ভগিনী নিবেদিতা।
বাঙালি এক অদ্ভুত জাতি, নিজের ঐতিহ্য ইতিহাস সংস্কৃতির চর্চা নিজে থেকে করবে না, ঠেলে দিলে করবে। ঠেলা নানাবিধ, তার প্রথম ও সহজতমটি— শতবর্ষ সার্ধশতবর্ষ ইত্যাদি কালস্মারকচিহ্ন। রামমোহন বিদ্যাসাগর রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ আদি সকলেই একুশ শতকের গ্লোবাল বাঙালির কাছে ওই ভাবে আসেন, কেউ কেউ সমসময়ের প্রেক্ষাপটে একটু বেশি, বাকিরা প্রয়োজন মতো কম বা ন্যূনতম।
উনিশ ও বিশ শতকে বঙ্গ ও ভারতসমাজমন মন্থন করেছেন, এমন মহামনাদের সাম্প্রতিক চর্চা-প্রবণতায় ভগিনী নিবেদিতাকে উপেক্ষিতাই বলতে হয়। এ কালের বঙ্গচিন্তকরাও সে ভাবে এই মানুষটিকে পড়েছেন বলে মনে হয় না, অন্তত তার লিখিত বা দৃশ্যমান প্রমাণ গোচর হয় না তত। নিবেদিতাকে নিয়ে প্রামাণ্য কাজ বলতে ফিরতে হয় শঙ্করীপ্রসাদ বসু বা প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা প্রমুখের লেখাপত্রে, এ ছাড়া এই সময়ে লিখে চলেছেন এমন কয়েক জনই ভরসা। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না— বিশেষত মানুষটি যখন খুব পুরনো নন, জন্মের দেড়শো পেরিয়েছে মাত্র ক’বছর আগে, এবং তারও বড় কথা: আমরা যাকে ‘প্রাইমারি টেক্সট’ বলি, নিবেদিতার নিজের লেখাপত্তরের সিংহভাগ— বই, বক্তৃতা, বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা ও বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধ, গ্রন্থভূমিকা এবং অবশ্যই চিঠি— যখন দু’মলাটে পাওয়া যায় হাতের কাছেই এবং মূলের ইংরেজিতেই, কিছু অংশ সুন্দর বঙ্গানুবাদেও। নিবেদিতা-পাঠে একটা আপাত-অন্তরায় হতে পারে তাঁর অত্যুচ্চমার্গীয় সাহেবি ইংরেজি, এমনই তার শব্দ ও বাক্যবিন্যাস যে আম-পাঠককে বিব্রত করতে পারে, বিশেষত তাঁর বন্ধু ও গুরু স্বামী বিবেকানন্দের আশ্চর্য প্রাঞ্জল ইংরেজির সঙ্গে তুল্যমূল্য বিবেচনায় তো আরওই। এইটুকু গতিরোধককে সসম্মানে স্বীকার করলে সামনে খুলে যায় মননের এক অতুলন বিস্ময়সরণি। এক বার সাহস করে সেই পথের পথিক হলে অনুমান করা যায় এই মানুষটির গভীরতা ও উচ্চতা।
সিরিয়াস চর্চাকারীদের একটু সরিয়ে রেখে যদি প্রশ্ন করি, নিবেদিতা সম্পর্কে আম-বাঙালির স্বাভাবিক জানা-বোঝার দৌড় কতটুকু, তা হলে? উত্তর আসবে, জানি তো, আইরিশ মেয়ে, খুব পড়াশোনা জানা, বিবেকানন্দের শিষ্যা, ভারতে এসেছিলেন তাঁর আহ্বানে, কলকাতায় মেয়েদের ইস্কুল খুলেছিলেন। সবই ঠিক, কিন্তু এহ বাহ্য। উনিশ ও বিশ শতকে বিশ্বের নানা দেশ থেকে এসে ভারত তথা বঙ্গকে মনের ঠিকানা করে নিয়েছিলেন এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। নিবেদিতা তাঁদের মধ্যেও একেবারে আলাদা থাকের, এ দেশ ও বিশেষত বঙ্গভূমি নিয়ে তাঁর ‘প্যাশন’-এ। ইংরেজি শব্দটাই বলতে হল, বাংলা অনুরাগ বা আবেগ-এর চেয়ে ওতেই তাঁর অনুভবের প্রতি সুবিচার হয় বলে। জাতি ও জাতীয়তার ধারণা যে সময় দানা বাঁধছে, জাতি-পরিচিতির বোধ ও সেই সূত্রে মুক্তির ইচ্ছা জনজীবনে চারিয়ে যাচ্ছে ধর্ম শিল্প সংস্কৃতি এমনকি বিজ্ঞানের হাত ধরেও, সেই মোক্ষম সময়টি ভগিনী নিবেদিতার কর্মজীবন, এ দেশে। বিবেকানন্দ তাঁকে হাতে ধরে তৈরি করে দিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু ১৯০২-এ গুরুর প্রয়াণ-পরবর্তী বাকি ন’বছর বেঁচে ছিলেন যে নিবেদিতা, তিনি সেই সময়ের ভারতের রাজনীতি সাহিত্য চিত্রকলা বিজ্ঞান শিক্ষা সমাজসংস্কার-সহ জীবনের সমস্ত পরিসরের শ্রেষ্ঠ ভাবুক ও কর্মী মানুষগুলির সহকর্মী, সহমর্মী এক জন। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রতর্কে আসীন, অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতা ছবি ও নব্যবঙ্গীয় চিত্রধারার উচ্ছ্বসিত প্রবক্তা, জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান-গবেষণার ভাবনা অর্থ পরিকাঠামো ও প্রচারের পৃষ্ঠপোষক, অরবিন্দের পথ-দিশারি। তিনি উত্তর কলকাতার গেরস্তবাড়ির দোরে দোরে গিয়ে সকাতরে ছাত্রী ভিক্ষা চান, প্লেগের শহরে পথে নামেন জনস্বাস্থ্যের পাঠ দিতে, আবার বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেরণা জোগান অগ্নিময়ী হয়ে। কতটা ভালবাসা আর প্যাশন থাকলে ভারতের মানুষের যাপিত জীবনের সব দিককে এমন আপন করে নেওয়া যায়, এবং সার্থকতা ও চরিতার্থতায় হয়ে ওঠা যায় জ্বলন্ত দৃষ্টান্তস্বরূপ, তার প্রমাণ ও ফলাফল দুই-ই তিনি নিজেই।
আমাদের দুর্ভাগ্য, নিজেদের ভাবনার দৈন্যে আমরা তাঁকে খোপবন্দি করে রাখলাম। সমাজমাধ্যমে নিবেদিতা-প্রসঙ্গ এলেই খণ্ডসত্যের বান ডাকে, এক দল তাঁকে লড়িয়ে দেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সঙ্গে, পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস না জেনেই। এক দল তাঁকে পড়েনই না, স্রেফ বিবেকানন্দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে ব্যক্তিগত রসায়নের কল্পনারসে ডুবিয়ে ভাবতেই তাদের দিন কেটে যায়। আর এক দলের কাছে এখনও তিনি ‘বহিরাগত’, নয়তো ‘ভারতে এসে অনেক কাজ করেছিলেন’-এর বেশি তাঁদের ঘটে কুলোয় না কেন। হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও আমরা তাঁর দি ওয়েব অব ইন্ডিয়ান লাইফ বা ফুটফলস অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি-র মতো ঋতবান বই ছুঁলাম না, জানলাম না সিভিক অ্যান্ড ন্যাশনাল আইডিয়ালস-এ লিখে যাওয়া তাঁর ঋজু ভারতভাবনা। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁকে মন দিয়ে পড়লে এ কালে ভুল-ব্যাখ্যাত বিবেকানন্দ সামনে এসে দাঁড়ান প্রকৃত আলোয়, আমরা নিলাম না সে সুযোগটুকু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy