুখ নিয়ে ঠিক যতটা ভয় ছিল তার চেয়েও বেশি ছিল সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে সেটা শোনার আতঙ্ক। বেলেঘাটা আইডি নামটা শুনলেই এতকাল ভয় পেয়ে এসেছি। আর এখন সেই হাসপাতালের কথাই জনে জনে বলতে ইচ্ছে করছে।
হাসপাতালে ভর্তি করতেই হবে জানার পরে আমার ছেলে প্রথমেই ওখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। বাড়ি থেকে অনেকটা পথ। অক্সিজেন সিলিন্ডার-সহ অ্যাম্বুল্যান্স-এ যখন উঠলাম তখন ভাবিনি আজ এটা লিখতে পারব। বেঁচেই ফিরব না ভেবেছিলাম। সুস্থ হওয়ার ভাবনা তো ছিলই না, বরং বাঁচার আশাও করিনি। কিন্তু যা পেয়েছি সেটাই অনেক বললে কম বলা হবে। আসলে যা পেয়েছি সেটা ‘অনেক’ শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার মতো নয়। ধারণা ছিল, হাসপাতালে তো কেউ ছোঁবেও না। কেউ তেষ্টার জলটুকুও এগিয়ে দেবে না। বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা তো দূরের কথা, ফোনে কথা বলাও যাবে না। বিনা চিকিৎসা, বিনা পরিষেবায় সেখানেই হয়তো শেষ হয়ে যাব, করোনায় মৃত্যু মানে দেহটাও তো পরিজনেরা পাবে না। শারীরিক কষ্টের মধ্যেই শিউরে শিউরে উঠেছিলাম ভবিতব্যের কথা ভেবে। কিন্তু কিছু করারও নেই। সত্যি বলছি, বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার সময় মনে মনে সবাইকে শেষ বিদায় জানিয়েছিলাম।
মধ্য রাতে গাড়িটা হাসপাতালে গিয়ে দাঁড়াল। বুঝতে পারছি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে সুন্দর বাগানের পাশ দিয়ে গাড়িটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। অসুখের ঘোরে নয় তো! এ কোথায় এলাম! এ কি গল্পে পড়া কোনও সুসজ্জিত বাগান বাড়ি! নাকি কোনও মন্দির? অক্সিজেনের নল সামলেই বুঝতে পারলাম, স্বপ্ন নয়, সত্যি। এটাই বেলেঘাটা আই ডি হাসপাতাল।
ছেলের হাত ধরে বহু কষ্টে নামলাম গাড়ি থেকে। এখানেই ছেলেকে বিদায় জানাতে হল। তখন অনেক দূরে বাইকে চড়ে আসছে আর এক ছেলে রিন্টু, জামাই বরুণ। দেখা হল না ওদের সঙ্গে। হবে তো! ভাবনার মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্সের কাছে একটি ছেলে এগিয়ে এল হুইল চেয়ার নিয়ে। সযত্নে চেয়ারটি ঠেলে ঠেলে লিফটে তুললো। বিছানা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে ধরাধরি করে বেডে বসিয়ে দিয়ে সিস্টারকে সব বুঝিয়ে দিয়ে তবে বিদায় নিল। যাওয়ার আগে বলল, “মা,আমি আসি।” ওই ডাকটায় কেমন যেন বাড়তি সাহস পেলাম। মনে আশা এল, সেবাযত্ন তা হলে পাবো। একটু একটু করে আমার দুঃস্বপ্ন ভাঙা শুরু হল। দেখলাম, সুন্দর গোছানো বিছানা, নতুন বেডকভার, সুন্দর কভার দেওয়া বালিশ, কম্বল আর নরম তুলতুলে সাদা একটা তোয়ালে। তাইই নয়, সঙ্গে নতুন চিরুনি, ব্রাশ, টুথ পেস্ট, সুগন্ধী সাবান, চারটে নতুন জলভর্তি বোতোল আর নতুন পোশাক। তখনও আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন। কিন্তু ছুঁয়ে ছুঁয়ে সব দেখলাম। তার পরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমোতে ঘুমোতে দেখলাম সরকারি হাসপাতাল নিয়ে নাক উঁচু আমার পাশে সিস্টাররা। অক্সিমিটার, প্রেসার মাপার যন্ত্র ইত্যাদি সব এনে বেডেই পরীক্ষা করে সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন লাগিয়ে দিল নাকে। আধো জ্ঞান, আধো তন্দ্রায় বুঝতে পারছিলাম, আমার মেয়ে হয়ে সবাই নজর রাখছেন ওঁরা। আমার বেশ মনে আছে, ডাক্তারবাবু এলেন, প্রতিটি আঙুল থেকে রক্ত নিলেন। বাড়িতে কী কী ওষুধ খেতে হয় জেনে প্রেস্ক্রিপশনের একটা ছবিও তুলে নিলেন নিজের মোবাইল ফোনে। রোজ তিনবার করে ডাক্তার আসতেন, খবরাখবর নিতেন।
প্রথম দিন ডাক্তার দেখে যাওয়ার পরেই এল গরম জল, চা, বিস্কুট। টিফিন রোজই প্রায় এক রকম। চার পিস পাউরুটি, এক গ্লাস গরম দুধ, একটা পাকা কলা, একটা আপেল আর একটা সিদ্ধ ডিম। টিফিনের পর এল সুন্দর করে কাগজে মোড়ানো ওষুধ, তাতে আমার নাম আর বেড নম্বর লেখা। দুপুরে রোজ দিত ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ অথবা মাংস আর টক দই। ভাত না খেতে পারলে স্যুপ দিত। কিন্তু সবচেয়ে বড় পাওনাটা হয়ে উঠেছিল, ‘মা’ সম্বোধনটা। সত্যি বলছি, ওটা শুনব বলে, কতদিন খাবার নিয়ে বায়না করেছি। বাড়িতে তো শুনতেই পাই, তবু হাসপাতালে ‘মা, খেয়ে নাও’ শোনার লোভটা সামলাতে পারতাম না।
প্রথম তিনটে দিন তো আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। রাত না দিন বুঝতামই না। এই তিন দিন ঠিক মতো খাওয়াও হয়নি। বিছানাতে শুইয়েই ইসিজি, এক্সরে করার ব্যবস্থা হয়েছিল। টয়লেটটা ছিল কিছুটা দূরে। একটু একটু করে যখন যাওয়ার চেষ্টা করতাম, তখন মনে হত, আমি সেই ছোট্টটা হয়ে গেছি। টলোমলো পায়ে একটু একটু করে হাঁটতে শিখছি। প্রতিবেশী রোগী বন্ধুরা অভয় দিতেন, “এই তো আমরা আছি”, “কোনও ভয় নেই” ইত্যাদি বলে। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার কথা ভেবে যেখানে গিয়েছিলাম, সেখানেই যেন নতুন করে জীবনকে খুঁজে পেলাম। অচেনা, অজানা জীবনসঙ্গীদেরও। হয়তো কদিনের জন্য, আর কখনও দেখাও হবে না, কিন্তু এটুকুই বা কম কী!
সকাল, দুপুরের খাওয়ার কথা তো আগেই বলেছি। বিকেলে রোজ চা আর বিস্কুট বাঁধা। আর রাতে রুটি অথবা ভাতের সঙ্গে ডাল, তরকার, আর ডিম। রাত ১১টায় দিত গরম জল আর রাতের ওষুধ। তারপর দেখতাম, এক সময়ে ছোটবেলার জীবনে ফিরে যেতাম। আধো তন্ত্রায় শুনতে পেতাম, শাসনের কড়া গলায় আদর মিশিয়ে মা যেন বলেছেন, “ঘুমিয়ে পড়ো।”
আমি এখন সুস্থ। করোনাকে হারিয়ে আরও অনেকের মতোই বাড়ি ফিরে এসেছি। কিন্তু কেন এত কথা বললাম? কেই বা শুনতে চেয়েছে আমার হাসপাতাল যাপনের বেত্তান্ত! বললাম, একটা গ্লানি দূর করতে। সরকারি হাসপাতালের নাম শুনলেই যাঁরা নাক সেঁটকান আমিও তাঁদের দলে ছিলাম। এই তো সে দিন পর্যন্ত। আজ অন্য আমি। করোনা অনেক কেড়েছে আমরাও। কিন্তু দিয়ে গেল অন্য এক ভালবাসা। হাসপাতাল মানেই ঘেন্না নয়। গন্ধ নয়, দুর্বব্যবহার নয়, চিকিৎসায় গাফিলতি নয়। হয় তো সবার অভিজ্ঞতা এক হয় না। কিন্তু আমরা এই একলা অভিজ্ঞতার মূল্যও তো কম নয়। আমি তো কোনও ভিভিআইপি হিসেবে যাইনি। আমার সঙ্গে আরও যাঁরা ছিলেন ওই ওয়ার্ডে তাঁরাও কেউ মামা, দাদার চিরকুট নিয়ে যাননি। আসলে ধারণা আর বাস্তবের মাঝে অনেকটা ফারাক থাকে। সেই ফারাকের মধ্যে জমে থাকে শ্যাওলা। আমি সেই শ্যাওলা একটু ঘসে দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
এই প্রথম যেন সুস্থ হতে মন খারাপ হল। একদিন সকালের টিফিন খাওয়ার পর জানতে পারলাম, আমায় ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে। বলা হল, যদি বাড়ি থেকে কোনও কারণে কেউ নিতে আসতে না পারে, তবুও আমি সে দিন রাতে সব রকম পরিষেবা-সহ থাকতে পারবো। পরের দিন, দরকার হলে, হাসপাতালই অ্যাম্বুল্যান্সে করে বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। না, তার দরকার হয়নি। বাড়ি যেতে পারব শুনে আপনজনদের টানটা ফিরে এল এক লহমায়। কিন্তু তত ক্ষণে আমার যে আরও আপনজন তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই হুইল চেয়ার ঠেলে লিফটে তুলেছিল যে, সেও তো আমর ছেলে। রোজ জ্বর মাপত, আমায় খাবর দিত ওরাও তো আমর মেয়ে, আমার আপন। রোজ “ঘুমিয়ে পড়ো” বলা ভারী গলার মানুষটাও তো আমার স্বজন।
আমি রাঁধতে গিয়ে খাবার নুন বেশি দিয়ে ফেলি। আমার অন্যমনস্ক হাত পুড়িয়ে ফেলে তরকারি। ফ্রিজের দরজা ঠিক মতো লাগাতে ভুলে যাই। আমার স্বজনরা আছেন ওই বেলেঘাটা আইডিতে। আরও অনেক জায়গায়। দোহাই আপনাদের, একটু কিছু ভুল করলে ওঁদের গায়ে হাত তুলবেন না। ঘরে সন্তান, পরিজন রেখে এসে আমাদের যত্ন নেয়। করোনা হলেও আমাদের যত্ন নেন। অচ্ছুৎ করেন না। ওঁরাই আমার ঠাকুর। ওঁরা সব্বার।
(লেখিকা একজন গৃহবধূ। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy